দুই বড়লাটের কাহিনি   
অমলেন্দু সেনগুপ্ত                                                                      এই পাতাটি Counter বার দেখা হয়েছে
      
এই লেখাটি পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্রকাশিত পত্রিকা বাকপ্রতিমা-র  ১৪১৪ শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

                 এই লেখাটি পড়ে আপনার মতামত এখানে ক্লিক করে জানান    

এই লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এই পাতার উপরে লেখা Pulldown Menu-তে ক্লিক্ করুন অখবা এখানে ক্লিক্ করুন. |


কলেই জানেন যে ব্রিটিশ আমলে পরাধীন ভারতে সর্বোচ্চ শাসককে বড়লাট বলে অভিহিত করা হ’ত| ভারতে ব্রিটিশ আমল শুরু হয়েছিল ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের পর থেকে এবং শেষ হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ক্ষণে | একই সময়ে ভারত দ্বিখণ্ডিত হয় | ভারত ও পাকিস্তান এই দুটো রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় | এই সব ঐতিহাসিক কাহিনি সবারই জানা | ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছর সময়ের মধ্যে প্রথম ১০০ বছর ভারত শাসিত হয়েছে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর দ্বারা এবং বাকি সময় প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দ্বারা | তবে ঐ শাসনের বিশেষ প্রভেদ ছিল না | প্রজাপীড়ন সমানভাবেই চলেছে | যাই হোক এই দীর্ঘ সময়ে ব্রিটিশ সম্ভ্রান্ত বংশের মানুষেরা বড়লাট হিসেবে এসে ভারত শাসন করে আবার ফিরে গেছেন | নির্দিষ্ট সময়সীমা বলে কিছু ছিল বলে মনে হয় না তবে বেশিরভাগ বড়লাটই ৫/৬ বছর কাজ করেছেন এদেশে | কয়েকজন কিছু বেশিদিন ছিলেন আবার কয়েকজন বে শ কম সময় কাজ করেছেন | এর মধ্যে কোন কোন বড়লাট কিছু কিছু ভাল কাজ করেছেন| বেশিরভাগই গতানুগতিকের গণ্ডি পার হতে পারেন নি | ভারতে বড়লাটগিরি করার পরে অধিকাংশই হারিয়ে গেছেন | পরে বিখ্যাত হয়ছেন এমন বড়লাটের দেখা পাওয়া যায় নি | আমরা ইতিহাসে লর্ড বেন্টিঙ্কের কথা পড়েছি | এই ভদ্রলোক কিছু ভালো কাজ করেছেন | যেমন ঠগী দমন | এই মুহুর্তে আর কিছু মনে পড়ছে না | এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একজন বড়লাটই ভারতে মারা যান | বড়লাট মেয়ো গিয়েছিলেন আন্দামান ও নিকোবর পরিদর্শনে | সেখানে শের আলি নামে এক কয়েদি তাকে হত্যা করে | লর্ড মেয়ো গিয়েছিলেন দক্ষিণ আন্দামানের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় মাউন্ট হ্যারিয়েট প্রদর্শনে | তাঁর নেমে আসার সময় শের আলি ছুরি নিয়ে বড়লাটের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে | লর্ড মেয়োকে নিয়ে তক্ষুনি এক মোটরলঞ্চ রসদীপের দিকে ধাবমান হয় | মনে হয় মাঝপথেই তাঁর মৃত্যু হয় | এই ঘটনা ঘটেছিল ১৮৭২ সালের ৮ই ফেব্রয়ারি |

যাহোক এবারে যে বড়লাটদ্বয়ের কথা বলার জন্য এ লেখা, তাদের কথা বলি | এরা হলেন লর্ড কার্জন ও দ্বিতীয়জন লর্ড মাউন্টব্যাটেন | এরা দুজনেই উচ্চ বংশের সন্তান, উচ্চ শিক্ষিত এবং ইংরেজ সরকারের বিশ্বাসভাজন ছিলেন | এ ছাড়া এদের চরিত্রের বিশেষ মিল নেই | কার্যপদ্ধতিও অন্য রকম তবুও ভারত ইতিহাসের দুই সন্ধিক্ষণে এদের উপস্থিতি বড়ই বিচিত্র মনে হয়েছে আমার | দু’জনেই কিছুটা জ্ঞানত এবং কিছুটা অজ্ঞানত ভারতের অঙ্গহানির চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন | দু’জনেই সর্বজনস্বীকৃত এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় ব্যক্তিদের সম্বন্ধে অশ্রদ্ধেয় ধারণা পোষণ করতেন এবং তাদের হেয় করার চেষ্টা করেছেন | আমি এখন এ দু’জনের সম্বন্ধে আলাদা করে কিছু তথ্য দিতে চেষ্টা করব |

লর্ড কার্জন ১৮৯৯ থেকে ১৯০৫ অবধি ভারতের বড়লাট ছিলেন | তার জন্ম ইংল্যাণ্ডে ১৮৫৯ সালে | তার মানে তিনি বড়লাট হয়ে আসেন ৪০ বছর বয়সে | সে সময়ে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে | জাতীয় কংগ্রেসের পত্তন হয়েছে এবং এক শ্রেণীর ভারতবাসীর মনে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব বেশ ভালভাবে দানা বেধেছে | মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব ও বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন খুবই জোরদার হয়ে উঠেছে| তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধাণী ছিল কলকাতায়| কার্জনের আসল মাথাব্যথা ছিল এখানেই | কলকাতা, বিশেষ করে বাংলা প্রদেশকে কি ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা যায় সারাক্ষণ তিনি সেই চিন্তাতেই মগ্ন থাকতেন | রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের দুইভাগে বিভক্ত করতে চেয়েছিলেন --- ছোট ইংরেজ ও বড় ইংরেজ | উচ্চশিক্ষিত, লর্ড পরিবারের সদস্য এবং উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি হওয়া সত্বেও কার্জন নিজেকে ছোট ইংরেজ করে ছেড়েছিলেন | তার এই বিদ্বেষের কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন | তিনি ছিলেন একজন কট্টর সাম্রাজ্যবাদী এবং সে কারণেই ভারতে তত্কালীন স্বদেশী কর্মকাণ্ড তিনি আদপেই পছন্দ করতেন না | জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করে তোলাই ছিল তার জীবনের ব্রত | সত্যি কথা বলতে কি বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার উদ্ভাবক তিনি ছিলেন না | এর উদ্ভাবক ছিলেন ছোটলাট এণ্ড্রু ফ্রেজার | কিন্তু ফ্রেজারের উদ্ভাবনাকে কার্জন একেবারে লুফে নিলেন এ বিষয়ে নানা পরিকল্পনা রচনা করার কাজে লিপ্ত হলেন | ফ্রেজার তখন ছিলেন বাংলা প্রদেশের পুলিশের কর্তা | কার্জন রাতারাতি তাকে বাংলার ছোটলাট পদে বসিয়ে দিলেন | একটা জিনিষ তাঁরা খুব ভালভাবে বুঝতে পারলেন | এবং তা হল হিন্দু মুসলমান এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে দেওয়া | এ জন্য কার্জন বহু কাজ করেছেন | সত্যি কথা বলতে কি বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিল না | কিন্তু কার্জন নানাভাবে মুসলমান সম্প্রদায়কে হিন্দুদের বিরুদ্ধু উস্কানি দেবার চেষ্টা করতে থাকেন | ঢাকার নবাব সলিমুল্লা প্রথম দিকে বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন | কিন্তু লর্ড কার্জন তাঁকে এক লক্ষ পাউণ্ড ঋণ দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তিনি মত পাল্টে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করতে শুরু করেন | পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজে তাঁর যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল | ফলে পূর্ববঙ্গের মানুষও বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করতে এগিয়ে আসেন |

সাম্রাজ্যবাদী কার্জন ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে তুলতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন | তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে ভারতীয় জাতীয় আনেদোলনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলা এবং বাঙালী হিন্দু নেতৃবৃন্দই সর্বাধিক ছিল | সুতরাং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি নষ্ট করতে পারলে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে | ১৯০৪ খৃষ্টাব্দের ১৭ই ফেব্রুয়ারি কার্জন ভারত সচিবকে লেখেন --- “আমরা যদি বাঙালীর চিত্কারে ভয় পেয়ে বাংলা ভাগ না করি তবে ভারতে এমন একটি শক্তি দেখা দেবে যা ইংরেজকে বহু অশান্তিতে ফেলবে | বাঙালী নিজেকে একটি জাতি মনে করে এবং ইংরেজদের হটিয়ে স্বাধীন হতে চায় |” কার্জন ও তার দলবলের ধারণা ছিল যে বাংলার শক্তি তার একতায় | তাকে ভাগ করা হলে তার শক্তিকেও বিচ্ছিন্ন করা হবে | “আমাদের লক্ষ্য হল তাকে বিচ্ছিন্ন করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের উত্সকে দুর্বল করে ফেলা |” বঙ্গভঙ্গের সবচেয়ে জোরালো কারণ ছিল বাঙালীকে চরম আঘাত হানার ইচ্ছা | বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে কার্জন ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাকে আরো ব্যাপক করে তুলতে চেয়েছিলেন | তাঁর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গভঙ্গ দ্বারা বাঙালীদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত করা|

বাঙালীদের জব্দ করার কাজ কার্জন আগেই শুরু করে দিয়েছিলেন | কলকাতা কর্পোরেশন পরিচালনা, নগর উন্নয়ন এবং নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ব্যবস্থাপনার জন্য করদাতাদের মধ্য থেকে পঞ্চাশজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হতেন | কর্পোরেশনের কাজে সরকার হস্তক্ষেপ করত না | কার্জন এটা পছন্দ করলেন না এবং নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যা পঞ্চাশ থেকে পঁচিশে কমিয়ে আনলেন | অন্যান্য কমিটি থেকেও বাঙালীদের সংখ্যা অনেক কমে গেল | করেপোরেশনে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বেড়ে গেল | এর প্রতিবাদে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সমেত আঠাশ জন প্রতিনিধি পদত্যাগ করেন | এরপর শিক্ষাখাতেও কার্জন ব্যাপক পরিবর্তন আনলেন | সেখানেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ বেড়ে গেল|

কার্জনের এই সব কর্মকাণ্ডের এবং বঙ্গভঙ্গের অস্থায়ী ফল ফললেও শেষ পর্যন্ত তাঁর নীতি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার হতে সাহায্য করল | বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সারা বাংলা তথা সারা ভারত গর্জে উঠল | কার্জন ভেবেছিলেন যে বঙ্গভঙ্গের দরুণ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিঘ্নিত হবে | শেষ পর্যন্ত তা হয় নি এবং জনগণের আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ গভর্মেন্টকে বাধ্য হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হয় | বঙ্গভঙ্গের পরেই কার্জন বড়লাটের পদ ছেড়ে দেশে ফিরে যান | তাঁর নীতি বিফল হবার সংবাদে তাঁর মনোভাব কেমন হয়েছিল তা জানা যায় না | যাই হোক ইংরেজ হিসেবে তিনি বেশ ছোট ছিলেন এ বিষয় সন্দেহ নেই | পরবর্তী কালেও তিনি তাঁর নীচতার আরো পরিচয় দিয়েছিলেন | রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বিশ্বের নানা দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অভিনন্দিত হন | ইংল্যাণ্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁকে সম্বর্ধনা দেবার প্রস্তাব করে | লর্ড কার্জন তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান | তিনি এ প্রস্তাব খারিজ করে দেন | পরে ঐ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মান জানায় শান্তিনিকেতনে এসে | এখানে উল্লেখ্য যে রবীন্দ্রনাথও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন | ঐ সময় তিনি কবিতায় প্রবন্ধে গানে সারা দেশকে মাতিয়ে তুলেছিলেন | বাংলাদেশে তারই প্রচেষ্টায় রাখীবন্ধন ও অরন্ধন উত্সব প্রচলিত হয় | শেষের দিকে অবশ্য তিনি নিজেকে ঐ আন্দোলন থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন | নিজের কাজে ব্যস্ত থাকলেও রবীন্দ্রনাথের কর্মকাণ্ড কার্জনের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি এবং মনে হয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কবির সম্বর্ধনা সভা তিনি হতে দেন নি এই কারণেই |

কার্জনের জীবনী থেকে আমরা জানতে পারি যে উচ্চাশা থাকলেও তিনি ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন নি কারণ তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের তিনি সমর্থন পান নি | পরবর্তি কালে উইন্সটন চার্চিল তির্যক মন্তব্য করে বলেছেন যে কার্জন সব সময় নিজেকে ঘষেমেজে চকচকে রাখার প্রচেষ্টা করলেও তাতে বিশেষ সুফল হয় নি | ১৯২৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয় |

লর্ড মাউন্টব্যাটেনও উচ্চবংশের সন্তান | ব্রিটিশ রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর সমপর্ক ছিল | ১৯০০ সালে তাঁর জন্ম | তাঁর কোন রাজনৈতিক উচ্চাশা ছিল না | পড়াশোনা শেষ করে তিনি নৌবাহিনীতে যোগদান করেন এবং নৌবাহিনীর উচ্চতম পদে পৌঁছেছিলেন | এমন কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের তিনি প্রধান নৌসেনাপতি ছিলেন | এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ভারতের গভর্নর জেনারেল করে পাঠায় | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপান আত্মসমর্পণ করবার পর খোদ ইংল্যাণ্ডেও চার্চিলের নেতৃত্তাধীন রক্ষণশীল দলের সরকার পরাজিত হয় এবং শ্রমিক দলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় | শ্রমিক দল ভারতকে স্বাধীনতা দেবার কথা ঘোষণা করে | কিন্তু ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঐ সময়ে পরস্পর কোন্দলে মত্ত ছিল | মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্তে মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবী করল | ব্রিটিশ সরকার প্রথম দিকে কংগ্রেসের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইল এবং কংগ্রেসকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে আহ্বান করল | এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জিন্না প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিলেন | দেশ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে নরকে পরিণত হল | শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার জিন্নার দাবী মেনে নিয়ে ভারত বিভাজনে রাজি হল | গান্ধীজীর নেতৃত্তাধীন কংগ্রেস তাতে রাজি নয় | এই সময়ে ব্রিটিশ সরকার লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভারতে গভর্নর জেনারেল করে পাঠাল | তার প্রতি নির্দেশ ছিল ভারত বিভাগে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে রাজি করানো | এদিকে মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবীর পাশাপাশি বাংলা বিভাগের দাবী জোরদার হয়ে উঠল | যদিও মাউন্টব্যাটেন রাজনীতির লোক ছিলেন নাতবুও তাঁকে দেখা গেল কাজে সাফল্য অর্জন করতে | ভারত বিভাগে মহাত্মা গান্ধী রাজি ছিলেন না | প্রথম দিকে নেহেরুও ভারত বিভাগ চান নি | কিন্তু দেশের পরিস্থিতি দেখে তিনি মত বদলালেন | বল্লভভাই প্যাটেল ও মৌলানা আজাদও দ্বিধান্বিত ছিলেন | শেষ পর্যন্ত তাঁদেরও রাজি হতে হল | মাউন্টব্যাটেন বুঝে গিয়েছিলেন যে নেহেরুকে রাজি করাতে পারলে গান্ধীজীকেও রাজি করানো যাবে | এ ব্যাপারে উপযুক্ত সহধর্মিণীর মত লেডি মাউন্টব্যাটেন বিরাট ভূমিকা পালন করেন | এই দম্পতি নেহেরুকে বোঝাতে সমর্থ হন যে ভারতীয় নেতারা আর কতকাল সংগ্রাম করবেন --- কতদিন আর জেল খাটবেন! মাউন্টব্যাটেনের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার এবং লেডি মাউন্টব্যাটেনের আকর্শণীয় ব্যক্তিত্ব নেহেরুকে যথেষ্ট প্রভাবিত করল | নেহেরু দেশভাগে রাজি হয়ে গেলেন | প্যাটেলেরও রাজি হতে দেরি হ’ল না | আজাদ নেহেরুর মতেই মত দিয়ে থাকেন এবং এখনও তাই দিলেন | গান্ধীজী রাজি ছিলেন না কিন্তু শিষ্যদের মতের বিরোধিতা করলেন না | শেষ পর্যন্ত ঠিক হল ভারত দ্বিখণ্ডিত হবে | এইভাবে পাকিস্তানের সৃষ্টি হল | পাকিস্তান আবার দিইভাগে বিভক্ত হয়ে রইল | উত্তর পশ্চিম সিমান্ত প্রদেশ, বালুচিস্তান, সিন্ধু প্রভৃতি মুসলমান প্রধান প্রদেশ এবং পঞ্জাবের মুসলমান প্রধান জেলা এই সব এলাকা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান এবং বাংলা ও আসামের মুসলমান প্রধান জেলা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান | দেশকে কাটাছেঁড়া করবার জন্য নিয়ে আসা হল রাডক্লিফ নামক ব্যক্তিকে যিনি এর আগে প্যালেস্টাইন ও ইজরায়েলের মধ্যে জমিভাগের কাজে হাত পাকিয়েছিলেন | কি রকম হাত পাকিয়েছিলেন কে জানে! তবে ভারত-পাকিস্তানের ব্যাপারে রেডক্লিফ সাহেব যে পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন তার তুলনা হয় না | বহুস্থানেই তা একেবারেই হাস্যকর হয়ে উঠেছিল | একটা গুজব রটেছিল যে রেডক্লিফ সাহেব টেবিলের উপর মানচিত্র রেখে কলম দিয়ে দাগ কেটে পাকিস্তানের সৃষ্টি করেছিলেন | এ সবে মাউন্টব্যাটেনের কোন হাত ছিল না তাই ও আলোচনায় যাব না | মাউন্টব্যাটেনের দক্ষতা এখানেই যে তিনি ও তাঁর সহধর্মিনী গান্ধীজী, নেহেরু ও অন্যান্য নেতাদের এমন মোহ বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁদের দেওয়া সমস্ত পরামর্শ নির্বিচারে গ্রহণ করাতে কোন অসুবিধাই হয় নি | মাউন্টব্যাটেনরা চলে যাওয়ার আগে এক বিদায় সম্বর্ধনা সভায় গান্ধীজী, নেহেরু, প্যাটেল সবাই প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়েছিলেন | অথচ এই মাউন্টব্যাটেনই নেহেরুর মনে সুভাষ বোস এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা গেঁথে দিয়েছিলেন | আজ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ ফৌজের জওয়ানরা দেশপ্রেমিক হিসাবে স্বীকৃতি পান নি | কাশ্মীর সমস্যাকে রাষ্ট্রসংঘে নিয়ে যাওয়াও মাউন্টব্যাটেনেরই পরামর্শের ফল | এর ফল কি হয়েছে আমরা আজও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি | মাউন্টব্যাটেন সম্পর্কে পাকিস্তানের কোন দুর্বলতা ছিল না তাই ভারত তাঁকে গভর্নর জেনারেল হিসাবে গ্রহণ করে নিলেও পাকিস্তানে তিনি কল্কে পান নি|

মাউন্ট ব্যাটেনের সুভাষ বিদ্বেষ সর্বজনবিদিত | যুদ্ধের শেষে জাপান আত্মসমর্পণ করার পর মাউন্টব্যাটেন নেহেরুকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় নিয়ে যান | এই সফরে শোনা যায় তিনি নেহেরুকে স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করেন যে ভারত স্বাধীন হলে দেশের প্রধানমন্ত্রী কে হবে ? নেহেরু না সুভাষ বোস ? নেহেরুকে তিনি তখনি সাবধান করে দেন| নিজেও সুভাষ ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সব চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা শুরু করেন | সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের স্মৃতি বিজড়িত সমস্ত কিছু ধ্বংস করার আদেশ দেন মাউন্টব্যাটেন |

এই দুই বড়লাটের কাজের মধ্যে কিছু মিল দেখা যায় | কার্জন দেশ ভাগ করেছিলেন | কিন্তু ঘরে পরে অর্থাৎ ভারতে ও নিজের দেশেও তাঁকে এর জন্য নিন্দিত হতে হয়েছে | মাউন্টব্যাটেও ভারতবিভাগের সঙ্গে জড়িত | কিন্তু তাঁকে এ জন্য কোন সমালোচনা সহ্য করতে হয় নি | শেষ জীবন মাউন্টব্যাটেনের সুখে কাটে নি | তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয় ১৯৬০ সালে | ১৯৭৯ সালে আইরিশ বিদ্রোহীদের বোমার আঘাতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন প্রাণ হারান |


                                            ************************************************


এই লেখকের লেখা :
* মিন্টুবাবুর কথা
* দুই বড়লাটের কাহিনী
* অপরাধের দাগ কি চিরস্থায়ী



পাতার উপরে ফেরত