মিন্টুবাবুর কথা
অমলেন্দু সেনগুপ্ত                                                                      এই পাতাটি Counter বার দেখা হয়েছে
      
এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় পোর্টব্লেয়ার থেকে প্রকাশিত, ১৪১২ (2007) সালের "দ্বীপবাণী" পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় ।

                 এই লেখাটি পড়ে আপনার মতামত এখানে ক্লিক করে জানান    

এই লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এই পাতার উপরে লেখা Pulldown Menu-তে ক্লিক্ করুন অখবা এখানে ক্লিক্ করুন. |


মিন্টুবাবুর ক্ষেত্রে জুলিয়াস সীজার কথিত ঐ প্রবাদ বাক্যটি প্রযোজ্য --- এলাম, দেখলাম ও জয় করলাম । প্রবাদটি যদিও অতি ব্যবহারে জীর্ণ তবুও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ না করে উপায় থাকে না । মন্টুবাবু আজ আর আমাদের মধ্যে নেই । যদিও আমি তাঁর যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ ছিলাম তবু তাঁর সঙ্গে বসে তাঁর নিজের কথা শোনা হয় নিআজ খুবই আফসোস হয় যে কেন তাঁর নিজের কথা শুনি নি । তার সঙ্গে অনেক আড্ডা মেরেছি । একই ছাদের তলায় দিন রাত কাটিয়েছি । দীর্ঘ সময় তাঁর সান্নিধ্যে কাটিয়েছি । কোন দিন মনে হয় নি দু'দিনবসে ওর জীবনের কাহিনী শুনিআসলে ওই ধরণের সাংবাদিক অনুসন্ধিত্সা আমার মধ্যে একেবারেই নেই । এই লেখালিখির ব্যাপারটাই আমার মধ্যে নেই । নেহাৎই ই দ্বীপবাণীর সঙ্গে জুটে যাওয়া এবং মনোরঞ্জনের (মনোরঞ্জন ভক্ত, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের তদানিন্তন সাংসদ এবং দ্বীপবাণীর সম্পাদক) তাড়ায় কলম ধরতে হয়েছিল । এখন দেখছি লেখার সংখ্যা কম নয় । কিছু লেখার প্রশংসাও পাওয়া গেছে । প্রচুর পড়াশুনা করেছি তাও বলা বলতে পারি না । সাহিত্য সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলির প্রতি একটা টান ছিল । বন্ধুবান্ধবদের সাথে প্রচুর আড্ডা মারা গেছে । পোর্টব্লেয়ারে গিয়ে অতুল স্মৃতি সমিতিতে ঢুকে পড়লাম । সেখানে চমত্কার আড্ডা বসতো । নিজস্ব কোন গুণ ছিল কি না জানি না --- ওখানেই হংস মধ্যে বক যথা হয়ে বেশ কিছু কাল থাকার পর একটু একটু হংস হবার দিকে পা বাড়ালাম । কিন্তু এ লেখা তো মিন্টুবাবুর উদ্দেশ্যে লেখা, আত্মজীবনী নয় । অতএব বত্স লেখনী সম্বরণ করে মিন্টুবাবুর কথা লেখ । তোমার তো মিন্টুবাবুর সঙ্গে অনেক দিন কেটেছে, তাই না হয় বল ।

মিন্টুবাবুর আগমন পোর্টব্লেয়ারে বোধ হয় ১৯৪৯ বা ৫০ সালে । আমি ওখানে গেছি ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে। মিন্টুবাবু আমার পরেই ওখানে যান । মিন্টুবাবুর সঙ্গে পরিচয় হল। তখন তাঁর বয়স আর কত হবে, ২৫ বছর হবে। সুপুরুষ যাকে বলে, নাক মুখ চক্ষু কর্ণে কুন্দে যেন নির্মীয়মান । শুনলাম উনি উদয়শংকরের দলে ছিলেন । নৃত্যকলায় অতিশয় পারদর্শী । ময়মনসিংহের মানুষ, কথায় ঢাকাইয়া টান । প্রথম সাক্ষাতেই বন্ধুত্ব । উদয়শংকরের দল তখন ভেঙে গেছে । তার সাঙ্গপাঙ্গ সব এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে পড়েছে । শুনে অবাক হলাম মিন্টুবাবু চাকুরীর খোঁজ করছিল । তা চাকুরীর বিশেষ অভাব ছিল না ঐ সময় । মিন্টুবাবু ঢুকে পড়লেন পি ডব্লিউ ডি-তে ।

উদয়শংকরের দলে থেকে মিন্টুবাবু সবরকম নৃত্যই আয়ত্ত্ব করেছিলেন । কত্থক, মণিপুরি, ওড়িশি, ভাংড়া, ভারত নাট্যম, কথাকলি, কুচিপুড়ি ইত্যাদি । ফলে নৃত্য শিক্ষক হিসেবে তাঁকে নিয়ে মহা টানাটানি শুরু হয়ে গেলঐ সময়টায় আবার অতুল স্মৃতি সমিতিতেও একটা সাংস্কৃতিক জোয়ার উপস্থিত হল । অতুল স্মৃতি সমিতি বাঙালীদের ক্লাব । দ্বীপবাণীতে এই সংস্থা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে তাই এখানে বিশদ কিছু লিখতে চাই না । কিন্তু এই সময়ের কথা না লিখলে মিন্টুবাবুর ব্যাপারে আলোচনা ঠিক মতো করা যাবে না । অতুল স্মৃতি সমিতি গঠনের পিছনে আট-দশ জন তরুণের অবদান ছিল সব চেয়ে বেশি । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ জাপানীদের দখলে ছিল । যুদ্ধ শেষে জাপানীরা আত্মসমর্পণ করার পর ইংরেজরা আবার দ্বীপপুঞ্জে ফিরে আসে এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত দীপপুঞ্জে পুনরগঠনের কাজ শুরু করে দেয়সেই কাজে বহু কর্মী নিয়োগ করে তাদের পোর্টব্লেয়ারে পাঠানো হয় । সেই সূত্রে বেশকিছু বাঙালী তরুণ আন্দামানে পাড়ি দেয়। তখন সরকারী বিভাগ বলতে পি ডাব্লিউ ডি, মেরিন, ফরেস্ট ইত্যাদি কয়েকটিই ছিল। প্রয়োজনের তাগিদে ৮-১০ জন বাঙালী তরুণ প্রথমে এবার্ডিন বাজারে, পরে সাপ্লাই লাইনে এবং শেষে বর্তমান ডি সি অফিসের দোতলায় (তখন ঐ বাড়িতে সরকারী ছাপখানা ছিল) ব্যাচিলর মেস স্থাপন করে। ওইখানেই অতুল স্মৃতি সমিতির (আগে পাঠাগার ছিল) পত্তন হয় । জাপানী আমলে অতুল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে ব্রিটিশ আমলের ট্রেজারী অফিসার মারা যান । সন্দেহ নেই তাঁকে জাপানীরাই হত্যা করে । তারই নামে সংগঠনের নাম দেওয়া হয় অতুল স্মৃতি পাঠাগার । সংগঠনটি প্রথমে পাঠাগার, মানে লাইব্রেরী হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করা হয় । পরে এর কর্মক্ষেত্রের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নামটিও পরিবর্তন করা হয় । যদিও সংস্থাটি গঠন করেছিল ব্যাচিলার্স মেসের তরুণেরা কিন্তু এতে যোগ দিয়েছিলেন পোর্টব্লেয়ারের তত্কালীন সমস্ত বঙ্গ সন্তানই । এতে যেমন উচ্চ পদস্থ অফিসারেরা এগিয়ে এসেছিলেন তেমনি সাধারণ কর্মচারী এবং অন্যান্যরাও সক্রিয় যোগদান করেছিলেন । সমিতির কার্যক্রম ১৯৪৬ সালে শুরু হয় । তখন থেকেই দেখছি নানা রকম সাংস্কৃতিক কাজ চলতে থাকে । যেমন সরস্বতী পূজা, দোল, উত্সব, দুর্গাপূজো, কালীপূজো, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নেতাজী জন্মজয়ন্তী ইত্যাদি । এসব অনুষ্ঠানে নাটক, যাত্রা, আলোচনা সভা, সংগীত এ সবেরও ব্যবস্থা হত ।

১৯৪৯ সালে শ্রী অজয় কুমার ঘোষ দ্বীপপুঞ্জের চীফ্ কমিশনার হয়ে আসেন । তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী মল্লিকা ঘোষ বঙ্গ সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় ছিলেন বিশেষ পারদর্শিনী । তাঁর জন্ম এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পন্ন পরিবারে । সুকুমার সেন (ভারতের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার), অশোক সেন (ভারতের সফলতম আইন মন্ত্রীদের অন্যতম), সুনীল সেন (বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ) এরা ছিলেন মল্লিকা দেবীর ভ্রাতা । তিনি নিজেও শান্তিনিকেতনে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছেন । এখানে আসার আগে তিনি আকাশবাণী কলকাতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । ১৯৫০-৫১ সালে শ্রীমতী ঘোষ অতুল স্মৃতি সমিতি (এখানে ক্লিক করে সমিতির ১৯৫৪-৫৫ সালে তোলা একটি ছবি দেখুন)-র সভাপতি হন এবং ১৯৫৩ পর্যন্ত সেই পদে ছিলেন । এই সময়টা সমিতির পক্ষে স্বর্ণ-যুগের সূচনা করে বললে অত্যুক্তি হয় না । স্বর্ণ-যুগের সূচনা সৃষ্টিতে তাঁর এক বিরাট ভূমিকা ছিল সন্দেহ নেই । কিন্তু এই কাজে তাঁকে যারা সাহায্য করেছেন তাঁদের ভূমিকাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এদের মধ্যে শ্রী রবীন্দ্রনাথ মুখার্জী (তত্কালীন পি ডব্লিউ ডি-র কর্ণধার), শ্রী মিহির কুমার স্যান্ডেল (মেরিন বিভাগের সহায়ক ইঞ্জিনিয়ার) এবং বেশ কিছু তরতাজা উত্সাহে ভরপুর তরুণ যুবক । এদের মধ্যে বিজয় সেন ও বানোয়ারী বোস (সাহিত্য), রামনারায়ণ সেন ও নিশীথ চৌধুরী (সংগীত), জপেন সেন, অধীর দত্ত, ননীগোপাল দে, মনতোষ চৌধুরী, অর্ধেন্দু সেনগুপ্ত, দীপেন্দু সেনগুপ্ত, বেনু সেনগুপ্ত, মহেশ চক্রবর্তী, বিশু চক্রবর্তী, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, সত্যপ্রিয় দাশগুপ্ত এঁদের অবদানও অনস্বীকার্য । কিছু নাম হয়তো বাদ পড়ে গেল, যাদের অবদানও সমান গুরুত্বপূর্ণ । শ্রীমতী ঘোষের আগে সভাপতি হিসেবে সর্বশ্রী জ্যোতিষ চক্রবর্তী, এস এন ডি দেব রায়, মিহির কুমার স্যান্ডেল এবং এম সি ভাওয়াল পরম স্নেহে এবং যত্নে শিশু সংগঠনটিকে লালন পালন করেছেন । এই প্রসঙ্গে আরেকটি নাম অবশ্য উল্লেখ্য । তিনি হলেন শ্রী শিশির কুমার গুপ্ত (দ্বীপপুঞ্জের ডেপুটি কমিশনার এবং স্বপ্লকালীন চীফ্ কমিশনার) যিনি বর্তমান জমিটি সরকারের পক্ষ থেকে প্রদান করেন । তাঁর কাছে সমিতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে ।

এমন পরিস্থিতিতে শ্রীমতী ঘোষ সমিতির হাল ধরলেন । মিন্টুবাবুও এই সময় পোর্টব্লেয়ারে এলেন ।

মিন্টুবাবুর ভাল নাম সলিল কুমার বিশ্বাস, সে নাম আর কারও মনে নেই । মিন্টুবাবু বা মিন্টু বিশ্বাস নামেই তিনি বিখ্যাত । তিনি ছিলেন নৃত্য বিশারদ সেই সূত্রে অতি উচ্চাঙ্গের নৃত্য শিক্ষক । তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বাঙালী, তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম, কর্ণাটক, পাঞ্জাবী, উত্তর প্রদেশী তো ছিলই । তিনি বর্মী এমন কি নিকোবরী মেয়েদের নাচ শিখিয়ে অনুষ্ঠান করিয়েছেন । মিন্টুবাবুর এই বিরল ক্ষমতাকে চিনতে ভুল করেন নি শ্রীমতী ঘোষ । তাঁর ঝুলিতে ছিল শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা এবং আকাশবাণীতে কাজ করার উপলব্ধি । এ দুজনের মণিকাঞ্চন সংযোগে পোর্টব্লেয়ারে তথা সমস্ত দ্বীপপুঞ্জে শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জোয়ার । বলতে দ্বিধা নেই পোর্টব্লেয়ার তখন ছিল বেশ পিছিয়ে পড়া জায়গা । সংগীত নৃত্য নাটক করার মতো মঞ্চ ছিল না । ছিল না সংগীতজ্ঞ । সাজসজ্জা আলোকসম্পাতের বিপুল অভাব । শিক্ষিত অভিজ্ঞ কর্মীর অভাবও ছিল । কিন্তু এসব বাধা অচিরেই দূর হল । শ্রী মিহির কুমার স্যান্ডেল তার অনুগত কিছু কর্মী নিয়ে রাতারাতি মঞ্চ বানিয়ে ফেললেন সমিতি প্রাঙ্গনে । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চ পদস্থ অফিসার শ্রী যশোদাকান্ত রায় নিলেন সংগীতের ভার । নিজে বেহালা বাজাতেন এবং গানেও পারদর্শী ছিলেন । শ্রীমতী ঘোষ এগিয়ে এলেন বনমহোত্সব অনুষ্ঠান করতে । তিনি শান্তিনিকেতনের বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা কাজে লাগালেন । শোনা যায় বৃক্ষরোপণ উত্সবের "মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূণ্যে-হে প্রবল প্রাণ" গানটির কথা বেতার লিপিতে (টেলিগ্রাম) আনতে হয়েছিল কারণ সে সময়ে পোর্টব্লেয়ারে আকাশবাণীর শাখা ছিল না । টেলিফোনের সংযোগও অতটা উন্নত ছিল না । ঐদিন নেতাজী ক্লাবের প্রাঙ্গণ এবং অতুল স্মৃতির প্রাঙ্গণ নৃত্যে ও গানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল । স্থানীয় বিদ্যালয়ের বালক বালিকারা এতে অংশ গ্রহণ করেছিল ।

এর পরে শ্রীমতী ঘোষ ও মিন্টুবাবুকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি । শ্রীমতী ঘোষ একের পর এক রবীন্দ্র নাটিকা মঞ্চস্থ করিয়েছেন মিন্টুবাবুর সুযোগ্য নৃত্য পরিচালনায় । গানে অংশ নিয়েছেন শ্রীমতী ঘোষ নিজে, কিছু গৃহিণী যারা এক আধটু গান জানতেন এবং কয়েকজন তরুণ যারা গানে উত্সাহী ছিল । এদের শিখিয়ে পড়িয়ে শ্রীমতী ঘোষ অনুষ্ঠান করতে বসে যেতেন । দু-এক জনের দেখা গেল যে যন্ত্রসংগীতে অভিজ্ঞতা আছে । তাদের সাগ্রহে আহ্বান করা হল । পরেশ নায়েক নামে মেরিন বিভাগের একটি ছেলে তবলাতে অদ্ভুত পারদর্শিতা দেখাতে শুরু করল । আলোকসজ্জা এবং আবহসংগীত এই দুই এলাকা দুর্বল হয়ে রয়ে গেল । তবুও আলোকসজ্জার ক্ষেত্রে শ্রী স্যান্ডেলের চেষ্টায় প্রভূত উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে ।

সব চেয়ে বড় সমস্যা ছিল মিন্টুবাবুর । নাচের জন্য শিল্পী পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব । স্কুলে স্কুলে ঘুরে শিল্পীর সন্ধান চলত । কিন্তু মিন্টুবাবু অসাধ্য সাধন করতেন । কথোপকথনের ভাষা ছিল হিন্দি । গোড়ার দিকে মিন্টুবাবু বাংলার সঙ্গে হ্যায় নেহি ইত্যাদি যোগ করে কাজ চালাতেন । পরে অবশ্য তিনি হিন্দি ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন । কারণ ওর জীবনসঙ্গিনী ছিলেন যে হিন্দিভাষিনী । ভেবে দেখুন সেই সময় স্কুলের বাচ্চাদের দিয়ে নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদার সমবেত নৃত্য দেখাচ্ছেন মণিপুরী স্টাইলে । কুরূপা সুরূপা চিত্রাঙ্গদার জন্য শিল্পী সংগ্রহ করে তাদের মণিপুরী নাচ শেখাচ্ছেন । একই ব্যাপার ঘটেছে নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকার ক্ষেত্রেও । মিন্টুবাবু শিক্ষক হিসেবে বেশ কঠোর ছিলেন । কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর দর্শদের অকুণ্ঠ প্রশংসায় ছাত্রী সব ভুলে গেছে । একবার চণ্ডালিকার ভূমিকায় একটি বর্মী মেয়েকে নামিয়েছিলেন । আর একবার চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায় একটি নিকোবরী মেয়েকে নামিয়েছিলেন । দু'টি অনুষ্ঠানই অনবদ্য হয়েছিল ।

শ্রীমতী মল্লিকা ঘোষ, মিন্টুবাবু ও শ্রী মিহির কুমার স্যান্ডেল এই ত্রয়ী সংযোগে একটি অনবদ্য অনুষ্ঠানের কথা বলি । যুদ্ধের সময়ে জাপানীরা প্রায় একশ ইন্দোনেশিয়ানকে পোর্টব্লেয়ারে নিয়ে এসেছিল । এদের আনা হয়েছ ছিল অফিসে আর্দালীর কাজ করার জন্য । শোনা যায় যুদ্ধের সময়ে জাপানীরা ইন্দোনেশিয়ার কোন বাজারে ঢুকে এদের বন্দী করে জাহাজে তোলে এবং সোজা পোর্টব্লেয়ারে নিয়ে আসে । এই ইন্দোনেশিয়ানদের আমিও দেখেছি । নানা অফিসে কাজ করতো । বেশ নির্বিরোধী । কয়েক মাসের কাজ চালানো হিন্দি শিখে নিয়েছিল । ওরা একত্রে ব্যারাকে থাকতো । কাজের শেষে দল বেঁধে শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো । কয়েকজন খুব ভাল ফুটবল খেলতো । সন্ধ্যা বেলায় জেটিতে বা সমুদ্রের ধারে বসে গানও গাইতো । দু একজনের হাতে গীটারও দেখেছি । এমনিতে বেশ হাসিখুশি থাকলেও নিজেদের সাতন্ত্র বজায় রেখে চলতো । জাপানীরা চলে যাওয়ার পরেও ওরা থেকে গিয়েছিল । ১৯৫২ সালে হঠাৎ শোনা গেল ইন্দোনেশিয়ান সরকার ওদের নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে এবং ভারতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত নিজে আসছেন ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য । ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে অভ্যর্থনা এবং ইন্দোনেশিয়ানদের বিদায় জানাবার জন্য অতুল সমিতিতে একটি অনুষ্ঠান হয় । এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের "সাগরিকা" কবিতা অবলম্বনে একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করা হয় । ভারতের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার যোগাযোগ বহুকালের । ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিতে ভারতীয় প্রভাব খুব স্পষ্ট । সেই সম্পর্ক অবলম্বন করেই রবীন্দ্রনাথ "সাগরিকার" মতো অনবদ্য কবিতাটি রচনা করেন । অনুষ্ঠানটি উপস্থিত সবাইকে অভিভূত করে দেয় । নৃত্যাংশে মিন্টুবাবু, দৃশ্য রচনায় এবং আলোকসম্পাতে শ্রী স্যান্ডেল এবং অভিনয় পাঠ ও সমগ্র অনুষ্ঠানটির পরিচালনায় শ্রীমতী ঘোষের অবদান বর্ণনাতীত । এমন মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠান পোর্টব্লেয়ারবাসীদের মনে গভীর ছাপ রেখে যায় । এখানে উল্লেখ করার মতো মঞ্চে জাহাজডুবির দৃশ্য দেখানো হয়েছিল । এর সমস্ত কৃতিত্ব শ্রী স্যান্ডেলের ।

একটি ডাচ্ জাহাজ এসেছিল ইন্দোনেশিয়ানদের নিয়ে যেতে । পোর্টব্লেয়ারবাসীরা ব্যাথাতুর হৃদয়ে তাদের বিদায় জ্ঞাপন করে । জিমখানা মাঠে ইন্দোনেশিয়ান দল বনাম পোর্টব্লেয়ার সম্মিলিত দলের একটি ফুটবল খেলার আয়োজন হয়েছিল । ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত মহাশয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন । এ এক বিরল ঘটনা । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে জাপানীরা আত্মসমর্পণ করে ১৯৪৫ সালে । ইন্দোনেশিয়ানরা আন্দামান ছেড়ে চলে যায় মনে হয় ১৯৫২ সালে । এই বিলম্ব কেন হল মনে প্রশ্ন না জেগে পারে না । জাপান ইন্দোনেশিয়া দখল করে ডাচদের সরিয়ে । ডাচ্ সরকার ১৯৪৯ সালে ইন্দোনেশিয়াকে স্বাধীনতা প্রদান করে । জাপানী অত্যাচার, যুদ্ধের ধ্বংশযজ্ঞ এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই হয়তো এই বিলম্বের হেতু । যাই হোক এক দল মানুষ যাদের কোনও কিছু বোঝার আগেই বাজার থেকে তুলে আনা হয়েছিল তারা শেষ পর্যন্ত স্বদেশে ফিরে যেতে পেরেছে এটাই পরম সান্ত্বনার বিষয় ।

শ্রী অজয় ঘোষ ১৯৫৩ সালে দ্বীপপুঞ্জ ত্যাগ করেন । ফলে শ্রীমতী ঘোষকেও চলে যেতে হয় । আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এই দম্পতিকে বহুকাল মনে রাখবে ।

মিন্টুবাবু ততদিনে পায়ের নিচে শক্ত জমি পেয়ে গেছেন । নৃত্যানুষ্ঠানের ব্যাপারে তিনিই শেষ কথা । উত্তর মধ্য ও দক্ষিণ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কখনও নাচের দল নিয়ে কখনো নাচ শেখাবার জন্য । নিকোবরী নাচের দল নিয়ে তিনি দিল্লীও ঘুরে এসেছেন । মিন্টুবাবুর বহু অনুষ্ঠান আমি দেখেছি । আমার মনে হয় তার পরিচালিত "কারখানা" নৃত্যই সর্বশ্রেষ্ঠ । তিনি নিজেও ওই অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন । উদয়শংকরের কারখানা নৃত্যানুষ্ঠান বিশ্বখ্যাত । মিন্টুবাবু তারই অনুসরণ করেছেন । কিন্তু পোর্টব্লেয়ারের মতো জায়গায় এরকম অনুষ্ঠান করা যায় তা চিন্তার অতীত । অবশ্য এ কাজে তাকে সাহায্য করেছেন গান গেয়ে শ্রী কল্যান দাস । মহা আশ্চর্যের বিষয় এই যে মিন্টুবাবু বোধহয় কল্যাণবাবুর উপর খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন। কারখানা নৃত্যে কল্যাণবাবুর হয়তো কিছু ত্রুটি ঘটেছিল। কিন্তু অনুষ্ঠান হয়েছিল অপূর্ব ।

এই প্রসঙ্গে একটি কৌতুকপূর্ণ ঘটনার কথা বলি । সেই সময়ে সমিতির নাটকে ছেলেরাই মেয়েদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হত । সমিতিতে প্রায়ই নাটক মঞ্চস্থ হত আর মেকআপম্যান ছিলেন আমাদের মিন্টুবাবু । গান গাইতে পারতেন বলে কল্যাণবাবু স্ত্রী ভূমিকায় পার্ট করেতন । এ বিষয়ে তিনি বেশ অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছিলেন । কি একটা নাটকের ভূমিকা লিপি তৈরি হচ্ছে, নায়িকা যথারিতি কল্যাণবাবু । হঠাৎ মিন্টুবাবু আপত্তি তুললেন । একটা হৈ হৈ পড়ে গেল । পরিচালক ঘোষদা ক্ষুব্ধ। কল্যাণবাবু তো রিতিমত ক্রুদ্ধ । তিনি জানতে চাইলেন এর কারণ। মিন্টুবাবুর সংক্ষিপ্ত উত্তর - ওর গালে রং ধরে না। কল্যাণবাবুর রং ছিল একটু ময়লাই আর গাল দুটিও একটু বসা। উত্তর শুনে ঘোষদা হা হয়ে গেলেন আর কল্যাণবাবুর একেবারে মুখ বন্ধ ।

মিন্টুবাবু ছিলেন নানাগুণ বিশিষ্ট এক অনন্য ব্যক্তি । রন্ধনবিদ্যায় তার পারদর্শিতা ছিল অসীম । বিবাহ, শ্রাদ্ধ, যে কোন ভোজসভা, দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, সমস্ত যায়গাতেই মিন্টুবাবুর নেতৃত্ব রান্নার ব্যাপারে । ঐ সময়ে কলকাতা থেকে প্রায়ই জাহাজে শরণার্থীরা আসতো আর তাদের প্রথম অভ্যর্থনা সমিতির উপর বর্তাতো । রান্নার ব্যাবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই করা হত সেলুলার জেলের পেছনে খালি জায়গায় । একবার মনে আছে জাহাজ কোয়ারেনটাইনে থাকার ফলে রস দ্বীপে গিয়ে শরণার্থী দলকে খাওয়ানো হয়েছিল । এ ছাড়া রঙ্গত, মায়া বন্দরে গিয়েও এ সব কাজ করতে হয়েছে । বলাবাহুল্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই মিন্টুবাবু নেতা ।

এতসব কাজ ছাড়াও মিন্টুবাবু যে একজন প্রতিমা শিল্পী ছিলেন তা আমরা জানতে পারলাম জংলিঘাটে পূজো শুরু হবার পরে । এই কাজে তার সঙ্গী হলেন শ্রী মানবেন্দ্র চাকী । মানবেন্দ্র এর মধ্যেই দক্ষ প্রতিমাশিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন । শোলার কাজে তার নৈপুণ্য সবাইকে মুগ্ধ করেছিল । এবারে দু'জনে মিলে সৃষ্টি করলেন অপূর্ব সব প্রতিমা। মিন্টুবাবু ঢাক ঢোল বেশ ভালো বাজাতে পারতেন। তার আরতি-নৃত্য তো প্রবাদ প্রতিম হয়ে আছে ।

মিন্টুবাবুর ব্যাপারে আমার একটি অভিযোগ আছে । এমন গুণী মানুষের উপযুক্ত মর্যাদা আমরা বোধহয় দিতে পারি নি । সরকার থেকেও তাকে বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি । সারা জীবন সাধারণ কাজ করে গেছেন । সরকারী উচ্চ পদ তিনি পেতেই পারতেন । আমরাও তার জন্য কিছু করি নি ।

মিন্টুবাবু তাঁর জীবন সঙ্গিনী নির্বাচন পোর্টব্লেয়ারেই করেছিলেন । তাঁদের একটি পুত্র ও এক কন্যা । শ্রীমতী বিশ্বাস মিন্টুবাবুর আগেই পরলোক গমন করেন । পুত্র বর্তমানে উচ্চপদস্থ সরকারী পদে আছে । কন্যাও শুনেছি স্বামী-পরিজনসহ সুখে সংসার যাত্রা নির্বাহ করছেন । মিন্টুবাবুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমার বন্ধুকৃত্য সমাপন করছি ।



                                            ************************************************


এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় পোর্টব্লেয়ার থেকে প্রকাশিত, ১৪১২ (2007) সালের "দ্বীপবাণী" পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় ।

আন্দামানের অতুল স্মৃতি সমিতির প্রথম দিককার কোন ছবি যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তি আমাদের পাঠান তাহলে আমরা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাঁর নামে ঐ ছবি আমাদের সাইটে তুলে দেব ।


এই লেখকের লেখা :
* মিন্টুবাবুর কথা
* দুই বড়লাটের কাহিনী
* অপরাধের দাগ কি চিরস্থায়ী



পাতার উপরে ফেরত