….আমার বাবা
দীপালী সেনগুপ্ত,
কলকাতা,
মে ২০১০


ই-মেল : srimilansengupta@yahoo.co.in  
                                                             
                               
মার বাবা শ্রী মধুসূদন দাশগুপ্ত ও মাতা শ্রীযুক্তা সুপ্রীতি দাশগুপ্তা | মানুষ তো কেউই আকাশ থেকে পরে না,
এই ধরিত্রীর কোলেই হয় তার জন্ম ও কর্ম | ছোটতেই শুনেছিলাম ঢাকা জেলার অন্তর্গত শুয়াপুর গ্রামের জমিদার
বংশের সপ্তম পুরুষ আমাদের পিতামহ শ্রী ফণিভূষণ দাশগুপ্ত | তাঁর পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা ছিল | আমার বাবা
মধুসূদন দাশগুপ্ত ছিলেন তৃতীয় সন্তান |

দেশ বিভাগের বহু পূর্বেই আমাদের ঠাকুর্দা তাঁর বড় কন্যার বিবাহ দেন শুয়াপুরেই | শুনেছি বড় পিসিমার বিয়েতে
বাজীর আগুনে দুটো গ্রাম পুঁড়ে যায় | এত বাজী পুঁড়েছিল | সেই গ্রাম দুটো ঠাকুর্দা আবার পুনর্নিমান করে দেন | ছোট
পিসিমার বিয়ে বোধহয় ঢাকাতেই হয়, ঠিক মনে নেই |

বাবা-পিসিমার মুখে শুনেছিলাম, আমাদের পিতৃ-পিতামহগণ এত ধনী ছিলেন যে পিসিমারা পাথরের গুটির বদলে
সোনার গুটি দিয়ে খেলতেন | অবিশ্বাস করবার কোন কারণ নেই কারণ সেই সময় তো সোনার দাম মাটির ঢেলার
মতই সস্তা ছিল |

বাবা বলেছিলেন নারায়ন গঞ্জ থেকে শুয়াপুর পর্যন্ত ইজারা (lease) নেওয়া থাকতো শুয়াপুরের জমিদারদের | পরে
কালধর্মে পিতামহ চলে আসেন ঢাকাতে | সেখানেই ওঁর জীবনান্ত ঘটে | আমাদের ঠাকুরমা বহুপূর্বেই স্বর্গবাসীনী
হয়েছিলেন | আমাদের বড় জ্যাঠামশাই ও মেজ জ্যাঠামশাই ঢাকাতেই কর্মসূত্রে থেকে যান |

আমাদের বড় জ্যাঠামশাই বিবাহিত ছিলেন ওঁর তিন ছেলে ও এক কন্যা ছিল | মেজো জ্যাঠামশাই বিয়েই করেন নি |
আমাদের বাবা ও ছোট দুই ভাই কে নিয়ে চলে আসেন উত্তর বঙ্গের জলপাইগুড়িতে | জলপাইগুড়িতে আমাদের
ছোট পিসিমার শ্বশুরবাড়ী ছিল বিশিষ্ট নিয়োগী বাড়ী | তারপর ৪০ বছর বয়সে বাবা সংসারী হন, বিয়ে করেন |
মায়ের মুখে শুনেছিলাম, ওঁদের বিয়ে নিয়েও এক মিষ্টি মধুর গল্প হয় |

পিসিমারা বহু চেষ্টা করেও বাবাকে বিয়ে করতে রাজীকরাতে পারেন নি | তিনি সমাজসেবা করে আনন্দ পেতেন |
তখন তো, এখনকার মত সমস্ত কিছুই এত সহজলভ্য ছিল না | যেমন চিকিত্সার সুবিধা, এম্বুলেন্স, ঘরে আগুন
লাগলে ফায়ার ব্রিগেড, গলির মোড়ে মোড়ে ডাক্তারের ডিস্পেনসারি ইত্যাদি | কাজেই পাড়ার ছেলেরাই এসব কাজে
এগিয়ে আসতো |

একটা কথা বাবা ভালই জানতেন যে, শরীর স্বাস্থ্য ভাল না থাকলে মনও ভাল থাকে না | কয়েকজন যুবককে নিয়ে
তিনি স্বাস্থ্যচর্চা করতেন| ডাম্বেল ভাজা, দুই হাতে দুই কাঠের মুগুড় আড়াই মনি এক একটা, অবলীলায় ঘোরাতেন |
আমরা ছোটতেই দেখেছি | সাঁতারে তো বলতে গেলে চ্যাম্পিয়ান বলা চলে | বাবার স্বাস্থ্য ছিল দেখবার মত | স্যার
আশুতোষের মত একজোড়া গোঁফ, ভরাট মুখের শোভা বর্দ্ধন করতো | খুব দীর্ঘ লম্বা ছিলেন না, মাঝারি উচ্চতা ,
পেটান শরীর যাকে বলে | যখন গম্ভীর থাকতেন তখন কার সাধ্য কাছে গিয়ে কথা বলে ! খুব রাশভারী পুরুষ ছিলেন
| আর যখন প্রসন্ন থাকতেন, এমন চমত্কার মমতা ভরা মুখ, মিষ্টি হাসি দিয়ে কথা সুরু করতেন ; মনে হতো সবারই
অতি কাছের লোক | পরোপকারীতাই যেন বাবার জীবনের মূলমন্ত্র ছিল |

কার বাড়ীতে মৃতের সত্কার করতে কেউ নেই, সেখানে তিনি দলবল নিয়ে হাজির | কোথায় টি.বি. রুগি মারা গেছে,
সে বাড়ী তখনকার দিনে অচ্ছুৎ হিসাবে পরিগনিত হতো, সে বাড়ীর ধারে কাছেও কেউ যেত না | সেখানে তিনি
উপস্থিত| হয়তো অন্য পাড়াতে আগুন লেগেছে, সে যে কোন সময়ই হোক না কেন! শীত গ্রীষ্ম যখনই হোক | বাবা
বরাবরই হাতায়ালা গেঞ্জি গায়ে দিতেন, সেই গেঞ্জি গায়ে খদ্দরের ধুতি কোমড়ে একট গামছা বাঁধা ব্যাস বাবা ছুটলেন
আগুন নেভাতে | পাড়ার লোকেদের শুধু শুধু চিৎকার না করে যার যার বাড়ীতে বালতি ইত্যাদি আছে, তাই নিয়ে
আসতে বলতেন | তখন কারো বাড়ীতে বিশেষ জলের কল ছিল না, বেশীর ভাগ বাড়ীতেই কূঁয়া, না হয়তো ইঁদারা |
তারপর হাতে হাতে চলতো জল সাপ্লাই | বাবা প্রথমেই বড় লাঠি দিয়ে বা বাঁশ দিয়ে টিনের চাল গুলো ঘরের থেকে
ফেলে দিয়ে তা পিঠে করে আগুনের আওতার বাইরে নিয়ে আসতেন | বহুবার হাতে পায়ে জখম হয়েছেন সব গ্রাহ্যও
নেই | বেপরোয়া মানুষ একজন | ছোটবেলায় দেখা এসব, এখনও মনে গেঁথে আছে |

তারপর কার গরীবির জন্য মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না | পণের টাকা না দিতে পারার জন্য বিয়ে বন্ধ হবার জোগাড়,
সেখানে পাত্র পক্ষকে সমঝোতা করিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া | বাবার পণ-ই ছিল, পণ দিয়ে বিয়ে দেওয়া চলবে না
এবং পণ নিয়ে বিয়ে করা চলবে না | সত্যই নিজের জীবনেও তিনি, ছেলে মেয়ে কারুর বিয়েতেই পণ দেওয়া নেওয়া
করেন নি |

তারপর... হঠাৎ রাত দুপুরে হাসপাতালে মরণাপন্ন রুগী নিয়ে গিয়ে ডাক্তারদের সাথে সমঝোতা করে রুগী ভর্ত্তি করা
| ডাক্তাররা শেষে সবার পরামর্শমত, জলপাইগুড়ি সরকারী হাসপাতালে মধুবাবুর নামে একটি ‘বেড’ সংরক্ষণ
করেছিলেন |

তারপর শশ্মানযাত্রীদের নানান অসুবিধার কথা ভেবে একটি চুল্লির ব্যবস্থা করেন | সেটা এখনও আছে কিনা আমার
জানা নেই |

বাবার কাছে আমাদের ফার্স্ট এইড্ নিতে শেখা | উনি কোথ্বেকে শিখেছিলেন জানিনা | ট্রেনিংছিল কিনা জানা নেই |
কি ভাবে হাতের, পায়ের, আঙ্গুলের,বুকের, মাথারব বা শরীরের যে কোন জায়গায় কাটলে অথবা ভাঙ্গলে ব্যান্ডেজ
বাঁধতে হয় | শিখিয়েছিলেন কিভাবে শয্যাশায়ী রুগীকে বেডের থেকে না সরিয়ে বিছানার চাদর পাল্টাতে হয় |

একটু পারিবারিক পরিচয় দেওয়া না থাকলে তো কারুর সম্বন্ধে কিছু বলা সম্ভব নয় | তখন বাবা দুই ভাই কে নিয়ে
করলা নদীর ওপারে রায়কত পাড়াতে ভাড়া বাড়ীতে থাকতেন | নিজেরাই রান্না করে খেতেন | আমাদের রাঙ্গাকাকা
আসামে চাকুরী নিয়ে চলে যান | এই কাকাই ছিলেন তিন ভাইএর ভিতর খুব বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন | এ কথা মায়ের মুখে
শুনেছি |

রাঙ্গাকাকা আসামে চাকুরি শুরু করেই শিল্পসমিতি পাড়ায় বাড়ী করার কথা ভাবতে থাকেন | তারপর ওঁরই প্রচেষ্টায়
শিল্পসমিতি পাড়ায় বাড়ী হলো | আমাদের খুব দুর্ভাগ্য, খুবই অল্পবয়সে বিয়ের একবছরের মাথাতেই গর্ভবতী পত্নীকে
রেখে উনি চলে যান | সন্তানের মুখ দর্শনও করতে পারেন নি | রাঙ্গাকাকা হঠাৎ চলে যাওয়াতে আমাদের বাবা প্রচন্ড
মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন | রাঙ্গাকাকার স্মৃতি রক্ষার্থে বাবা বাড়ীতে একটা লাইব্রেরী তৈরী করেছিলেন |
রাঙ্গাকাকার নাম ছিল গিরীজাভূষণ দাশগুপ্ত | কাকার নামে ‘গিরীজা পাঠাগার’ | ছোটকাকার নাম ছিল অমূল্যভূষণ
দাশগুপ্ত | ছোট কাকা কমিশনার অফিসে কাজ করতেন | ইনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থে-ই লক্ষণ ভাই, দাদাদের কাছে |
দাদারা যা বলতেন তাই মানতে চেষ্টা করতেন | দাদাদের ছাড়া কিছুই জানতেন না | বড় হয়ে দেখেছি আমাদের
মাকে নিজের মাতৃত্বের আসনে বসিয়েছিলেন |

বাবা গোপালপুর চা বাগানের সেক্রেটারী হয়ে জলপাইগুড়ি অফিসে কাজ করতেন | তিন ব্যাচেলারের সংসার |
সংসার প্রায় অচল |

আমাদের ছোটপিসিমাকে আমরা রাঙ্গাপিসিমা ডাকতাম | তাঁর টুকটুকে রং এর জন্য | এই পিসিমা বহু চেষ্টা করেও
ভাইকে বিয়েতে মত করাতে পারেন নি | বহু ভাল ভাল সম্বন্ধই এসেছিল | ছোট উপযুক্ত ভাইদেরও বিয়ে আটকে
আছে | বড়র বিয়ে না হলে ছোটদের কি করে বিয়ে হয় ?

রাঙ্গাপিসিমা ঢাকা নারায়নগঞ্জে পাটগ্রামে আমাদের আর এক পিসিমাকে চিঠি লেখেন | এই পিসিমা আমাদের বাবা-
কাকাদের দূর সম্পর্কের বোন | এই বোনের সাথে আমাদের বড় মামার বিয়ে হয়েছিল | এই দাদার বাড়ীতেই
আমাদের ভবিষ্যৎ জননী বেড়াতে গিয়েছিলেন | হয়তো প্রজাপতি ব্রহ্মার রসিকতাই এর মূল কারণ | সেই ঢাকা
পাটগ্রামে নিয়োগীবাড়ী নামকরা ছিল | এই নিয়োগীবাড়ীর-ই বৌ ছিলেন আমাদের রাঙ্গা পিসিমা | নিয়োগীবাড়ীতে
প্রকান্ডবড় করে দুর্গাপূজা হতো | দু-তিনটি গ্রামের ভেতর সাড়া পরে যেত | নিয়োগীবাড়ীর আত্মজনেরা যে যেখানেই
থাকুন না কেন, দিল্লী, বোম্বে, কলকাতা সবাই এই সময় পদ্মানদী, স্টিমারে পাড় হয়ে এসে যেতেন | সেই পাটগ্রামে
নিয়োগীদের উদ্যগে করা হাই স্কুল, আরও নানান উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছিলেন এই নিয়োগীরা | বদ্ধিষ্ণু গ্রাম
ছিল পাটগ্রাম | সেই পাটগ্রাম এখন আর নেই পদ্মাগর্ভে তার স্থান হয়েছে |

বাবার বয়স তখন ৪০ বৎসর, দেখতে ৩০ বছরের যুবক | এত ভাল স্বাস্থ্য ছিল | রাঙ্গাপিসিমা ভাইকে বললেন
পাটগ্রামে দিদি অসুস্থ হয়েছেন দেখে আসতে | ভাই তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে দিদিকে দেখতে ছুটলেন | পিসিমার গোপন
উদ্দেশ্য ছিল পাত্রকে একবার পাত্রী দেখান |

পাত্র তো কিছুই জানতো না | পাটগ্রামে গিয়ে সুস্থ দিদিকে দেখে ভাই অবাক | দিদি দিব্যি বহাল তবীয়তে বিরাজ
করছেন | দিদি বললেন এসেছিস , থেকে যা দুদিন ঘুড়ে টুরে দেখে যা, আমরা কেমন আছি | এতদূরে তো আর চট
করে আসা যায়না | দিদি বিয়ের কথা বা পাত্রী দেখার কথা কিছু বললেন না | পাত্রীকে একরকম লুকিয়েই রাখা
হয়েছিল | পাত্রী কিন্তু খুবই সুন্দরী ছিলেন |

একদিন শুভ সকালে পাত্রী গেছেন বাড়ীর ফুল বাগানে ফুল তুলতে | ফুলের একটি ডাল অনেক উঁচুতে, ফুলে একেবারে
ভর্ত্তি |কিছুতেই হাতের নাগালে পাচ্ছেন না | ছোট ছোট লাফ দিয়েও হাত পাচ্ছেন না | হটাৎ পেছন থেকে একটি
পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো- তুমি একটু সরো আমি ডাল নিচু করে ধরছি, তুমি ফুল তুলে নাও | ব্যাস ! ফুলধনুস্বরঃ নিয়ে
আর একজন তো বসেই ছিলেন রেডি হয়ে | হয়ে গেল চার চোখের মিলন, শিবের ধ্যানভঙ্গো |

এ গল্প মা’এর মুখেই শোনা | লজ্জা লজ্জা মুখে পঞ্চাশোতীর্ন বয়সে মা যখন এ গল্প শোনাতেন, মা এর সুন্দর মুখে
নবপরিনিতার লজ্জা লজ্জারুণ আলো ফুটে উঠতো | মা’এর ১৯ আর বাবার ৪০ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল | প্রায়
১০০ বছর আগের ঘটনা | তখন তো এমন কতই হতো |

তারপর নববধূকে নিয়ে জলপাইগুড়িতে প্রত্যাবর্ত্তন | বাবা বিহবাহিত হলেও মনটা তো কিছুই বদলায়নি | কারণ
যাঁকে সহধর্মিনী করে এনেছিলেন, তিনি ছিলেন যোগ্য সহ-কর্ম্মিনী | গরীবের ঘড়ের মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা, নিজের
গায়ের গহনা খুলে দিয়েদিলেন | পরনের নতূন শাড়ী খুলে দিয়ে দিচ্ছেন | কেউ কিছু বল্লে মিষ্টি হেসে উড়িয়ে দিতেন |
এটা একটু আশ্চর্য্য! মেয়েদের শাড়ী গহনার প্রতি আকর্ষণ জন্মগত | সেই টান ভালবাসা ভাললাগা, কারুর অভাব
দেখলেই এক নিমেষেই উধাও হয়ে যেত | ব্যাস জমে গেল সংসার | দুজনের একজনও সংসারি ছিলেন না |

এই সময় মনে হয় আমাদের শিল্পসমিতি পাড়ার বাড়ীর পেছন দিকে চিড়িয়াখানা, চমৎকার ফুলবাগান হলো | করলা
নদীর পাড় থেকে প্রাচীর গেঁথে ওঠান হয়েছিল | বাঁধান সিঁড়ি ওপর থেকে একেবারে নদীর বুক পর্যন্ত নেমে গেছে,
সিঁড়ির দুইধারে বাঁধান বেঞ্চ | বাগানে কত রকমের ফুলের ঝাড় | প্রচুর ক্যানারিজ পাখী, রং-এর বৈচিত্রে অনন্য |
৯টা ময়ুর ময়ুরী | সব তারের জালের খাঁচায় থাকতো | দুটো প্রকান্ড ময়াল সাপ, উত্তরবঙ্গে যা বিখ্যাত | সপ্তাহে
একটা করে মুরগী ছিল তাদের আহার্য্য | অবশ্য দুটোর জন্য দুটো মুরগী | জোরার একটা মরে যাবার পর আর
একটা তার সঙ্গীকে খুঁজতে লোহার রড্ বেঁকিয়ে বেড়িয়ে যায় আবার সারাদিন পর বিকালে ফিরে আসে | বাবা,
একটা চায়ের প্যাকিং বক্স নিয়ে সাপটার মুখের সামনে ধরে ‘আয় আয়’ করে ডাকলেন , আর সাপটা আস্তে আস্তে
বাক্সের ভেতর ঢুকে পরলো | তারপর ওটাকে নিয়ে গিয়ে তার খাঁচায় ভরে দেওয়া হলো | তখন আমার বয়স ৬/৭
হবে | নিজের চোখে দেখা | এই সময়েই গড়াল বাড়ীর ৩০০ বিঘা জমি, লক্ষ্মীর ধাম হয়েছিল |

বাবার সান্নিধ্য যতটুক পেয়েছি, দেখেছি এক বিশাল হৃদয় |বাড়ীতে ভাগলপুরী গাই ছিল একটি, নাম তার লছ্মী,
চলনেও লক্ষ্মী স্বভাবেও লক্ষ্মী | রোজ দুধ দিত ১০ সের করে| বাবা নিজের হাতে তার পরিচর্যা করতেন | বাড়ীতে
কয়েকটি কাজের লোক থাকা সত্বেও নিজের হাতে গোয়াল (নাড়া) কেটে খৈল, ভূষি আরও কত কিছু মিশিয়ে জাব
তৈরী করে লছমীকে খাওয়াতেন | যদি কোন কারনে বাবা খাওয়াতে না পারতেন তবে সেদিন আর লছমীর আর
খাওয়াই হতো না| অন্যর হাতে লছমী কিছুতেই খেতে চাইতো না | নদীতে নিয়ে গিয়ে বাবা, গা ডলে ডলে স্নান
করাতেন |

একদিন বিকালবেলায় বাড়ীর বাইরে আমরা কয়েকজন ভাইবোন খেলা করছি | বাড়ীর বাইরে একটা খুঁটিতে লছমী
বাঁধা ছিল | হটাৎ দেখি লছমী গলার দড়িটা খুলে ফেলবার জন্য টানাটানি করছে | আমরা ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি
সুরু করেছি,হটাৎ দেখি লছমী গলার দড়ি খুলে রাস্তায় ছুটে চলছে | আমরাও ওর পেছন পেছন গিয়ে দেখি, বাবা
অফিস থেকে ফিরে আসছেন | বাবা হেঁটেই যাতায়াত করতেন | লছমী ছুটে গিয়ে বাবার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আদুরে
মেয়ের মত বাবার মুখের দিকে নিজের মুখটি বাড়িয়ে দিয়েছে | আর বাবা লছমীর ‘গলকম্বলে’ হাত বুলিয়ে দিতে
দিতে ধমকের সুরে বলছেন ---দ্যাখ্ তো বাচ্চাদের কেমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিস ? আর লছমী চোখবুজে আছে পরম
আরামে | নিশ্চিন্তে আরাম খাচ্ছে |

আমাদের একান্নবর্ত্তী পরিবার ছিল | তখনকার দিনে প্রায় সমস্ত বাড়ীই তাই ছিল | রবিবার বন্ধের দিন, দুপুরে
খাওয়া দাওয়ার পর বাবা নিজের ঘরে বিছানায় বসে গড়গড়াতে অম্বুরি তামাক খেতেন| সেদিন বাইরের শালিসি,
নালিশ মজলিস্ কিছুই হতো না | এদিন শুধু বাড়ীর ছেলেমেয়েদের ‘সঙ্গ’দেবার দিন বাবার | সবাই একসাথে জুটে
এসে, বাবার মুখে গল্প শনতে বসতাম |

বাবার মুখে গল্প শুনেই তো, মনের বন্ধ কপাটগুলো একটি একটি করে খুলে যেত | ‘কল্পনার’ রাজ্যে মন উড়ে যেতে
চাইতো | বই পড়ে আরও অ-নে-ক কিছু জানতে প্রবল আগ্রহ গড়ে উঠ্ তো |

বাবার মুখেই প্রথম শোনা, বিক্রমাদিত্যের বত্রিশ সিংহাসন, পঞ্চতন্ত্র, ঠাকুরমারঝুলি ইত্যাদি রূপকথার ‘আকর’ |
আবার রবিনহুড, টারজেন, এসব গল্প | তখন নির্বাক সিনেমার যুগ | লরেল হার্ডি এসব তো সিনেমায় দেখা যেত |
বাবাদের বন্ধুরা কয়েকজন মিলে নদীর পাড়ের হ’ল আর্য্যনাট্ট সমাজ-এ যেতেন | শুধু আমরা ছোটরাই নয়, আমাদের
বড় দিদিরা সবাই উঁচু ক্লাসে পড়া সত্বেও, বাবার মুখে গল্প শুনতে চলে আসতো| বাবার মুখে শেষ গল্প শোনা ‘তল্পি-
তল্পা পইরা রইলো, হরিদাস তোমার বিদায় লইলো’ | তারপর শেষ টা শোনা হয়নি|

বাবা মেয়েদের স্বাবলম্বী হতে চেষ্টা করতেন | দিদিদের জন্য ছোট নৌকা কিনেছিলেন | আমাদের বাড়ী থেকে করলা
নদী পাড় হয়ে ওপারে রায়কতপাড়াতে ‘উমাগতি বিদ্যামন্দিরে’ পড়তে যেত| নিজেরাই নৌকা বেয়ে যেত | করলা
নদী আজ মৃত, একটা শাড়ীর পাড়ের মত সরু হয়ে বয়ে চলছে কিন্তু সে সময় এপার ওপার পার হতে ১০-১৫ মিনিট
সময় লাগতো, নদীও খুব গভীর ছিল | বর্ষার সময় দুকুল ভাসিয়ে উদ্দাম হয়ে উঠতো| দেখলে ভয় করতো|

আমার বয়স তখন ৭ | তখন দেশপ্রমের চোরা স্রোত বয়ে চলছে | জলপাইগুড়ি অবশ্যই ছিল একটি শিক্ষিত ও
সংস্কৃতিবান শহর | সক্রিয় ও আত্মগোপনকারী দেশপ্রেমিকের অভাব ছিল না | পুলিশও খুবই সজাগ ছিল| বাবার
আর একটা পরিচয় পাই আত্মগোপনকারী স্বদেশ প্রেমিক | গোপনে নিজের বাড়ীতে স্বদেশীরআনাগোনা হ’তো| সেই
সময় দেখেছিলাম, আমাদের অপরিচিত যুবকদের আমাদের বাড়ীতে আনাগোনা | অত্যন্ত গোপনে |

হঠাৎ গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখেছিলাম দুতিন জন দাদাদের বয়সি ছেলেরা , বড় ঘরে খেতে বসেছে , মা এক
গলা ঘোমটা দিয়ে পরিবেশন করে তাঁদের খাওয়াচ্ছেন | আর ছেলেরা ও বাবা ফিসফাস করে কথা কইছে | মশারীর
ভেতর থেকেই দেখেছি | তারপর দেখলাম বাবা ওদের নিয়ে নদীর ঘাটের দিকে গেলেন | জানালা দিয়ে দেখি, বর্ষার
উদ্দাম করলা পার হয়ে নৌকো বোয়ে বাবা চলেছেন ছেলেদের ওপারে পৌঁছে দিতে | মাঝে মাঝেই এ দৃশ্য দেখেছি |
মা’য়ের মুখে শুনেছি এরা স্বাধীনতা সংগ্রামী আমাদের নমস্য |

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে | নেতাজীর নিরুদ্দেশ হওয়া | জাপান থেকে হঠাৎ একদিন রাতে
রেডিওতে ঘোষনা শোনা গেল | ‘আমি সুভাষ বলছি’ | ওই জলদমন্ত্র কন্ঠস্বর শুনে সমগ্র ভারতের আবালবৃদ্ধবনিতা
ঝিমিয়ে পরা মাথাগুলো এক সাথে ঝাড়া দিয়ে উঠে হিমালয়ের সমতূল্য হয়ে উঠলো |নীরব একটা আনন্দের ঝড় বয়ে
গেল |

তখন ব্ল্যাক আউট চলছে | ইংরেজের শেষ কামড় এবং জাপানী বোমার আক্রমনে, ভারতের মানুষ উদভ্রান্ত |
সন্ধ্যার পর ঘরে ঘরে বাতি আর জ্বলে কি না জ্বলে! তখন সমস্ত শহরে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের বাড়ীতে রেডিও
এসেছে | ইলেকট্রিক যাদের ঘরে ছিল , তাদের লাইট আচ্ছাদনের আবরণে ঢাকা থাকতো |আমাদের বাড়ীতে
বড়ঘরের পাশে বাইরের বারান্দার একপাশে রেডিও ঘর ছিল |ঘরটি এতছোট ছিল যে শুধু ছোট একটি টেবিল, তার
ওপর রেডিও থাকতো,টেবিলের পাশে একটি চেয়ার | ঘরে মেঝেতে সতরঞ্চি বিছিয়ে বড়জোর ৫-৬জন লোক বসতে
পারে | যে দিন থেকে রেডিওতে নেতাজীর কন্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেল , তারপর দিন থেকে রেডিও রুমে তিল
ধরনের ঠাঁই নেই | ঘরে দরজা ছারিয়ে বারান্দাতেও মানুষে ভর্ত্তি | জানালায় দরজায় কালো পর্দ্দা, ঘরের বাতির
আলো যেন বাইরে দেখা না যায় | রেডিও বেশী জোরে চালান যাবে না | সমস্ত শহর অন্ধকার |

বাবা ছিলেন প্রচার বিমুখ | পড়ার বইতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সেবার কথা পড়েছি | কিন্তু আমাদের বাবার সেবার
কাজ লোকচক্ষুর অন্তরালেই হতো | আমাদের বাড়ীতে ‘কালী ঝাঁ’ বলে একজন রান্নার ঠাকুর ছিল | রান্নার ঠাকুর
অবশ্য আরও একজন ছিল | কারণ প্রতিদিন প্রায় ৫০টির মত ‘খাবার পাত’ পরতো রান্নাঘরে |একজন ঠাকুরের পক্ষে
দুইবেলা সামাল দেওয়া সম্ভব হতো না | বাড়ীর লোক ছারাও অতিথি অভ্যাগত অনেকে হঠাৎ হঠাৎ এসে পরতেন |
তখন শহরে হোটেলের চল ছিল না | নামকরা যে কয়জন ছিলেন তাঁদের বাড়ীতেই হঠাৎ করে এসে পরা অতিথি
জনেরা এসে উঠতেন | এটাই ছিল তখনকার রীতি | সেদিন ছিল শনিবার হাফ্-ডে স্কুল | তখন বাড়ীর বাইরের দিকে
পায়খানা থাকতো, বড় উঠোন পেরিয়ে পায়খানায় যেতে হতো , প্রায় সব বাড়ীতেই এক ব্যবস্থা ছিল | বাড়ীর
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছি, সেই ঠাকুর কাপড় চোপড় ময়লা করে তার ভেতর পরে আছে, মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে
| আর তার চারিদিকে নিরাপদ দুরত্বে বাড়ীর যত কাজের লোক , দ্বারবান অবধি সবাই | নাকে কাপড় দিয়ে দাঁরিয়ে
আছে | দুপুরের রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে | বাবা তক্ষুনি অফিস থেকে ফিরেছেন|

বাবাকে কেউ বোধহয় খবরদিয়ে এসেছিল | বাবা এসেই দুইহাতে ঠাকুরকে পাঁজাকোলাকরে নদীর ঘাটের দিকে চলে
গেলেন | চাকরদের কাকে বলে গেলেন বাড়ীর গাড়ী বার করতে | আমাদের একটা অস্টিন গাড়ী ছিল | তখন এম্বুলেন্স
ছিল না বোধ হয় | বাবা বলে গিয়েছিলেন ফিনাইল দিয়ে পায়খানা থেকে সমস্ত উঠান ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করতে |
তারপর আর আমাদের (ছোটদের ) বারান্দায় দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি | দিদিরা পরে বলাবলি করছিল, গাড়ী করে
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর বিকালের দিকে কালী ঝাঁর মৃত্যু হয় | ঠাকুরের পরিবারের জন্য বাবা নাকি যথেষ্টই
করেছিলেন | বিহারের কোন জেলায় ঠাকুরের বাড়ী ছিল | এ রকম শুধু একটাই নয় আরও অনেক আছে |

তখন বয়স আমার খুবই কম, বছর তিন-চার হবে, আমার খুব মনে আছে |মা’ য়ের মুখে শুনেছিলাম, আমি নাকি
দুটো পায়ের পাতা-ই ব্যাঁকা নিয়ে জন্মেছিলাম | প্রায় তিন -চার বছর পর্য্যন্ত ছিল | আমাদের এত কাজের লোক
থাকা সত্বেও রুগীর বা শিশুর দেখাশোনা করবার মত কেউ ছিল না | তাই একজন বিহারী মধ্যবয়স্ক, অভিজ্ঞ লোক
রাখতে হয়েছিল | আমাকে খাওয়ানো, নাওয়ানো, পায়ে মালিশ করা সবই ওই লোকটি করতো | ওর নাম ছিল
‘শিলজ’, অদ্ভুত নাম | আমি নাকি অত কঠিন নাম ডাকতে পারতাম না,ডাকতাম ‘এই রে’ বলে | এটাই বা আমাকে
কে শিয়েছিল জানি না | সবাই বলতো লোকটি নাকি খুবই সৎ ও স্নেহ পরায়ন ভাল লোক ছিল | ‘মা বলতেন ওকে
কোন দিন মিথ্যা কথা বলতে শোনেন নি’ | বাড়ীতে অনেক কাজের লোক ছিল, ভালমন্দ, লোভী অলোভী সবই ছিল |
কেউ কিছু চুরি চামারি করলে, শিলজ শুনলে বা দেখতে পেলে, শিলজ নাকি বাধা দিত |সেই জন্য তাকে চোর
অপবাদ নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল| এই টুকু মনে আছে | সেই সময়আমাদের বাইরের ঘরে, বাবার বন্ধু
স্থানীয় অনেক ভদ্রলোক আসতেন | গল্প,গুজব, চা, পান, তামাকে জমজমাটি আসর বসতো |সেদিন সবাই ওই চুরি
নিয়ে নানানজনে নানান কথা বলে চলছিলেন | চুরি নাকি হয়েছিল অনেক পেতলের বাসন| প্রত্যেক বাসনে বাবার নাম
লেখা থাকতো ‘মধুসূদন’ কিন্তু এত সত্বেও সেই বাসন চুরি হয়ে গেল| বাবার শুভাকাঙ্খী ভদ্রলোকেরা খুব উচ্চকন্ঠে
চেঁচামেচি করছিলেন, যেন,কার আগে কে মধুবাবুর শুভার্থী তাই প্রমান করা| বাড়ীর ভেতর থেকে মা,কাকীমারা,
দিদিরা সব শুনতে পাচ্ছিল |তাই বড় হয়ে ব্যাপারটা আমার জানতে অসুবিধা হয়নি |

কেউ কেউ বল্ ছিল এই চোরকে ঘরে রাখা মোটেই উচিত নয় | ইত্যাদি ইত্যাদি | শিলজ আমাকে কোলে করে
(তখন আমার পা একেবারে সেরে গেছে) বাবার পাশে বসিয়ে দিয়ে, বাবার পা দুটো জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কেঁদে
উঠলো বড়বাবু বিস্ওয়াস ক’রেন, এই খুঁকুমনিকে ছুঁয়ে বলছি, হামি চুরি করে নাই |কেউ হামার সাথে দশমনি
করিয়েসে |

বাবা কিছু বলবার আগেই ঘর শুদ্ধ লোক চিত্কার করে উঠেছিল, --বেরিয়ে যাও, তোমার মত লোক এ বাড়ীতে
থাকতে পারবে না | শিলজ কোঁচার খুটে চোখ মুছতে মুছতে চলে গিয়েছিল| আমার কি কান্না, কিছুই বুঝিনা, তবুও
বুঝেছিলাম শিলজকে সবাই মিলে বকছে|

পরে বড় হয়ে পড়াশুনা করে বুঝেছিলাম, যুগে যুগে কতকগুলো খোসামুদে লোক সমাজে প্রতিষ্ঠিত লোকেদের পাশে
ঘুরতো নিজেদের আখের গুছিয়ে নেবার জন্য|এদের কথা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও বলেছিলেন---‘ওই খোসামুদে
লোকগুলির থেকে দুরে থাকতে’| এরা বাবুদের যা বোঝাত বাবুরা তাই বুঝতো| আসলে মানুষ নিজের প্রশংসা
শুনতে ভালবাসে| এই খসামুদে লোকগুলো, অতি দুর্নিতি গ্রস্ত মানুষকেও স্বর্গে উঠিয় দিত প্রশংসা করে|

বাবার মত এতো পর দুঃখে কাতর মানুষটা যে কেন এত অবুঝ হয়ে গিয়েছিলেন জানিনা | দেবতার মত মানুষটা
কিকরে এই মিথ্যা বিচার করলেন? দেবতার ও ভূল হয় ? আমরা বাবার বেশী বয়সের সন্তান, বাবার সাথে দূরত্ব
আমাদের অনেকটাই ছিল | তাই সব কথা প্রশ্ন করবার মত মানসিকতা ছিল না| তবুও এ প্রশ্ন আজও আমার মনে
আসে, কেন এমন হয়? কতদিন দেখেছি কেউ ‘শিলজের’ কথা কিছু বললেই বাবার মুখটা কেমন যেন ব্যাথাহত হয়ে
উঠেছে | পরে নিশ্চই সেই হতভাগ্যের জন্য মমতায় বাবার বুকটা কেঁদে উঠতো গোপনে | মুখে প্রকাশনেই বোধহয়
অপরাধ বোধে ভুগতেন!

তখন অতি ছোট, সব কিছু বোঝবার বয়স হয়নি| হঠাৎ একদিন দেখলাম , অতগুলো কাজের লোক একে একে চলে
যাচ্ছে | জিনিসপত্র, বড়বড় পেতলের বাসনপত্র , যে কোন বাড়ীতে বিয়ে লাগলে আমাদের বাড়ী থেকে বাসন নিয়ে
যেতলোকে | মস্ত বড় কাঠের সিন্দুক ভর্ত্তি বাসন | পেতলের জল খাবার গ্লাস,ছোট ছোট পাটির আসন শতে, শতে,
সমস্তই নেমন্তন্ন বাড়ীর উপযুক্ত | বড় বড় কড়াই লোহার, পেতলের গামলা, পরাত, এগুলো বড় থেকে ছোট পর্যন্ত
একটার ভেতর আর একটা বাসন থাকতো | দশ, বারোটা করে হবে | এতো বড় কড়াই, আর গামলা যে একটা পর্ণ
বয়স্ক মানুষ ওই গামলায় বসে স্নান করতে পারে | এ সমস্তই আমার মায়ের শখের জিনিস| বড় নৌকোয় করে
দিনবাজার থেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়ে আসতো, আমাদের ম্যানেজার মনোরঞ্জনবাবু আর আমাদের হেড কুক
কাকা ঠাকুর | এই সমস্ত জিনিস, সমস্ত ফার্নিচার সব গরুর গাড়ীতে পাচার হয়ে যাচ্ছেজলপাইগুড়ি শহর থেকে তিন
সারেতিন মাইল দূরে, পান্ডাপাড়াতে আমাদের বাগান বাড়ীতে|

শহরের বাড়ীছেরে আমাদের চলে আসতে হলো বাগান বাড়ী গ্রামের দিকে| চিড়িয়াখানার কি হলো বুঝলাম না|
ক্যানারিজ পাখীগুলো বাবা যখন খাঁচার দরজা খুলে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তখন আমি অধীর আগ্রহে বাবার পাশে
দাঁড়িয়ে ছিলাম |

বাবা মুখে বলছেন --‘যা তোদের এতদিন বন্দী করে রেখেছিলাম, আজ তোরা মুক্ত,যা যেখানে খুশী চলে যা’| বাবা
বড় হাতায়ালা গেঞ্জি পরতেন| মাঝে মাঝে চোখের সামনে গেঞ্জিপরা হাতটা চলে আসছে, আর মুখটা ঘুড়িয়ে
চোখদুটো মুছে নিচ্ছেন| আমি অবাক বিস্ময়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, ও,মা--এ্যাত বড় মানুষ
আবার কাঁদে নাকি! আর ওগুলোর কি হলো জানিনা| সেই ময়াল সাপটা? আর ময়ূর ময়ূরীগুলো? আরও যে
কতকিছু ছিল আজ আর মনে নেই|

আমাদের একটা গাড়ী ছিল| খুব ভাল মানুষ সুশীলদা ছিলেন ড্রাইভার| পরে আর ওঁকে দেখিনি| সেই গাড়ীটার কি
হলো জানিনা| আমরা বাড়ীর ঘোড়ার গাড়ীতে করে বাগান বাড়ীতে চলে এলাম| এটুকু মনে আছে ‘মা’ মাঝে মাঝে
‘ফিট’ হয়ে যাচ্ছিলেন| দিদিরা সামলেছিলেন মাকে| তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পরিনতিরমুখে| পরে বড় হয়ে
শুনেছিলাম আমাদের বাড়ীটা ৮০হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল|

বাবার ভালমানুষী আর বন্ধুপ্রীতি-ই এই পরিনতির কারণ| বাবার নামে দোকান থেকে জিনিস নিয়ে সেগুলো আর
কেউ শোধ দিত না, বাবা ও চক্ষুলজ্জার খাতিরে টাকা চাইতে পারতেন না| এই ভাবে আমাদের একটা জুতার
দোকান ছিল শহরের মধ্যস্থলে ‘জুতাঘর’নাম ছিল, বাটা কোম্পানীর জুতোই বেশী বিক্রি হতো|এই দোকানে পার্টনার
শিপে দুজন ছিলেন, তাঁদের সাথে মামলা হয়, তারপর দোকানটা হাতবদল হয়ে গেল| সবাই বাবার ভাল মানুষীর
সুযোগ নিয়েছিল| কেউ এসে কেঁদে পরলেই, বাবার কোন হিসাব নিকাশ, ভূত,ভবিয্যতের চিন্তা থাকতো না| সুযোগ
সন্ধানী মানুষ! সেত সুযোগ নেবেই| তখন বাবাকে বোঝানরও কেউ নেই | আমাদের সংসারের কান্ডারী রাঙ্গাকাকা
হঠাৎ চলে গেলেন| সাধের সংসার ফেলে রেখেমনে হয় বাবার মনে একটা শ্মশান বৈরাগ্য ভাব দেখা গিয়েছিল| ভীষন
ভালবাসতেন ভাইদের |

যখন অভাবের চরমতম অবস্থায় পৌঁছেছিলাম, তখনও অতিথি অভ্যাগতের আগমনের কিছু কম ছিল না |
বাগানবাড়ীটা আমাদের দেঢ় বিঘা জমির উপর | তারপরেও বিঘা খানেক জমি ছিল , সেখানে তরিতরকারী ফসল
হতো | তখনও বিশ, পঁচিশটা পাত পরতো দুইবেলা | কি করে সংসার চলতো জানিনা | আমাদের গড়ালবাড়ীর
জমির ধানই তখন বাঁচবার মূলধন ছিল| সুরু হলো দেশভাগ, হিন্দুস্থান-পাকিস্থান | ভারত স্বাধীন হলো, স্বাধীনতার
ফসল স্বরূপ একটা জাতি উত্পন্ন হলো, নাম তার ‘উদ্বাস্ত্ত’| সবহারানর দল |আমাদের আত্মীয়রা পূর্ব্ববঙ্গ থেকে
আসতে লাগলেন, চরম হতাসা আর অপমানের মধ্যদিয়ে,সাজান সংসার ফেলে রেখে,নিঃস্বম্বল হয়ে পরের সংসারের
বোঝা হয়ে| এই মাথা নিচু করে থাকা, এই লজ্জা, এই গ্লানি অপমান, অ-সহনিয়| বাবার কড়া হুকুম ছিল কোন মতেই,
ছেলেমেয়েদের খেলাছলেই হোক, বা বড়দের কোন ব্যবহারে আত্মীয়রা যেন দুঃখ না পান | সবাই কেই সামান
ভালবাসা দিয়ে আপন করে নাও| এই দুঃখী জনদের সব হারানোর ব্যাথা ঘুচিয়ে দাও| তাতো সম্ভব নয়! সবাই
মিলেমিশে থাকো |

সেই অভাবের সময় দাদা একটা পুরানো ট্রাঙ্ক খুলে একতাড়া হ্যান্ডনোট বের করে বাবাকে দেখায়, এবং বলে তুমি
এদের কাছে চিঠি লিখে টাকা ফেরত চাও | প্রায় ১০হাজার টাকার মত হ্যান্ডনোট |’এখন প্রায় ১ লাখ টাকার মত
হবে, তাতে সংসারের অভাব কিছুটা মিটবে’বাবা আমাকে বললেন একটা দেশলাই নিয়ে আয়তো? বাবা দাদাকে
কিছু বললেন না| কাগজগুলো এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে কাগজগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিলেন | দাদা চিত্কার করে
উঠলো--একি হ’লো? বাবা নির্বিকার মুখে বললেন --ওরা যদি টাকা ফেরতই দিতে পারতো, তবে এতদিন প’রে
থাকতো না| সবাই অভাবি, থাক্ এ টাকার আর দরকার নেই| এই হ’লেন আমাদের বাবা, বিপদতারণ মধুসূদন!

এখন যে ঘটনাটা বলবো, আমি বেশ বড় হয়ে গেছি ১৭-১৮ বছর বয়স| আমাদের বাবা যে কতটা আধুনিক ও
উদারচেতা ছিল সে পরিচয়ও আমরা পেযেছি | জলপাইগুড়িতে সেই সময় ছেলেমেয়ে উভয়কেই রাইফেল স্যুটিং
শেখান হতো | রবিবার করে | সময়টা ১৯৫৪ কি ‘৫৫হবে | শহরের বড় বড় নাম করা ভদ্রলোকেদের ব্যবস্থাপনায় |
একদিন বাবা আমাকে আর ছোট বোন ঝর্নাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে ভর্ত্তি করে দিলেন, রাইফেল স্যুটিং ক্লাবে |
পিলখানার মাঠে তিস্তানদীর ধারে রাইফেল স্যুটিং করতো পুলিশেরা |সেখানেই আমাদের ১২/১৪জন ছেলেমেয়েদের
প্র্যাকটিস হতো|রবিবার বাবা ভোর ৫টায় আমাদের সাথে করে নিয়ে যেতেন| আমরা হেঁটেই যেতাম|সেখানেই বাবা
বসে থাকতেন, তারপর আমাদের প্র্যাকটিস শেষ হলে সাথে করে নিয়ে আসতেন| কয়েক রবিবার বাবার সাথে
গিয়েছি, তারপর নিজেরাই চলে আসতাম,যেতাম| ১বছর পর কম্পিটিশন হয়| ছেলেমেয়ে একসাথে|সবার ভেতর
আমার ছোট বোন ফার্ষ্ট হয়েছিল| ব্যবস্থাপনায় যারা ছিলেন তাঁদের ভেতর নসু নিয়োগী ডিক্লেয়ার করেছিলেন যে
ফার্ষ্ট হবে তাকে একটা ২.২ বোর রাইফেল দেওয়া হবে |কথা রেখেছিলেন তিনি |ঝর্নাকে রাইফেল তো দিয়েছিলেন,
সেই সাথে লাইসেন্স ও করিয়ে দেন|নসুনিয়োগী ভাল বাঘ শিকারী ছিলেন|খুব নাম ছিল বাঘ শিকারে|

বাবা আমাদের যে কোন কাজেই উত্সাহ দিতেন, বলতেন, কোন কাজেই ছোট নয়| পুরুষালী কাজ যেম, ক্ষেতের
কাজ, কফি, আলুর ক্ষেতে কাজ করা, নিড়ানি করা,জল পরিস্কার করা ও গাছের গোড়ায় জল দেওয়া ইত্যাদি| কুড়ুল
দিয়ে কাঠও চেরাই করেছি আমরা, রান্নার জন্য| তখন ও সব কাজে মেয়েদের খুব বদনাম হতো|

এখন যেমন মেয়েদের কোন কাজে কোন বাধাই নেই, তখন প্রতি পদে পদে বাধা আসতো|

"কালাপানি"-র নামে এই কিছুদিন আগে পর্যন্তওলোকে ভয়ে শিউরে উঠতো| সেখানে গেলে আর কেউ ফেরে না, এমনি
একটা প্রবাদ ছিল | আন্দামান কেউ বলতো না| কালাপানির দেশ-ই বলতো| স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আন্দামানের
সেলুলার জেলে নিয়ে গেলে, ফিরে এসেছিল মুষ্টিমেয় কয়েকজন | এই সব কারনেই মানুষ ভয় পেত |

সেখানে আমার বিয়ের সম্বন্ধ হয় এবং বিয়েও হয়ে যায় | জলপাইগুড়িতে যারাই শুনেছিল মধুবাবুর মেয়ের বিয়ে
কালাপানিতে, তারাই বাড়ীতে এসে বাবাকে বারন করে যান| মেয়েকে আর ফিরে পাবেন না বলে |

অজানাকে জানবার এবং ভয়কে জয় করবার এক অসীম শক্তিবাবার ভেতর ছিল|বাবা শুভার্থীদের বলেছিলেন -
‘এটাতো আমার মেয়ের সৌভাগ্য যে, যেখানে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ছিলেন, সেই জায়গা ও দেখতে পাবে’|

কিন্তু যতই দুর্দূমনিয় মনোভাব হোকনা কেন! পিতা তো বটেই-ই! অত দূরে মেয়েকে বিদায় দিতে, মমতায়ভরা
পিতৃহৃদয় নিশ্চয় কেঁপে উঠেছিল| নইলে যখন আমরা রওনা হয়ে চলে আসি জলপাইগুড়ি থেকে, কলকাতায় জাহাজে
চড়ে আন্দামান যাব বলে| জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে ট্রেন প্রায় ছারে ছারে সবাই চোখের জলে বিদায় জানাচ্ছে, আমার
বুকটা অভিমানে ভরে উঠ্ ছে, বাবা একবারও এলেন না| হঠাৎ দেখি বাবা, আমদের পূজোর ঠাকুর মশাইকে
(আমরা ঠাকুরদা বলে ডাকতাম) নিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে আমার হাতে বাঘের ‘লাকিবোন্’ দিয়ে বললেন -
সাবধানে রাখিস সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাবি |তারমানে মেয়েকে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বেঁধে রেখে গেলেন|

এই আমাদের বাবা | আমরা মোট ১০ ভাইবোন ছিলাম| ২ ভাইবোন বাদ দিলে ৭ বোন ১ ভাই (দাদা) ছিলাম| বাবার
সবার প্রতি সমান স্নেহ মায়া মমতা ছিল| বাবা যখন চলে যান ৮০ বছর বয়স| বাবার মুখে একটু গঙ্গা জল দিতে
হিন্দু-মুসলমান কেউ বাদ ছিল না| সবাই বাবাকে এত ভালবাসতো|

বাবার কথা যতটুকু জানি বলেছি| স্নেহে মমতায় উদার হৃদয়, অপূর্ব এক মানুষ, দেবতার আসনে যাঁকে বসান যায়|
এমন এক পিতৃদেব পেয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করি| জন্মান্তর বলে যদি কিছু তাকে , তবে য়েন এই বাবা মা
এর কোলেই আবার ফিরে ফিরে আসি |

‘ধরনী যাদের ধরিতে না চায়, দেবতা ফিরায় মুখ | তাদের-ই লাগিয়া মমতায় ভরা, শুধু মানুষের-ই বুক’ ||

পরিশেষে কৃতজ্ঞতা জানাই আমার প্রথম পুত্র মিলনকে, ওর আগ্রহ ও উদ্যোগ না থাকলে এই স্মৃতিচারণ আমার
মনের গহনে গোপনেই থেকে যেত | আমার স্বামী আন্দামান থেকে চাকুরিতে রিটায়ার করে জলপাইগুড়িতে বাড়ি
করেন | মিলন নিজের পিতার অবর্ত্তমানে সেই বাড়িতে দাদুর স্মৃতি রক্ষার্থে “মধুসূদন স্মৃতি ক্যান্সার সোসাইটি”
আরম্ভ করে, এতে বহু অসুস্থ মানুষ উপকৃত হন| মিলন এই ভাবেই দাদুর পরোপকারিতাটাকে বজায়রেখে দাদুর
প্রতি স্মৃতিতর্পণ করে চলেছে |

দীপালী সেনগুপ্ত
মধুসূদন দাশগুপ্তর তৃতীয়া কন্যা,
কলকাতা,


                                            ************************

.                     
.                                                                                                                      উপরে  



লেখকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করুন তাঁর এই ঠিকানায় ---
দীপালী সেনগুপ্ত,
প্রযত্নে শ্রীমতী সাগরিকা সেনগুপ্ত,
২০ লেক ইস্ট সেকেণ্ড রোড,
কলকাতা ৭০০০৭৫,


মিলনসাগর
মধুবাবুর পরিচিতির পাতা
মধুবাবু নানা চোখে
আমার বাবা-দীপালী সেনগুপ্ত - দীপালী সেনগুপ্ত
মধুবাবুর লক্ষ্মীর ধামের ইতিবৃত্ত - দীপালী সেনগুপ্ত
আদরের বাবা - পান্না গুপ্তা
আমাদের প্রিয় বাবা-পর্ণা দাশগুপ্ত