নেপথ্যে ( গল্প )
চিরঞ্জয় দাস
ই-মেল :  chiranjoydas@indiatimes.com                   এই পাতাটি Counter বার দেখা হয়েছে
                                                                
                                  
জ্জৈনীর মন ভালো নেই | গতকাল রাতে ভাবনা ফোন করে তাকে খবরটা এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়ার পরই টিভির সমস্ত খবরের চ্যানেল তোলপাড় করে ফেলেছিল সে | একগাদা মেক-আপ মেখে ইংরেজদের মতো কোট পরে সুন্দরী মেয়েগুলো ঠোঁটের হিসেব কষা নড়াচড়ায় জানিয়ে দিচ্ছিল খবরটা | এর পরই সে বাবাকে ফোন করার সময়, মনের মধ্যে তখনও একটা ক্ষীণ আশা লালিত হচ্ছে, বুঝিবা সবই মিথ্যে হবে, কিন্তু যাদবজীও তো আলাদা কিছু বললেন না | উত্তর প্রদেশের এই মন্দির শহরে তখন শীতের সময় | কন্ কনে ঠাণ্ডায় শহরটা তখন যেন কুয়াশার চাদরে মৃত নগরী | গঙ্গার ধারের আলোর কণাগুলো প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে বেশীদূর ছড়িয়ে পড়তে পারছে না |

মুকুন্দলাল যাদব বারাণসীর ডি.আই.জি | উত্তর প্রদেশের লাগোয়া এক রাজ্যে গতমাসে ঘটা বিষ্ফোরণের তদন্ত করতে নেমে দেখে যায় যে ঐ হত্যালীলার অন্তরালে যে দলটি তার নেতা নাকি বারাণসীতে বসে চুলচেরা পারদর্শীতায় ভরত জুড়ে একের পর এক বিপর্যয় ঘটিয়ে চলেছে | মুকুন্দলাল নিজে এই তদন্তের ভার পান গত সপ্তাহে | একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে যখন ঐ দলনেতার হদিস জানতে পারেন তখন বত্রিশ বছরের পুলিশ জীবনে সবচেয়ে তাজ্জব বনে যান |

গত সপ্তাহে বুধবার পঞ্জাবের দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ অফিসার মনজিৎ সিং যখন যাদবজীর সাথে কথা বলেন তাঁর স্বরে চাপা উত্তেজনা ছিল | দুজনে স্কুলের বন্ধু | মাঝেমধ্যেই ফোনে কথা হয় | কুশল বিনিময়ের সাথে কিছু রসালাপও চলে | কিন্তু সেদিন দু’কথার পরই মনজিৎ সরাসরি কাজের কায় চলে আসেন | পঞ্জাব পুলিশের বিভাগীয় শাখা তদন্তে যে আঁচ পেয়েছে দুষ্কৃতকারী সাধু সেজে বসে আছে এই বারাণসীর দেবধামে, সেই তথ্য এক নিশ্বাসে জানিয়ে বলেন, যাদবজী, এই নেতাকে ধরতে পারলে মনে হয় বেশ কটা বিষ্ফোরণের জট খুলে যাবে |
- আরে বলো কি সিং সাহেব, আমারই শহরে অতিথি হয়ে রয়েছেন আর আমিই জানি না!
- মুকুন্দজী একে ধরে দেওয়ার দায়িত্ব আপনিই নিন |
- আরে বিলকুল | আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন |
- আমি কিছু ফাইল কদলই পাঠিয়ে দেব | আইডেনটিফাই করার জন্য |
- জী বিলকুল |

মুকুন্দলাল ধার্মিক মানুষ | প্রতিদিন গঙ্গাস্নান সেরে কাশীবিশ্বনাথ মন্দিরে পূজো দিয়ে বাড়ি ফেরেন | মনজিৎ সিং-এর ফোন পাওয়ার পর দিনও এর হেরফের হয় নি | তিনি দুঁদে অফিসার | ত্রিশ বছরের কর্মজীবনে তিনি বহু জটিল কেস সমাধান করেছেন | পরদিন বিকেলে মনজিৎ কথামতো দুটি ফাইল পাঠিয়ে দেন | ফাইগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়তে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেছে আর কখন যে সিগারেটগুলো নিঃশেষ করেছেন তার কোনো হুঁশ ছিলো না মুকুন্দলালের | এই দলনেতার সম্পর্কে পড়ে এবং ছবি দেখতে দেখতে অবাক হয়েছেন তিনি | শুধু ভেবেছেন তাঁর মতো ডাকসাইটে অফিসারের এতো বড় ভুল হলো কি করে ?

দুটো ঘুমের বড়ি খেয়েও সে রাতে ঘুম আসে নি | শুধু মনে হয়েছে ত্রিশ বছরের কষ্টার্জিত সম্মান, পদ, কেউ যেন লহমায় ধূলোয় মিশিয়ে তাঁকে চূড়ান্ত অপমান করেছে | চিরজীবন ক্ষুরধার বুদ্ধি ও প্রত্যুত্পন্নমতিত্বের পরিচয় দিয়ে, সব পরীক্ষায় সুনামের সাথে পাশ করে এই পরীক্ষায় তিনি শুধু ফেলই করেন নি বরং ঐ দলনেতা সমাজের চোখে বেশ ভালো মতো বোকা বানিয়েছে | নিঃশব্দ শীতের রাতে নিজের নিশ্বাসের আওয়াজ শুনতে শুনতে আর দপ্ দপ্ করতে থাকা কপালের শিরাগুলোতে হাত বুলোতে বুলোতে পরেরদিন ঐ দলনেতা ধরার ছক তিনি কষে ফেলেছেন |

গিরিধারীলালের মা-বাবা দুজনেই বয়স্ক এবং রোগগ্রস্ত | মীরা দেবীর আর্থ্রাইটিসের ব্যথার কোনো দিনক্ষণ নেই | আর পরেশনাথ তো সেই সড়ক দুর্ঘটনার পর থেকেই শয্যাশায়ী | সেদিন সকালবেলা সবে কুয়াশা কেটে গিয়ে রোদটা খোলা দরজার সারিপথে ঢুকে ঘরের কন্ কনে লাল শানে বিস্তার লাভ করছিলো | বেনারসের এই সরু গলিতেও সূর্যদেবের অকৃপণতা দৃশ্যমান | উল্টোদিকের চৌবেজীর প্যাঁড়ার দোকানের ভিড়, চুড়িওয়ালার হাঁক আর পথচলতি মানুষের গুঞ্জনের মধ্যেও কাশীবিশ্বনাথ মন্দিরের ঘন্টাধ্বনী কানে আসে | মীরা দেবী চাল বাচছিলেন আর তুলসীদাসজীর পদ তাঁর ঠোঁটে আপনিই উঠে আসছে | এই সময় মুকুন্দজী ও চারজন পুলিশকে ঘরে ঢুকতে দেখে তিনি বেশ থতমত খেয়ে যান | মুকুন্দজী মাঝে মধ্যে তাঁদের বাড়ি আসেন ঠিকই তবে এই মুকুন্দজী যেন অন্য কেউ | কঠিন মুখ | এরপর কয়েক মুহুর্তের মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে যায় | ওয়ারান্ট দেখিয়ে পুত্র গিরিধারীকে বিষ্ফোরণে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফ্তার করা হয় | এর মধ্যে বাইরে বেশ কিছু লোক জমেছে | দুই বৃদ্ধার কথায় কেউ কান দেয় নি |

এই চত্তরে শিবলালই সবচেয়ে ভালো পান বানায় | এখানকার খরিদ্দার সবাই বলে শিবলালের হাতে যাদু আছে | এমন কি অন্য পানের দোকানীরাও শিবলালের আধিপত্য মেনে চলে | গতকাল গিরিধারীকে পুলিশ গ্রেফ্তার করার পর থেকে এই পাড়াটাতে উত্তেজনা রয়েছে | রাধিকানাথ, দ্বারকাজী, সদানন্দজীর মিঠাইর দোকানে, বলরাজের মুদির দোকান বা কিষনজীর ওষুধের দোকানে আজ রোজকার মতো ভিড় হলেও কেমন একটা থমথমে ভাব রয়েছে গতকাল থেকে | কাল রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বৃন্দাবন দাসের আখড়ায় আগুন পোহাবার সময় দোকানীদের মধ্যে এই নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছিলো | প্রতাপজী, যাদবজীও ছিলেন | দুজনেই শিক্ষক | আর ছিলেন মাসিক পত্রিকা “সুবাহু”-এর সম্পাদক রামপ্রসাদ জৈন | সকলে মিলেই সিদ্ধান্ত নেন যে গিরিধারীকে অন্যায়ভাবে হেনস্থা করার প্রতিবাদে পুলিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন | মাথা নিচু করে যে হাঁটে, রাস্তায় দেখা হলেও যে সুন্দর হেসে “নমস্তে” করে, পাড়ার সকলের প্রতি যার সদ্ব্যবহার, সে কিনা সন্ত্রাসবাদী! বছর তিনেক হলো এই পাড়ায় এসেছেন মীরাদেবীরা | দিব্যি মিশুকে মানুষ | দুর্ঘটনার আগেও বৃন্দাবন দাসের আখড়ায় জমিয়ে আড্ডা দিতেন পরেশনাথজী | আর গিরি তো বই ছাড়া আর কিছু বোঝেই না | শখের মধ্যে বছরে দু’তিনবার দেশের এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়ে |

আসলে ছ’মাস পর পঞ্জাব আর উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন | উত্তর প্রদেশ সরকার যে সন্ত্রাস দমনে কিছুই করতে পারে নি মানুষ তা ভালোভাবেই জানে | একের পর এক বিষ্ফোরণ ঘটে গেছে কিন্তু দুষ্কৃতীরা ধরা পড়ে নি | তাই সরকারের অপদার্থতার মাশুল হিসেবে মানুষের ক্ষোভের আঁচ যাতে ভোটবাক্সের গায়ে না লাগে বা গদি টলিয়ে না দেয় তাই সরকার ও পুলিশ বাহিনী হঠাৎ তত্পর হয়ে উঠেছে দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে | তাই আসন্ন নির্বাচনলগ্নে কাউকে একটা সন্ত্রাসবাদী সাব্যস্ত করে যদি কোনো মামলার সমাধান করা যায় তবে রাজনৈতিক ফায়দা হবে সরকারের | গিরিধারী এই ষড়যন্ত্রেরই শিকার বলে রামপ্রসাদজী, প্রতাপজী বা যাদবজীদের বিশ্বাস | ঠিক করা হয়েছে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এঁরা জনমত গঠন করবেন রাজ্যস্তরে |

শিবলালের দোকানের পাশেই বিশ্বনাখজীর বাহন রোদ পোহাচ্ছে | শিবলালের হঠাৎ খেয়াল হলো গত সপ্তাহ ধরে যে ভিখারীটা তার দোকানের পাশে বাশা বেঁধেছিল, গতকালের ঘটনার পর থেকে সে বা তার জিনিসপত্রেরও চিহ্নমাত্র নেই আর!

চারদিন হলো কলেজ যায় নি উজ্জৈনী | গিরিধারীর গ্রেফ্তারের পর সে এতই মুহ্যমান বাড়ির বাইরেও বের হচ্ছে না | বাবা মুকুন্দলালের সাথেও তার কথাবন্ধ | বেনারস হিন্দু ইউনিভারসিটিতে পদার্থবিদ্যা নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছে সে| প্রথম বর্ষ | রসায়ণ নিয়ে গবেষণারত গিরিধারীর সাথে তার পরিচয় দুমাস মতো | ঝক্ ঝকে সুন্দর মিষ্টভাষী গিরির ক্লাসে পড়া এক বর্ণও তার মাথায় না ঢুকলেও স্রেফ এই শিক্ষকটির উপস্থিতির জন্য সারাক্ষণ অপেক্ষা করে থাকতো উজ্জৈনী | পড়া বোঝার অছিলায় ক্লাসের বাইরে বা ক্যামপাসে দেখা হলেই রসায়ণ তত্ত্বের সমীকরণের ব্যাখ্যা চাইতো সে | কোন একদিন জ্বরের দরুণ গিরি আসতে না পারায় ঠিকানা নিয়ে সোজা গিরির বাড়িতেই উপস্থিত হয় সে | উজ্জৈনীকে দেখে বেচারা গিরিধারীর জ্বর বেড়ে যাওয়ার উপক্রম | যাই হোক কিছু কথা, মীরাদেবীর অনুরোধে একটু মিষ্টিমুখ করে সেদিন বাড়ি ফিরে আসে সে | প্রকৃতির ও সমাজের নিয়মে ওদের মধ্যের “আপনি” পথ ছেড়ে দিয়েছে আরও কাছের “তুমি”-কে |

গিরির বয়স বত্রিশ | উচ্চব্রাহ্মণ, উচ্চশিক্ষিত | সেদিন উজ্জৈনী বাড়িতে আসার পর থেকেই মীরা দেবী এই মেয়েটির সম্পর্কে জানতে আগ্রহী | এক ছেলে গোঁ ধরেছে বিয়ে করে সংসারী হবে না | কত লোক নিজে থেকে সম্বন্ধ নিয়ে আসছেন | সেইদিনই তো মিশ্রজীর কন্যা রাগেশ্বরীর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ওদের কুলপুরোহিত বৈষ্ণবদাসজী এসেছিলেন | কোষ্ঠিবিচার করে তিনি দেখেছেন সাক্ষাত নাকি রাজযোটক | তবু গিরি আজ নয় কাল নয় করে চলেছে | সেই ছেলে যদি নিজে থেকে কাউকে পছন্দ করে ভালোই তো | তাছাড়া উজ্জৈনী মেয়েটিকে দেখতেও বেশ | যেন পার্বতী মা! এসব কথাই পড়শী রজনী বেহেনকে বলেছেন মীরা দেবী |

উজ্জৈনী গিরিধারীক ভালোবাসে | এই বাড়িতে গিরি বার কয়েক এসেও ছে | বাবার সাথেও ওর খুব জমে | বাবাও কি পছন্দ করেন না ? নিশ্চয় করেন | সেদিনই তো একরাশ প্রশংসা করলেন ওর | তারপর কথায় কথায় বিয়ের কথা উঠতে উজ্জৈনী বলে,
- আমি বিয়েই করবো দা |
- সচ্ বাত তো বেটি ?? বাবার মুখে হাসির আভা |
- সচ্ সচ্ সচ্ |
- ঠিক আছে | গিরিধারীর মা’কে বলতে হবে যে আমার মেয়ে বিয়েই করবে না |
- ঈশ্ | আমি কি তাই দলেছি | লজ্জায় রাঙা হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল উজ্জৈনী |
সেই বাবা কিভাবে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে গিরিধারীকে গ্রেফ্তার করে ?

পঞ্জাব বিষ্ফোরণের পর পুলিশের তল্লাশি অভিযানে কিছু দুষ্কৃতি ধরা পরে | পর পর কিছু রাজ্যে ব্যবহৃত বিষ্ফোরণের সরঞ্জাম এবং পদ্ধতির মধ্যে ফুটে ওঠা স্পষ্ট আভাস পুলিশের চোখ এড়ায় নি | আটক দুষ্কৃতিদের ক্রমাগত জিজ্ঞাসাবাদ করে যেটুকু জানা যায় এবং চেহারার বিবরণ অনুয়াযী কমপিউটর কৃত চিত্রে বিষ্ফোরণের দলনেতার একটা অবয়ব ফুটে উঠলেও তার ঠিকানা বা আশ্রয়ের কোনো হদিস মেলে নি | সেই ছবির সন্ধানে চিরুনি তল্লাশি অভিযান শুধু পঞ্জাবেই নয় পাশের রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ে | প্রতিবেশী রাজ্যের আতঙ্ক উত্তর প্রদেশে সংক্রামিত হলে, এখানে সব শহরে পুলিশ প্রহরা বেড়ে যায় | বিশেষ করে মন্দির শহর বেনারসে | এই তল্লাশি অভিযান বা দলনেতার কথা নিরাপত্তার কারণে সংবাদ মাধ্যমে জানানো হয়নি | হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে প্রহরারত সাদা পোশাকের কিছু পুলিশ গিরিধারীলালকে একদিন লক্ষ্য করে, এমন কি বাড়ি পর্যন্ত | কমপিউটরকৃত চিত্রের সাথে বেশ কিছু তারতম্য থাকলেও আদলটা যে অনেকটাই এক | এই ছবির উপর কিছু কাটাকুটির পর যেন গিরির মতই কেউ বেরিয়ে আসে | ছবি অনুযায়ী গিরির একগাল দাড়ি বা মাথায় টুপি কিছুই নেই এবং মুখটাও বেশ বয়স্ক | সঙ্গে সঙ্গে পঞ্জাব পুলিশে খবর যায় | তারপর গিরিকে গ্রেফ্তার করা হয় |

শীতের রাতের চাঁদটার একাকিত্ব যেন নিজের মধ্যেও অনুভব করতে পারছেন মুকুন্দলালজী | আজ বোধহয় শীতলতম দিন | মেয়ের সাথে আজও খাওয়ার সময় একটাও কথা হয় নি | উজ্জৈনী কিছুতেই বুঝতে চাইছে না গ্রেফ্তার করা ছাড়া তাঁর কোনো উপায় ছিল না | তিনিও বিশ্বাস করেন গিরি নির্দোষ | তমন কোনো প্রমাণ না থাকলেও ছবিটা এত মেলে কি করে ? ছেলেটাকে খুব পছন্দ ছিল তাঁর | মেয়ের তো বটেই | বাড়িতেও এসেছে | কথাবার্তা মার্জিত, পুলিশ ভ্যানে তোলার সময় গিরি প্রায় কেঁদে ফেলেছিল | সন্ত্রাসবাদীরা ইমোশনাল হয় নাকি ?

এদিকে উপরতলার হুকুম | এইরকম দেশের অবস্থা | কোন ঝুঁকি নেওয়া যায় না | মনজিৎ সিং-এর পাঠানো ফাইলে বিষ্ফোরণের বর্ণনায় ও ধৃতদের বর্ণনায় আড়ালের নেতা যে একজনই তা বেশ বোঝা যায় | কিন্তু ছবিটার সাথে গিরিধারীর মিলই তো সব ওলটপালট করে দিলো |

পাহাড়ী আদিবাসীদের গ্রামটা থেকে মাইল আটেক দূরে রতিয়া নদীর ধারে এই স্থান | জঙ্গলের মধ্যে | মনুষ্য বসতি থেকে বহু দূরে এখানে চুপিসারে নতুনদের বন্দুক শিক্ষার সাথে চলে অস্ত্র সংযোজন | প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে আসে কালাশনিকভ্ | মহম্মদ রাজার ডাকা জরুরী বৈঠকে সকল জিহাদীই উপস্থিত | রাত এখন দুটো | আবি রিয়াদকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে | হাসান আলম, হালিম, সুবান, আলি, ওমর, মোল্লাহ আলি সকলেই চেয়ে আবু রিয়াদের দিকে | জাহিদ, এই জিহাদী দলের নেতা ধরা পড়েছে বেনারসে | সে প্রায় বছর তিনেক গোঁড়া হিন্দুর ছদ্মবেশে দেবধামে | সেখানকার ডি.আই.জির থেকে এই ছ মাসে প্রচুর তথ্য জোগাড় করেছে | নিরাপত্তার ফস্কা গেরোর সাহায্যে বারানসীতে ঢুকে পড়েছে চার জিহাদী | লক্ষ্য দেবধাম কাঁপিয়ে দেওয়া | জাহিদ বছরে বার তিনেক এখানে আসে | এই দেশের সরকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মোটা টাকার বিনিময়েকত পুলিশ অফিসার যে জিহাদীদের তথ্য সরবরাহ করে চলেছে! এই যে পঞ্জাবে এত বড় বিষ্ফোরণ তারা ঘটালো, কার সাহায্যে ?

এই প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে থাকা মশালের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই একটা বুদ্ধি মাথায় এসে যায় রিয়াদের | জাহিদ ছাড়া বাকি যে দুজন ধরা পড়েছে তারা কেউ এখানকার নয় | পঞ্জাবে ছড়িয়ে থাকা জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে কোনো একটার | তাই জাহিদকে তারা নিশ্চয় চাক্ষুশ দেখে নি | শুধু এই সংগঠনের ইস্তেহারে জাহিদের যে ছবি থাকে সেটা দেখে থাকবে | সেটা সাত-আট বছরের পুরানো, একগাল দাড়ি, টুপি | একনকার সাথে কোনো মিল নেই | তবু পুলিশগুলো ওকে ধরলো কিভাবে ?

সুতরাং যে বর্ণনা ওরা দিয়েছে তা সাত-আট বছরের পুরানোটাই | ছবি ছাড়া জাহিদের কোনো তথ্যই পুলিশের জানা নেই | দরকারি ফাইল সব চম্পট করেছে চণ্ডিগড়ের ইন্সপেক্টর শর্মা! বিনিময়ে পেয়েছে লাখ লাখ টাকা | শর্মা নিজে জানিয়েছে |এই সব ভাবতে ভাবতেই রিয়াদ ঠিক করে ফেলে কি করনীয়!

গিরিধারীলালের মনে হলো মহাদেবজী মুখ তুলে চেয়েছেন | সকালের খবরটা সে বিশ্বাস করতে পারেনি | মুকুন্দজী খবর দেন যে ভুল সন্দেহে তাকে হেনস্থা করা হয়েছিলো | আসল লোক শ্রীনগরে ধরা পড়েছে | সে মুক্ত |

আবু রিয়াদের মাথার দাম কি টাকায় হিসাব করা যায় | জাহিদকে ছাড়াতে তার মোক্ষম চালে উল্টে গেলো পুলিশ | তার কথাতে সেদিন বৈঠকের পরে স্থির হয় জাহিদের ছোট ভাই রেহানকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে | এতে তার জান গেলেও পরোয়া নেই | জিহাদীরা মৃত্যুকে ভয় করে না | আর সাত বছর আগের জাহিদ যেন এখনকার রেহান, হুবহু এক |

পঞ্জাবের এক অখ্যাত গ্রামের পুলিশ চৌকিতে ফোন বেজে ওঠে | রিসিভার কানে লাগাতে জিহাদীদের টুকরো কথোপকথন কানে আসে | দুই জিহাদীর বাক্যালাপ কোনোভাবে সিগন্যালের গণ্ডগোলে পুলিশের ফোনে ধরা পড়েছে | জানা যায় আসল জাহিদ শ্রীনগরের এক ব্যস্ত মার্কেটে আসবে | ব্যস তারপর তাকে ধরা হয় |

এই ফোন আসলে পুলিশকে ঘোল খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে | কথোপকথন সাজানো | আবু রিয়াদের মস্তিষ্কপ্রসূত | ইন্সপেক্টর শর্মার জানা!

উজ্জৈনী বেজায় খুশী | বাবার সাথে প্রচুর কথা হচ্ছে তার | মুকুন্দলালজীও খুশী | গিরিকে ঠিকই চিনেছিলেন | সে দুষ্কৃতি নয় |

গিরির ছাড়া পেয়ে মনে হচ্ছে এই রকম তুখোড় বুদ্ধি নিশ্চয় আবু রিয়াদের | সে যে নিজে জাহিদ এটা সে ছাড়া জানে সায়রা আর আরিফ | মানে মীরা দেবী আর পরেশনাথ | এরা সকলেই জঙ্গি সংগঠনের এক এক স্তম্ভ | এখানে ছদ্মবেশী সেজে রয়েছে |

সে মুক্ত | আর বিষ্ফোরণ ঘটাতে জিহাদীরা বেনারসে ঢুকে পড়েছে | মুকুন্দজীর কৃপায় |

এখন থেকে যে কোনদিন দেবধাম কেঁপে উঠবে!


                                               ************************

.                     
.                                                                                                                      উপরে  


লেখক পরিচিতি পড়তে এইখানে ক্লিক করুন

লেখকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করুন তাঁর ই-মেলে chiranjoydas@indiatimes.com

"আপনার মতামত" পত্রিকার সূচির পাতায় যেতে এইখানে ক্লিক করুন

মিলনসাগর