*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

ভাঙা বাঙলার রাঙা যুগের আদি পুরোহিত সাগ্নিক বীর
শ্রী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ    


অগ্নি ঋষি! অগ্নি-বীণা তোমায় শুধু সাজে |
তাই ত তোমার বহ্নি-রাগেও বেদন-বেহাগ বাজে ||
.        দহন বনের গহন-চারী ---
.        হায় ঋষি --- কোন বংশীধারী
.        নিংড়ে আগুন আনলে বারি
.                   অগ্নি-মরুর মাঝে |
সর্ব্বনাশা কোন্ বাঁশী সে বুঝতে পারি না যে ||


দুর্ব্বাসা হে! রুদ্র তড়িৎ হানছিলে বৈশাখে
হঠাৎ সে কার শুনলে বেনু কদম্বের ঐ শাখে |
.         বজ্রে তোমার বাজল বাঁশী,
.         বহ্নি হ'ল কান্না হাসি,
.         সুরের ব্যথায় প্রাণ উদাসী
.                     মন সরে না কাজে
তোমার নয়ন ঝুরা অগ্নি-সুরেও রক্ত-শিখা রাজে ||


.                   **************



.                                                             
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর "অগ্নিবীণা"
থেকে কয়েকটি কবিতা
 
...
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বই "অগ্নিবীণা" প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৯ বঙ্গাব্দের
কার্তিক মাসে অর্থাৎ ১৯২২ খৃষ্টাব্দে | বইটির প্রকাশক ছিলেন আর্য পাবলিশিং হাউস |  কবির বিখ্যাত
"বিদ্রোহী" কবিতাটি "অগ্নিবীণা" প্রথম প্রকাশের কিছুকাল আগে (সম্ভবত মাস দুই) "মোসলেম ভারত" মাসিক
পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় | তখন রবীন্দ্রনাথ প্রখর সূর্যের মত বাংলার কাব্যাকাশে বিরাজ করছেন |
সেই তীব্র আলোকিত আকাশে ধূমকেতুর মত উত্থান করলেন নজরল, "অগ্নিবীণা" কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে |
"বঙ্গবাণী", "প্রবাসী", প্রভৃতি সেই সময়কার পত্র-পত্রিকাতে চোখ বুলালেই বোঝা যায়, নজরুলের এই
কবিতাগুচ্ছ কতটা আলোড়ণ সৃষ্টি করেছিল | "অগ্নিবীণা"-র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদের পরিকল্পনা
করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এঁকেছিলেন শিল্পী বীরেশ্বর সেন | বইটির বর্তমান প্রকাশক ডি.এম.
লাইব্রেরী, ৪২ বিধান সরণী, কলকাতা-৭০০০০৬ |

www.milansagar.com
...
OOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOOO
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

.          প্রলয়োল্লাস    


.         তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
.         তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখীর ঝড় !
.         তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
.         তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!


আসছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য-পাগল,
সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল !
.          মৃত্যু-গহন অন্ধকূপে
.          মহাকালের চণ্ড-রূপে---
বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ঙ্কর !
.                     ওরে ঐ হাসছে ভয়ঙ্কর !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!


ঝামর তাহার কেশের দোলার ঝাপটা মেরে গগন দুলায়,
সর্ব্বনাশী জ্বালা-মুখী ধূমকেতু তার চামর ঢুলায় !
.         বিশ্বপাতার বক্ষ-কোলে
.         রক্ত তাহার কৃপাণ ঝোলে
.                      দোদুল দোলে !
অট্টরোলের হট্টোগোলে স্তব্ধ চরাচর---
.                      ওরে ঐ স্তব্ধ চরাচর !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!


দ্বাদশ-রবির বহ্নি-জ্বালা ভয়াল তাহার নয়ন-কটায়,
দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গ তার ত্রস্ত জটায় !
.          বিন্দু তাহার নয়ন-জলে
.          সপ্ত মহা-সিন্ধু দোলে
.                       কপোল-তলে !
বিশ্ব-মায়ের আসন তারি বিপুল বাহুর 'পর---
.                       হাঁকে ঐ "জয় প্রলয়ঙ্কর !"
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!


মাভৈঃ মাভৈঃ !  জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে !
জরায় মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ-লুকানো ঐ বিনাশে !
.          এবার মহা-নিশার শেষে
.          আসবে ঊষা অরুণ হেসে
.                        করুণ বেশে |  
দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশু চাঁদের কর,
.                        আলো তার ভরবে এবার ঘর !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!  


ঐ যে মহাকাল সারথি রক্ত-তড়িত চাবুক হানে,
রণিয়ে ওঠে হ্রেষার কাঁদন বজ্র-গানে ঝড় তুফানে !
ক্ষুরের দাপট তারায় লেগে উল্কা ছুটায় নীল খিলানে |
.           গগন-তলের নীল খিলানে !
.           অন্ধ কারার অন্ধ কূপে
.           দেবতা বাঁধা যজ্ঞ-যূপে
.                         পাষাণ-স্তূপে !
এই ত রে তার আসার সময় ঐ রথ-ঘর্ঘর---
.                         শোনা যায় ঐ রথ-ঘর্ঘর !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!


ধ্বংশ দেখে ভয় কেন তোর ? --- প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন |
আসছে নবীন---জীবন-হারা অ-সুন্দরে করতে ছেদন |
.          তাই সে এমন কেশে বেশে
.          প্রলয় ব'য়েও আসছে হেসে---
.                          মধুর হেসে !
ভেঙে আবার গ'ড়তে জানে সে চির-সুন্দর !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!


ঐ ভাঙা-গড়া খেলা যে তার কিসের তরে ডর ?
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !---
.          বধূরা প্রদীপ তুলে ধর !
কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর !---
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
.          তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !

.                  **************



.                                                             
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

.            বিদ্রোহী     


.                       বল বীর---
.            বল উন্নত মম শির !
শির        নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর !
.                       বল বীর---
বল         মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
.            চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
.            ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
.            খোদার আসন "আরশ" ছেদিয়া
.                     উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর !
মম         ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর !
.                       বল বীর---
.            আমি চির-উন্নত শির !


আমি       চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-        প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি       মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর !
.                       আমি দুর্ব্বার,
আমি       ভেঙে করি সব চুরমার !
আমি       অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি       দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল !
আমি       মানি নাকো কোনো আইন,
আমি       ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
.                                                 ভাসমান মাইন !
আমি       ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর !
আমি       বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর !
.                         বল বীর---
.                   চির উন্নত মম শির !


আমি        ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী,
আমি        পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী !
আমি        নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি        আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ |
আমি        হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি        চল-চঞ্চল, ঠুমকি' ছমকি'
.             পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি'
.             ফিং দিয়া দিই তিন দোল্ !
আমি        চপলা-চপল হিন্দোল !

আমি        তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা',
করি         শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পঞ্জা,
.             আমি উদ্দাম, আমি ঝঞ্ঝা !
আমি        মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর |
আমি        শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর |
.                           বল বীর---
.             আমি        চির-উন্নত শির !


.             আমি       চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ,
আমি        দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্
.                                           ভরপুর মদ |
আমি        হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি,
আমি        যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি !
আমি        সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি        অবসান, নিশাবসান |
আমি        ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য,
মম          এক হাতে-বাঁকা ভাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য |
আমি        কৃষ্ণ-কণ্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির |
আমি        ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর |
.                            বল বীর---
.                       চির উন্নত মম শির |


আমি        সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক
আমি        যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক !
আমি        বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি        আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ !
আমি        বজ্র, আমি ঈশাণ-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি        ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি        পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দণ্ড,
আমি        চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচণ্ড !
আমি        ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি        দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব !
আমি        প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস,--- আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি        মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস !
আমি        কভু প্রশান্ত,--- কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি        অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী !
আমি        প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি        উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি        উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল !


আমি        বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি        ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি |
আমি        উন্মন মন উদাসীর,
আমি        বিধাতার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর !
আমি        বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহারা যত পথিকের,
আমি        অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত
.                                                   বুকে গতি ফের !
আমি        অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত-        চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর !
আমি        গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক'রে দেখা অনুখন,
আমি        চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্ |
আমি        চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি        যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর !
আমি        উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া,
আমি        পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া!
আমি        আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি,
আমি        মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!---
আমি        তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি        সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে
.                                                      সব বাঁধ !


আমি         উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি         বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন !
ছুটি           ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
.               স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে,
.               তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার
.                                    হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে !
আমি          বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি          পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল !
আমি          তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আণি          ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প !
.               ধরি বাসুকির ফণা জাপটি',---
ধরি            স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি' !
.                আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি           ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল !


.                          আমি    অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
.                          মহা-     সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্
.                 ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্
.                 মম বাঁশরী তানে পাশরি'
.                 আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী |
আমি            রুষে উঠে' যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে             সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া !
আমি            বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া !


আমি            প্লাবন-বন্যা,
কভু              ধরণীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা---
আমি            ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা !
আমি            অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি            ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি !
আমি            ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি            জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি !


আমি            মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি            অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয় !
আমি            মানব দানব দেবতার ভয়,
.                  বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়,
.                  জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি             তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য
আমি             উন্মাদ, আমি উন্মাদ !!
আমি             চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে
.                                                        সব বাঁধ !!
আমি             পরশুরামের কঠোর কুঠার,
.                  নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার !
আমি             হল বলরাম স্কন্ধে,
আমি             উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে |



.                  মহা-    বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
.                  আমি    সেই দিন হব শান্ত,
যবে              উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাশে ধ্বনিবে না,
.                  অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে কণিবে না---
.                            বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
.                 আমি     আমি সেই দিন হব শান্ত !
আমি            বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি            স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন !
আমি            বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন !
.                 আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন !

.                 আমি চির-বিদ্রোহী বীর---
আমি            বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির !

.                             **************



.                                                             
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

রক্তাম্বর-ধারিণী মা

রক্তাম্বর পর মা এবার
.         জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন |
দেখি ঐ কার সাজে মা কেমন
.         বাজে তরবারি ঝনন্-ঝন্ |
সিঁথির শিঁদুর মুছে ফেল মা গো,
.         জ্বাল সেথা জ্বাল কাল-চিতা |
তোমার খড়গ-র্কত হউক
.         স্রষ্টার বুকে লাল ফিতা |
এলোকেশে তব দুলুক ঝঞ্ঝা
.         কাল-বৈশাখী ভীম তুফান,
চরণ-আঘাতে উদ্গারে যেন
.         আহত বিশ্ব রক্ত-বান |
নিঃশ্বাসে তব পেঁজা-তুলো সম
.         উড়ে যাক মা গো এই ভূবন,
অ-সুরে নাশিতে হউক বিষ্ণু-
.         চক্র মা তোর হেম কাঁকন !
টুঁটি টিপে মারো অত্যাচারে মা,
.         গল-হার হোক নীল-ফাঁসি,
নয়নে তোমার ধূমকেতু-জ্বালা,
.         উঠুক সরোষে উদ্ভাসি' |
হাস খল খল, দাও করতালি,
.         বল হর হর শঙ্কর!
আজ হ'তে মা গো অসহায় সম
.         ক্ষীণ ক্রন্দন সম্বর
মেখলা ছিঁড়িয়া চাবুক কর মা,
.         সে চাবুক কর নভ-তড়িৎ,
জালিমের বুক বেয়ে খুন ঝ'রে
.         লালে লাল হোক শ্বেত হরিৎ |
নিদ্রিত শিবে লাথি মার আজ,
.         ভাঙো মা ভোলার ভাঙ-নেশা,
পিয়াও এবার অশিব গরল
.         নীলের সঙ্গে লাল-মেশা |
দেখা মা আবার দনুজ-দলনী
.         অশিব-নাশিনী চণ্ডী-রূপ ;
দেখাও মা ঐ কল্যাণ করই
.         আনিতে পারে কি বিনাশ-স্তূপ |
শ্বেত শতদল-বাসিনী নয় আজ
.         রক্তাম্বর-ধারিণী মা,
ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর
.         সৃষ্টির নব পূর্ণিমা!


.             **************



.                                                        
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

খেয়া-পারের তরণী

যাত্রীরা রাত্তিরে হ'তে এল খেয়া পার,
বজ্রেরি তুর্য্যে এ গর্জ্জেছে কে আবার ?
প্রলয়েরি আহ্বান ধ্বনিল কে বিষাণে
ঝঞ্ঝা ও ঘন দেয়া স্বনিল রে ঈশানে!

নাচে পাপ-সিন্ধুতে তুঙ্গ তরঙ্গ!
মৃত্যুর মহানিশা রুদ্র উলঙ্গ!
নিঃশেষে নিশাচর গ্রাসে মহাবিশ্বে,
ত্রাসে কাঁপে তরণীর পাপী যত নিঃস্বে!

তমসাবৃতা ঘোরা "কিয়ামত" রাত্রি,
খেয়া-পারে আশা নাই ডুবিল রে যাত্রী
দমকি দমকি দেয়া হাঁকে কাঁপে দামিনী,
শিঙ্গার হুঙ্কারে থর থর যামিনী!

লঙ্ঘি এ সিন্ধুরে প্রলয়ের নৃত্যে
ওগো কার তরী ধায় নির্ভিক চিত্তে---
অবহেলি ' জলধির ভৈরব গর্জ্জন
প্রলয়ের ডঙ্কার ওঙ্কার তর্জ্জন!

পুণ্য পথের এ যে যাত্রীরা নিষ্পাপ,
ধর্ম্মেরি বর্ম্মে সু-রক্ষিত দিল্-সাফ!
নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতে ও
কাণ্ডারী আহমদ তরী ভরা পাথেয়!

আবুবকর্ উসমান উমর আলী হায়দর
দাঁড়ী যে তরুণীর, নাই ওরে নাই ডর!
কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,
দাঁড়ী মুখে সারি গান --- লা শরীক আল্লাহঃ!

"শাফায়ত্"-পাল-বাঁধা তরণীর মাস্তুল,
"জান্নৎ" হ'তে ফেলে হুরী রাশ্ রাশ্ ফুল!
শিরে নত স্নেহ-আঁখি মঙ্গল-দাত্রী,
গাও জোরে সারি-গান ও-পারের যাত্রী!
বৃথা ত্রাসে প্রলয়ের সিন্ধু ও দেয়া-ভার,
ঐ হ'লো পুণ্যের যাত্রীরা খেয়া পার |   


.             **************



.                                                        
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

        ধূমকেতু

আমি     যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
.           এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
সাত---    সাত শ' নরক-জ্বালা জ্বলে মম ললাটে,
মম        ধূম-কুণ্ডলী ক'রেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘন ঘোলাটে!
আমি      অশিব তিক্ত অভিশাপ,
আমি      স্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ-হাহাকার---
.           আর     মর্ত্তে সাহারা-গোবী ছাপ,
.           আমি    অশিব তিক্ত অভিশাপ!


আমি     সর্ব্বনাশের ঝাণ্ডা উড়ায়ে বোঁও বোঁও ঘুরি শূণ্যে,
আমি     বিষ-ধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান-অভিমুন্যে |
শোঁও     শন-নন-নন শন-নন-নন শাঁই শাঁই,
.          ঘুর্     পাক্ খাই, ধাই পাঁই পাঁই,
.          মম     পুচ্ছে জড়ায়ে সৃষ্টি ;
.          করি'    উল্কা-অশনি-বৃষ্টি, ---
আমি     একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি |
আমি     অপঘাত দুর্দ্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি!


আমি     আপনার বিষ-জ্বালা মদ-পিয়া মোচড় খাইয়া খাইয়া
.          জোর বুঁদ হ'য়ে আমি চ'লেছি ধাইয়া ভাইয়া!
.          শুনি'     মম বিষাক্ত, "রিরিরিরি"-নাদ
শোনায়   দ্বিরেফ-গুঞ্জন সম বিশ্ব ঘোরার প্রণব নিনাদ!
.          মম      ধূর্জ্জটী-শিখ করাল পুচ্ছে
দশ       অবতারে বেঁধে ঝ্যাটা ক'রে ঘোরাই উচ্চে, ঘুরাই---
.          আমি     অগ্নি কেতন উড়াই! ---
আমি     যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
.          এই     স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!


ঐ         বামন বিধি সে আমারে ধরিতে বাড়ায়েছিল রে হাত
মম        অগ্নি-দাহনে জ্ব'লে পুড়ে তাই ঠুঁটো সে জগন্নাথ!
আমি      জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী,
তাই       বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি |
আমি      জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা' হয়নি হবে তা'ও!
তাই       বিপ্লব হানি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তা'ও!
তোর      নিযুত নরকে ফুঁ দিয়ে নিবাই, মৃত্যুর মুখে থুতু দি'!
আর       যে যত রাগে রে তারে তত কাল্-আগুনের কাতুকুতু দি'!
মম        তুরীয় লোকের তির্যক-গতি তূর্য্য-গাজন বাজায়!
মম        বিষ-নিঃশ্বাসে মারীভয় হানে অরাজক যত রাজায়!


কচি       শিশু-রসনায় ধানী-লঙ্কার পোড়া ঝাল
আর       বদ্ধ কারায় গন্ধক ঘোঁয়া, এসিড, পটাস, মোনছাল,
আর       কাঁচা কলিজায় পচা ঘা'র সম সৃষ্টিরে আমি দাহ করি
.           আর স্রষ্টারে আমি চুষে খাই!
পেলে      বাহান্ন-শও জাহান্নামেও আধা চুমুকে সে শুষে যাই!


আমি      যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
.           এই     স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!


আমি      শি শি শি প্রলয়-শিশ্ দিয়ে ঘুরি কৃতিঘ্নী
.                                             ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি,
আমি      ত্রিভুবন তার পোড়ায়ে মারিয়া আমিই করিব মুখাগ্নি!
তাই       আমি ঘোর তিক্ত সুখে রে, একপাক ঘু'রে বোঁও করে
.                                             ফের দু'পাক নি'!
.           কৃতিঘ্নী আমি কৃতিঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি!
.           পঞ্জর মম খর্পরে জ্বলে নিদারুণ যেই বৈশ্বানর---
.                              শোন্ রো মর, শোন্ অমর! ---
.       সে যে তোদের ঐ বিশ্বপিতার চিতা!
এ চিতাগ্নিতে জগদীশ্বর পুড়ে ছাই হবে, হে সৃষ্টি জান কি তা ?
কি বল ? কি বল ? ফের বল ভাই আমি শয়তান-মিতা!
হো হো ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালিয়েছি বুকে চিতা!
.        ছোট শন শন শন ঘর ঘর ঘর সাঁই সাঁই!
.                                    ছোট পাঁই পাঁই |  
তুই     অভিশাপ তুই শয়তান তোর অনন্তকাল পরমাই!
.         ওরে ভয় নাই তোর মার নাই !!
.         তুই প্রলয়ঙ্কর ধূমকেতু!


আমি      যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
.           এই     স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!


ঐ          ঈশ্বর-শির উল্লঙ্ঘিতে আমি আগুনের সিড়ি,
আমি      বসিব বলিয়া পেতেছি ভবানী ব্রহ্মার বুকে পিঁড়ি!
ক্ষ্যাপা     মহেশের বিক্ষিপ্ত পিনাক, দেবরাজ-দম্ভোলি
লোকে     বলে মোরে, শুনে হাসি আমি আর নাচি বব-বম্ বলি!
এই         শিখায় আমার নিযুত ত্রিশূল বাশুলি বজ্র-ছড়ি
ওরে       ছড়ানো র’য়েছে, কত যায় গড়াগড়ি!
মহা        সিংহাসনে সে কাঁপিছে বিশ্ব-সম্রাট নিরবধি,
তার        ললাটে তপ্ত অভিশাপ ছাপ এঁকে দিই আমি যদি!
তাই        টিটকিরি দিয়ে হাহা হেসে উঠি,
সে হাসি গুমরি লুটায়ে পরে রে তুফান ঝঞ্ঝা সাইক্লোনে টুটি’ !


আমি       বাজাই আকাশে তালি দিয়া “তাতা-উর্ তাক্” |
আর        সোঁও সোঁও করে প্যাঁচ দিয়ে খাই চিলে-ঘুড়ি সম ঘুরপাক!
মম         নিঃশ্বাস আভাসে অগ্নি-গিরির বুক ফেটে উঠে ঘুত্কারপ
আর       পুচ্ছে আমার কোটি নাগ-শিশু উদ্গারে বিষ-ফুত্কার!
কাল        বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার
.            তখনি রক্ত শোষে না রে তার,
.            দৃষ্টি-সীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্রচণ্ড সুখে
.            পুচ্ছ সাপটি’ খেলা করে আর শিকার মরে সে ধুঁকে!
.             তেমনি করিয়া ভগবানে আমি
.             দৃষ্টি-সীমায় রাখি দিবাযামী
ঘিরিয়া ঘিরিয়া খেলিতেছি খেলা, হাসি’ পিশাচের হাসি
এই          অগ্নি-বাঘিনী আমি সে সর্ব্বনাশী!


আজ        রক্ত মাতাল উল্লাসে মাতি রে---
মম          পুচ্ছে ঠিকরে দশগুণ ভাতি,
.             রক্ত-রুদ্র উল্লাসে মাতি রে!
ভগবান্ ?    সে ত হাতের শিকার!--- মুখে ফেনা উঠে মরে!
ভয়ে         কাঁপিছে, কখন পড়ি গিয়া তার আহত বুকের প’রে!
.       অথবা যেন রে অসহায় এক শিশুরে ঘিরিয়া
.       অজগর কাল কেউটা সে কোনা ফিরিয়া ফিরিয়া
.             চায়, আর ঘোরে শন্ শন্ শন্,
.       ভয় বিহ্বল শিশু তার মাঝে কাঁপে রে যেমন---
.             তেমনি করিয়া ভগবানে ঘিরে
.       ধূমকেতু-কালনাগ অভিশাপ ছুটে চলেছি রে ;
.             আর সাপে-ঘেরা অসহায় শিশু সম
.       বিধাতা তোদের কাঁপিছে রুদ্র ঘুর্ণীর মাঝে মম!
.       আজিও ব্যথিত সৃষ্টির বুকে ভগবান কাঁদে ত্রাসে,
.       স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্ট পাছে বা বড় হ’য়ে তারে গ্রাসে!   


.                          **************



.                                                        
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

      শাত্-ইল্-আরব

শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর |
শহীদের লোহু, দিলীরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর!
.              যুঝেছে এখানে তুর্ক-সেনানী,
.              য়ুনানী, মেসরী, আরবী, কেনানী ; ---
লুটেছে এখানে মুক্ত আজাদ্ বেদূঈনদের চাঙ্গা শির!
.                                            নাঙ্গা-শির্---
শমশের হাতে আঁশু-আঁখে হেথা মূর্ত্তি দেখেছি বীর-নারীর!
শাতিল্ আরব! শাতিল আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর |


.               “কূত্-আমারা”র রক্তে ভরিয়া
.                দজ্লা এনেছে লোহুর দরিয়া ;
উগরি’ সে খুন তোমাতে দজ্লা নাচে ভৈরব মাস্তানী’র
.                                                 ত্রস্তা-নীর
গর্জ্জে রক্ত-গঙ্গা ফোরাত, --- “ শাস্তি দিয়েছি গোস্তাখীর!”
দজ্লা-ফোরাত-বাহিনী শাতিল্! পূত যুগে যুগে তোমার তীর!


.                 বহায়ে তোমার লোহিত বন্যা
.                 ইরাক্ আজমে ক’রেছ ধন্যা,
বীর-প্রসূ দেশ হ’ল বরেণ্যা মরিয়া মরণ মর্দ্দমীর!
.                                            মর্দ্দ বীর
সাহারায় এরা ধুঁকে মরে তবু পরে না শিকল পদ্ধতির!
শাতিল্ আরব! শাতিল আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর |


.                  দুশমন-লোহু ঈর্শায়-নীল
.                  তব তরঙ্গে করে ঝিল্-মিল্,
বাঁকে বাঁকে রোষে মোচোড় খেয়েছে পিয়ে নীল খুন পিণ্ডারীর!
.                                                         জিন্দা বীর
“জুলফিকার” আর “হায়দরী” হাঁক হেথা আজো হজরত আলীর---
শাতিল্ আরব! শাতিল আরব!! জিন্দা রেখেছে তোমার তীর |


.                   ললাটে তোমার ভাস্কর টীকা
.                   বসরা-গুলের বহ্নিতে লিখা ;
এ যে বসোরার খুন-খারাবী গো রক্ত-গোলাপ-মঞ্জরীর!
.                                                 খঞ্জরীর
খঞ্জরে ঝরে খর্জ্জুর সম হেথা লাখো দেশ-ভক্ত শির!
শাতিল্ আরব! শাতিল আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর!


.                     ইরাক্-বাহিনী! এ যে গো কাহিনী,---
.                     কে জানিত কবে বঙ্গ-বাহিনী
তোমারও দুঃখে “জননী আমার!” বলিয়া ফেলিবে তপ্ত নীর!
.                                                      রক্ত-ক্ষীর---
পরাধীনা! একই ব্যথায় ব্যথিত ঢালিল দু’ফোঁটা ভক্ত-বীর!
শহীদের দেশ! বিদায়! বিদায়!! এ অভাগা আজ নোয়ায় শির!



.                          **************



.                                                        
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম


  আগমনী

একি        রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন---
ঝন        রণরণ রণ ঝনঝন !
সেকি        দমকি’ দমকি’
.        ধমকি’  ধমকি’
.        দামা-দ্রিমি-দ্রিমি গমকি’ গমকি’
.                       ওঠে চোটে চোটে,
.        ছোটে লোটে ফোটে !
.        বহ্নি-ফিনিকি চমকি চমকি’
.        ঢাল-তলোয়ারে খনখন !
একি        রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন
রণ        ঝনঝন ঝন রণরণ !


হৈ        হৈ রব
ঐ        ভৈরব
হাঁকে,        লাখে লাখে
ঝাঁকে        ঝাঁকে ঝাঁকে
লাল        গৈরিক-গায়ে সৈনিক ধায় তালে তালে
.        ওই পালে পালে,
.        ধরা কাঁপে দাপে |
.        জাঁকে মহাকাল কাঁপে থরথর !
.        রণে কড়কড় কাড়া-খাঁড়া-ঘাত,
শির        পিশে হাঁকে রথ-ঘর্ঘর-ধ্বনি ঘরঘর !
‘গুরু        গরগর’ বোলে ভেরী তূরী,
.        “হর হর হর”
করি’        চীত্কার ছোটে সুরাসুর-সেনা হনহন !
ওঠে        ঝঞ্ঝা ঝাপটি’ দাপটি’ সাপটি’
.        হু--হু-  হু--হু   হু--হু  শনশন !
.        ছোটে সুরাসুর-সেনা হন হন !
তাতা        থৈথৈ তাতা থৈথৈ খল  খল খল
নাচে        রণ-রঙ্গিণী সঙ্গিনী সাথে,
.        ধকধক জ্বলে জ্বল জ্বল
বুকে        মুখে চোখে রোষ-হুতাশন !
.        রোস্ কোথা শোন্ !


ঐ        ডম্বরু-ঢোলে ডিমিডিমি বোলে,
.        ব্যোম মরুৎ স-অম্বর দোলে,
.        যম-বরুণ কী কল-কল্লোলে চলে উতরোলে
.        ধ্বংসে মাতিয়া,                তাথিয়া তাথিয়া
.                নাচিয়া রঙ্গে !      চরণ ভঙ্গে’
.                সৃষ্টি সে টলে টলমল !
ওকি        বিজয়-ধ্বনি সিন্ধু গরজে কলকল কল কলকল !
.                        ওঠে  কোলাহল
.                        কূট    হলাহল
ছোটে        মন্থনে   পুনঃ  রক্ত-উদধি,
.                ফেনা-বিষ ক্ষরে গলগল !
টলে        নির্ব্বিকার সে বিধাত্রীরো গো
.                সিংহ-আসন টলমল !
কা’র        আকাশ-জোড়া ও’ আনত-নয়ানে
.                করুণা-অশ্রু ছলছল !


বাজে        মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁঝর ঝম্ ঝম্,
নাচে        ধূর্জ্জটী সাথে প্রমথ ববম্ বম্ বম্ !
লাল        লালে লাল ওড়ে ঈশানে নিশান যুদ্ধের,
.        ওঠে     ওঙ্কার রণ-ডঙ্কার,
নাদে        ওম্ ওম্  মহাশঙ্খ-বিষাণ রুদ্রের !
ছোটে রক্ত-ফোয়ারা বহ্নির বান রে !
.        কোটি বীর প্রাণ
.        ক্ষণে নির্ব্বাণ
তবু        শত সূর্যের জ্বালাময় রোষ
.        গমকে শিরায় গম্ গম্ !
ভয়ে        রক্ত-পাগল প্রেত পিশাচেরও
.        শির দাঁড়া করে চন্ চন্ !
যত        ডাকিনী যোগিনী বিস্ময়াহতা,
.        নিশীথিনী ভয়ে থম্ থম্ !
বাজে        মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁঝর ঝম্ ঝম্
ঐ        অসুর-পশুর মিথ্যা দৈত্য-সেনা যত
হত        আহত করে রে দেবতা সত্য !
স্বর্গ,        মর্ত্ত্য, পাতাল, মাতাল, রক্ত-সুরায় ;
.        ত্রস্ত বিধাতা,
মস্ত পাগল পিণাক-পাণি স-ত্রিশূল প্রলয়-হস্ত ঘুরায় !
.        ক্ষিপ্ত সবাই রক্ত-সুরায় !


.চিতার উপরে চিতা সারি সারি,
.        চারি পাশে তারি
ডাকে কুক্কুর গৃধিণী শৃগাল !
প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল !
প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল !!


আজ রণ-রঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ্ মহারণ,
দশদিকে তাঁর দশহাতে বাজে দশ প্রহরণ!
.        পদতলে লুটে মহিষাসুর,
মহামাতা ঐ সিংহ-বাহিণী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে---
শ্বাশত নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিশে যায় শির পশুর !


.                        ‘নাই দানব
.                        নাই অসুর,----
.                        চাই নে সুর,
.                        চাই মানব !’----
.                বরাভয় বাণী ঐ রে কা’র
.                শুনি, নহে হৈ রৈ এবার !
.                        ওঠ্ রে ওঠ্,
.                        ছোট্ রে ছোট্ |
.                        শান্ত মন
.                        ক্ষান্ত রণ !----
.                        খোল্ তোরণ,
.                        চল্ বরণ
.                      কর্ বো মা’য়,
.                      ডর্ বো কায় ?
.                ধর্ বো পা’য় কার্ সে আর,
.                বিশ্ব-মা’ই পার্শ্বে যার ?


আজ        আকাশ-ডোবানো নেহারি তাঁহারি চাওয়া
ঐ        শেফালিকা তলে কে বালিকা চলে ?
কেশের গন্ধ আনিছে আশিন হাওয়া !
এসেছে রে সাথে উত্পলাক্ষী চপলা কুমারী কমলা ঐ,
.        সরসিজ-নিভ শুভ্র বালিকা
.        এলো বীণা-পাণি অমলা ঐ !
.                এসেছে গণেশ,
.                এসেছে মহেশ,
.                বাস্ রে বাস্ |
.                জোর উছাস !!
.        এলো সুন্দর সুর-সেনাপতি,
.        সব মুখ এ যে চেনা চেনা অতি !
.        বাস্ রে বাস্              জোর উচ্ছাস !!


.        হিমালয় ! জাগো ! ওঠো আজি,
.                তব সীমা লয় হোক |
.        ভুলে যাও শোক---চোখে জল ব’ক
.        শান্তির---আজ শান্ত-নিলয় এ আলয় হোক !
.                ঘরে ঘরে আজি দীপ জ্বলুক !
.                মা’  আবাহন-গীত্ চলুক !
.                        দীপ জ্বলুক !
.                        গীত্ চলুক !!
আজ        কাঁপুক মনব-কলকল্লোলে কিশলয় সম নিখল ব্যোম !
.                        স্বা-গতম !
.                        স্বা-গতম !!
.                        মা-তরম্ !
.                        মা-তরম্ !!
.                ঐ  ঐ  ঐ  বিশ্ব কন্ঠে
.        বন্দনা-বাণী লুন্ঠে---------“বন্দে  মাতরম্ !!”




.                          **************



.                                                        
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

কামাল  পাশা


ঐ ক্ষেপেছে পাগ্ লী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল-সামাল তাই !
.                কামাল ! তু  নে  কামাল কিয়া ভাই !
হো  হো         কামাল !  তু  নে  কামাল কিয়া ভাই!

( হাবিলদার মেজর মার্চ্চের হুকুম করিল,----কুইক  মার্চ্চ  !  )


.        লেফ্ ট্!     রাইট্ !       লেফ্ ট্ !!
.        লেফ্ ট্!        রাইট্ !    লেফ্ ট্ !!

 ( সৈন্যগণ গাহিতে গাহিতে মার্চ্চ করিতে লাগিল )


ঐ ক্ষেপেছে পাগ্ লী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল সামাল তাই !
.                কামাল !  তু  নে  কামাল কিয়া ভাই !
হো  হো         কামাল !  তু  নে  কামাল কিয়া ভাই !


         ( হাবিলদার  মেজর -----   লেফ্ ট্ !   রাইট্ !  )




সাব্বাস্ ভাই !  সাব্বাস্ দিই,  সাব্বাস্ তোর শম্ শেরে |
পাঠিয়ে দিলি দুষ্ মনে সব  যম-ঘর  একদম্-সে রে !
.                বল্  দেখি  ভাই,   বল হাঁ  রে,
দুনিয়ায়  কে  ডর্ করে না তুর্কীর তেজ্ তলোয়ারে ?

 (  লেফ্ ট্ !  রাইট্ !    লেফ্ ট্ ! )


.                 খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া !
বুজ্ দিল ঐ দুশ্ মন্ সব বলকুল্ সাফ হো গিয়া !
.             খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া,
.                   হুর্ রো  হো !
.                   হুর্ রো  হো !
দস্যুগুলোয় সামলাতে যে এমনি দামাল কামাল চাই !
.              কামাল !   তু  নে কামাল কিয়া ভাই !
হো  হো       কামাল !  তু  নে কামাল কিয়া ভাই !
(  হাবিলদার  মেজর : ----- সাবাস্ সিপাই !  লেফ্ ট্  !  রাইট্ !  লেফ্ ট্ !  )



শির  হতে  পাঁওতক্   ভাই লাল-লালে-লাল  খুন মেখে
.                 রণ-ভীতুদের শান্তি-বাণী শুন্ বে কে ?
.                         পিন্ডারীদের খুন-রঙীন
.                      নোখ-ভাঙা এই নীল সঙীন
.        তৈয়ার হেয়্ হর্দ্দম ভাই ফার্ তে যিগর্ শত্রুদের!
.        হিংশুক-দল ! জোর তুলেছি শোধ্ তোদের !
.                      সাবাস্ জোয়ান্ ! সাবাস্ !
.        ক্ষীণ-জীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্-----
.                            এম্ নি ক’রে  রে-----
.                            এম্ নি জোরে রে------
.        ক্ষীণ-জীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্ !------
.        ঐ চেয়ে দ্যাখ্ আস্ মানে আজ রক্ত-রবির আভাস |-----
.                      সাবাস্    জোয়ান্ !       সাবাস্ !!


         (  লেফ্ ট্  !  রাইট্ !   লেফ্ ট্  ! )



.        হিংশুটে’ ঐ জীবগুলো ভাই নাম ডুবালে সৈনিকের,
তারা তারা আজ নেস্ত-নাবুদ,  আমরা মোটেই  হই  নি জের !
.        পরের মুলুক লুট ক’রে খায় ডাকাত তারা ডাকাত !
তাই তাদের তরে বরাদ্দ  ভাই আঘাত শুধু আঘাত !
.                কি বল  ভাই শ্যাঙাত ?
.                        হুর্ রো হো !
.                        হুর্  রো  হো !!
দনুজ দলে দ’ল্ তে দাদা এম্ নি দামাল কামাল চাই !
.            কামাল ! তু নে  কামাল  কিয়া  ভাই !
হো হো     কামাল ! তু  নে  কামাল  কিয়া  ভাই !


( হাবিলদার  মেজর : ----রাইট্ হুইল্ ! লেফ্ ট্  ! রাইট্ !  লেফ্ ট্ !
         সৈন্যগণ ডানদিকে  মোড়  ফিরিল | )



আজাদ মানুষ বন্দী ক’রে , অধীন ক’রে স্বাধীন দেশ,
কুল্ মুলুকের কুষ্টি ক’রে জোর দেখালে ক’দিন বেশ,
মোদের হাতে তুর্কী নাচন নাচ্ লে তাধিন্ তাধিন্ শেষ !
.                        হুর্ রো হো !
.                        হুর্ রো  হো !!


বদ্--নসিবের বরাত খারাব বরাদ্দ তাই  ক’রলে  কি না আল্লায়,
পিশাচগুলো প’ড়্ ল এসে পেল্লায় এই  পাগলাদেরই  পাল্লায় !
.                    এই পাগলাদেরই পাল্লায় !!
.                        হুর্ রো হো !
.                        হুর্ রো---------
ওদের       কল্লা দেখে আল্লা ডরায়,  হল্লা  শুধু  হল্লা,
.                      ওদের হল্লা শুধু হল্লা,
এক মুর্গির জোর গায়ে নেই, ধ’র্ তে আসেন তুর্কী--তাজী,
.                      মর্দ্দ  গাজী  মোল্লা !------
.                      হাঃ !      হাঃ !   হাঃ !
.                হেসে   নাড়ীই  ছেঁড়ে  বা !
.                হা   হা     হাঃ!  হাঃ !  হাঃ !

.         (হাবিলদার-মেজরঃ--- সাবাস্  সিপাই !  লেফট্ ! রাইট্  !   লেফ্ ট্ !
         সাবাস্ সিপাই !   ফের বল ভাই | )


ঐ ক্ষেপেছে পাগ্ লী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল  সামাল  তাই !
.                কামাল !  তু    নে   কামাল কিয়া ভাই !
হো    হো        কামাল !  তু    নে   কামাল কিয়া ভাই !

( হাবিলদার--মেজর ----লেফ্ ট্  হুইল ! য়্যাজয়ু   ওয়্যার্ | ---- রাইট্  হুইল !-----
               লেফ্ ট্ !    রাইট্ !     লেফ্ ট্ ! )
( সৈন্যদের আঁখির সামনে অস্ত-রবির আশ্চর্য রঙের খেলা ভাসিয়া উঠিল  | )


.        দেখ্ চ কি দোস্ত্ অমন ক’রে ? হৌ  হৌ  হৌ !
সত্যি  তো ভাই !  সন্ধ্যেটা আজ দেখতে যেন সৈনিকেরই বৌ |
.        শহীদ সেনার টুক্ টুকে বৌ লাল-পিরাহাণ- পরা,
.        স্বামীর খুনের ছোপ-দেওয়া, তায় ডগ্ ডগে আন্ কোরা !------
.     না না না,---- কল্ জে’ যেন টুকরো-ক’রে  কাটা
.   হাজার তরুণ শহীদ বীরের, ----শিউরে উঠে গা’টা !
.   আস্ মানের ঐ সিং-দরজায় টাঙিয়েছে কোন্ কসাই !
দেখতে পেলে এক্ষুণি গ্যে এই ছোরাটা কল্ জেতে তার বসাই !
.                মুন্ডুটা তার খসাই !
গোস্বাতে আর পাই  নে ভেবে কি  যে করি দশাই !
( হাবিলদার মেজরঃ ----সাবাস্ সিপাই ! লেফ্ ট্ ! রাইট্ ! লেফ্ট্ ! )


[ ঢালু পার্ব্বত্য পথ, সৈন্যগণ বুকের পিঠের নিহত ও আহত সৈন্যদের ধরিয়া
সন্তর্পণে নামিল ! ]

.               আহা কচি ভাইরা আমার রে !
এমন কাঁচা জানগুলো, খান্  খান্  ক’রেছে কোন্ সে চামার রে ?
.                  আহা কচি ভাইগুলো আমার রে !!

[  সামনে উপত্যকা  ! হাবিলদার--মেজর : ---- লেফ্ ট্  ফর্ম্ম্ |
সৈন্য-বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল !
হাবিলদার-মেজর : ---ফরওয়ার্ড !  লেফ্ট্ ! রাইট্ ! লেফ্ ট্ ! ]


.                আস্ মানের ঐ আঙ্ রাখা
.                খুন-খারাবীর রং-মাখা
.                কি খুবসুরৎ বাঃ রে  বা !
.                জোর বাজা ভাই কাহার্ বা !
.        হোক্   না ভাই এ কার্ বালা ময়দান----
.        আমরা    যে গাই  সাচ্চারই জয় গান !
.        হোক্  না  এ তোর  কারবালা ময়দান !!
.                        হুর্ রো  হো
.                        হুর্ রো-------

[ সাম্ নে পার্ব্বত্য পথ----হঠাৎ যেন পথ হারাইয়া ফেলিয়াছে | হাবিলদার-মেজর
পথ খুঁজতে লাগিল | হুকুম দিয়া গেল----“ মার্ক টাইম”!  সৈন্যগণ এক স্থানেই
দাঁড়াইয়া পা আছড়াইতে লাগিল----]


.                দ্রাম্ !    দ্রাম !    দ্রাম !
.                লেফ্ ট্ !   রাইট্ !  লেফ্ ট্ !
.                দ্রাম্ !   দ্রাম্ !      দ্রাম্ !
আস্ মানে ঐ ভাসমান যে মস্ত দুটো রং-এর তাল,
একটা নিবিড় নীল-সিয়া আর একটা খুবই গভীর লাল,-----
.        বুঝলে ভাই !  ঐ নীল সিয়াটা শত্রুদের !
.        দেখ্ তে নারে কারুর ভালো,
তাইতো কালো রক্ত-ধারার বইছে শিরায় স্রোত ওদের |
.                হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল!
.        গৃধ্নু ওরা, লুব্ধ ওদের লক্ষ্য অসুর বল-----
.                হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল !
.                জালিম ওরা অত্যাচারী !
.        সার জেনেছে সত্য যাহা হত্যা তারই !
.                        জালিম ওরা অত্যাচারী !
.                সৈনিকের এই গৈরিকে ভাই-----
.                জোর অপমান ক’রলে ওরাই,
তাই তো ওদের মুখ কালো আজ, খুন যেন নীল জল !-------
.                ওরা   হিংস্র পশুর দল !
.                  ওরা    হিংস্র পশুর দল !!

[ হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিয়া ফিরিয়া অর্ডার দিল | -----ফরওয়ার্ড !
লেফ্ ট্ হুইল---সৈন্যগণ   আবার  চলিতে লাগিল-----
               লেফ্ ট্ !   রাইট্     লেফ্ ট্ ! ]


.        সাচ্চা ছিল সৈন্য যারা শহীদ হ’ল মরে !
.        তোদের মতন পিঠ ফেরে নি প্রাণটা হাতে ক’রে,------
.                ওরা  শহীদ হ’ল  ম’রে !
.        পিট্ নি খেয়ে পিঠ যে তোদের টিট্ হ’য়েছে !  কেমন !
.        পৃষ্টে তোদের বর্শা বেঁধা, বীর সে তোরা এমন !
.                মুর্দ্দারা সব যুদ্ধে আসিস্ ! যা  যা !
খুন দেখেছিস্ বীরের ?  হা দেখ্ টক্ টকে লাল কেমন গরম তাজা !
.                মুর্দ্দারা সব যা  যা  !!

[বলিয়াই কটিদেশ হইতে ছোরা খুলিয়া হাতের রক্ত লইয়া দেখাইল  ]



.                এঁরাই বলেন হবেন রাজা !
.                আরে যা  যা ! উচিত সাজা
.        তাই দিয়েছে শক্ত ছেলে কামাল ভাই !

          [  হাবিলদার-মেজর  : ---- সাবাস সিপাই ! ]


.                এই ত চাই !    এই  ত চাই !
থাকলে স্বাধীন সবাই আছি,  নেই ত নাই,  নেই ত  নাই        !
.                        এই  ত  চাই !!

[  কতকগুলি লোক অশ্রু পূর্ণ  নয়নে এই দৃশ্য দেখিবার জন্য ছুটিয়া আসিতে
ছিল, তাহাদের দেখিয়া সৈন্যগণ আরও উত্তেজিত হইয়া উঠিল  ! ]

.                        
.                মার দিয়া ভাই  মার্ দিয়া !
.                দুশ্ মন্ সব হার্ গিয়া !
.                        কিল্লা ফতে হো গিয়া !
পর্ ওয়া নেহি , যা’নে  দো ভাই যো গিয়া !
.                        কিল্লা ফতে হো গিয়া !
.                        হুর্ রো হো !
.                        হুর্ রো হো !

[হাবিলদার-মেজর : ------সাবাস্  জোয়ান !  লেফ্ ট্  !  রাইট্        ! ]


.        জোর্’সে চলো  পা  মিলিয়ে,
.                     গা  হেলিয়ে,
.        এম্ নি ক’রে  হাত দুলিয়ে !
.        দাদ্ রা তালে ‘এক  দুই তিন’ পা মিলিয়ে
.                        ঢেউ-এর মতন যাই !
আজ স্বাধীন এ দেশ !  আজাদ মোরা  বেহেশ্ তও না চাই !
.        আর      বেহেশ্ তও না চাই !!

[ হাবিলদার--মেজর :--- সাবাস্  সিপাই !!   ফের বল  ভাই !  ]


ঐ ক্ষেপেছে পাগ্ লী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল সামাল তাই !
.        কামাল ! তু  নে  কামাল  কিয়া ভাই !
হো  হো কামাল ! তু নে  কামাল  কিয়া ভাই !

[ সৈন্যদল এক নগরের পার্শ্ব দিয়া চলিতে লাগিল | নগর-বাসিনীরা ঝরকা হইতে মুখ বাড়াইয়া
এই মহান দৃশ্য দেখিতেছিল ; তাহাদের চোখ-মুখ আনন্দাশ্রুতে আপ্লুত | আজ বধুর মুখের
বোর্ কা খুলিয়া পড়িয়াছে | ফুল ছড়াইয়া হাত দুলাইয়া তাহারা বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা
করিতেছিল |  সৈন্যগণ চীত্কার করিয়া উঠিল | ]



.      ঐ শুনেছিস্ ?   ঝর্ কাতে সব  বল্ ছে ডেকে বৌ-দলে,
.        “কে বীর তুমি ?   কে  চলেছ  চৌদলে?”
চিনিস্ নে কি ?  এমন বোকা বোনগুলি সব !----কামাল এ যে  কামাল !!
.        পাগ্ লী মায়ের দামাল ছেলে !  ভাই  যে তোদের !
.        তা  না হ’লে কার হবে আর রৌশন এমন জামাল ?
.                                        কামাল  এ যে কামাল !
.        উড়িয়ে দেবো পুড়িয়ে দেবো ঘর-বাড়ী সব সামাল !!
.                                           ঘর-বাড়ী সব সামাল !!
.        আজ আমাদের খুন ছুটেছে,  হোশ ঠুটেছে |
.                                ডগ্ মগিয়ে জোশ উঠেছে |
.                                সামনে থেকে পালাও !
.        শোবহরত দাও নওরাতি আজ !  হর্  ঘরে দীপ জ্বালাও !
.                                সাম্ নে থেকে পালাও !
.                                যাও ঘরে দীপ জ্বালাও !!

[ হাবিলদার-মেজর : ------ লেফ্ ট ফর্ম্ম !  লেফ্ ট্  রাইট্  !   লেফ্ ট্ !------
                         ফরোয়ার্ড !------

বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল |  পার্শ্বেই পরিখার সারি | পরিখা-ভর্তি নিহত সৈন্যের
দল  পচিতেছে এবং কতকগুলি অ-সামরিক নগরবাসী তাহা ডিঙ্গাইয়া  ডিঙ্গাইয়া চলিতেছে ! ]



.        ইস্ !  দেখেছিস্ ! ঐ কা’রা  ভাই সামলে চলেন পা,
.        ফ’স্ কে মরা আধ-মরাদের মাড়িয়ে ফেলেন বা !
.        ও  তাই         শিউরে    ওঠে  গা !
.                                হাঃ  হাঃ  হাঃ !
.                         ম’রলো যে সে ম’রেই গেছে,
.                        বাঁচ্ লো যারা রইল বেঁচে !
.        এই ত জানি সোজা হিসাব ! দুঃখ কি তার আঁ ?
.        মরায় দেখে ডরায় এরা !  ভয় কি মরায় ?    বাঃ !
.                        হাঃ  হাঃ  হাঃ  হাঃ !

[ সন্মুখে সঙ্কীর্ণ  ভগ্ন সেতু | হাবিলদার মেজর অর্ডার দিলেন-----“ফর্ম্ম ইনটু সিঙ্গল লাইন !”
এক এক জন করিয়া বুকের  পিঠের নিহত ও আহতদের চাপিয়া ধরিয়া অতি সন্তর্পনে
“শ্লো মার্চ্চ”   করিয়া পার হইতে লাগিল | ]



.                        সত্যি কিন্তু ভাই !
যখন মোদের বক্ষে বাঁধা ভাইগুলির এই মুখের পানে চাই-----
.        কেমন সে এক ব্যথায় তখন প্রাণটা কাঁদে যে সে !
.        কে যেন দুই বজ্র-হাতে চেপে ধরে কল্ জেখানা পেশে !
নিজের হাজার ঘায়েল জখম ভুলে’ তখন ডুক্ রে কেন কেঁদেও ফেলি
.                                                                শেষে !
.                কে যেন ভাই কল্ জে খানা  পেশে !!
.        ঘুমোও পিঠে, ঘুমোও বুকে, ভাইটি আমার, আহা !!
.     অস্ত-পারের দেশ পারায়ে বহুৎ সে দূর তোদের ঘরের রাহা !
.        ঘুমোও এখন ঘুমোও  ঘুমোও ভাইটি ছোট আহা !
.        মরণ-বধূর লাল রাঙা বর !  ঘুমো !
.        আহা,   এমন চাঁদমুখে তোর কেউ দিল না চুমো !
.                        হতভাগা  রে !
.                ম’রেও  যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে !
.        না জানি কোন্ ফুট্ তে-চাওয়া মানুষ-কুড়ির হিয়ায় !
তরুণ জীবন এম্ নি গেল, একটি রাতও পেলিনে রে বুকে কোনো প্রিয়ায়
.                তরুণ খুনের তরুণ শহীদ ! হতভাগা রে !
.                ম’রেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে !
তাই যত আজ লিখ্ নে-ওয়ালা তোদের মরণ,  ফূর্ত্তি--সে জোর লেখে
.        এক লাইনে দশ হাজারের মৃত্যু কথা !  হাসি  রকম দেখে !
.        ম’রলে  কুকুর ওদের,   ওরা শহীদ-গাথার বই লেখে !
.                                খবর  বেরোয় দৈনিকে,
.    আর একটি খথায় দুঃখ জানান, “ জোর ম’রেছে দশটা হাজার
.                                                               সৈনিকে!”
.        আঁখির পাতা ভিজলো কি না  কোনো কালো চোখের,
.    জান্ লো না হায় এ-জীবনে ঐ সে তরুণ দশটি হাজার লোকের !
.    প’চে মরিস্ পরিখাতে , মা-বোনেরাও শুনে বলে  ‘বাহা’ !
.       সৈনিকেরই সত্যিকারের ব্যথায় ব্যথী কেউ কি রে নেই ? আহা !-----
.        আয় ভাই তোর বৌ এলো ঐ সন্ধ্যা মেয়ে রক্ত চেলী পরে,
.     আঁধার-শাড়ী প’রবে এখন প’শ্ বে যে তোর গোরের বাসর--ঘরে !----
.         ভাব্ তে নারি, গোরের মাটি ক’রবে মাটি  এ মুখ কেমন ক’রে------
.                        সোনা মানিক ভাইটি আমার ওরে !
.                বিদায়-বেলায় আরেকটিবার দিয়ে যা ভাই চুমো !
.          অনাদরের ভাইটি আমার !  মাটীর মায়ের কোলে এবার ঘুমো !!

[ নিহত সৈন্যদের নামাইয়া রাখিয়া দিয়া সেতু পার হইয়া আবার জোর মার্চ্চ করিতে করিতে
তাহাদের রক্ত গরম হইয়া উঠিল | ]


.                        ঠিক ব’লেছ দোস্ত তুমি !
.                চোস্ত কথা ! আয় দেখি তোর হস্ত চুমি !
.                           মৃত্যু  এরা জয় ক’রেছে কান্না কিসের ?
.        আব্-জম্-জম্  আন্ লে এরা,  আপনি পিয়ে কল্ সী বিষের !
.                কে ম’রেছে ?     কান্না  কিসের ?
.                        বেশ  ক’রেছে !!
.                দেশ বাঁচাতে আপ্ নারি জান শেষ ক’রেছে !!
.                                বেশ করেছে  !!
.                                শহীদ ওরাই শহীদ !
.                বীরের মতন প্রাণ দিয়েছে খুন ওদেরি লোহিত !
.                                শহীদ ওরাই শহীদ !!

[ এইবার তাহাদের তাম্বু দেখা গেল | মহাবীর আনোয়ার পাশা বহু সৈন্য সামন্ত ও সৈনিকের
আত্মীয়-স্বজন লইয়া বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতে আসিতেছেন দেখিয়া সৈন্যগণ আনন্দে
আত্মহারা হইয়া “ডবল মার্চ্চ” করিতে লাগিল |  ]


.                                হুর্ রো  হো !
.                                হুর্ রো   হো !!
.        ভাই-বেরাদর পালাও এখন !  দূর্  রহো        ! দূর  রহো !!
.                                হুর্ রো  হো ! হুর্ রো  হো  !

             [ কামাল পাশাকে কোলে লইয়া নাচিতে লাগিল | ]


.                        হৌ হৌ হৌ !  কামাল  জিতা রও !
.                                কামাল জিতা রও !
.                        ওকে আসে ?   আনোয়ার ভাই ?-----
.        আনোয়ার ভাই !    জানোয়ার সব  সাফ্ !!
.        জোর নাচো ভাই!      হর্দ্দম্  দাও লাফ্ !
.                        আজ  জানোয়ার সব সাফ্ !
.                        হুর্ রো হো !  হুর্ রো হো !!
সব-কিছ্ আব্ দূর্ রহো ! -------হুর্ রো  হো ! হুর্ রো হো !!
রণ জিতে জোর মন মেতেছে !----     সালাম সবায় সালাম !-----
.                        নাচ্ না  থামা রে !
জখ্ মী ঘায়েল ভাইকে আগে আস্তে নামা রে !
.                        নাচ্ না থামা রে !

         [ আহতদের নামাইতে নামাইতে ]


.                কে ভাই ? হাঁ,    হাঁ,   সালাম !
-----ঐ শোন্ শোন্ সিপাহ্-সালার কামাল-ভাই-এর  কালাম !
.                [ সেনাপতির অর্ডার আসিল ]



.                “সাবাস্ !  থামো ! হো  হো  !
.                সাবাস্  !   হল্ট্!  এক ! দো !!”

[এক নিমেষে সমস্ত কলরোল নিস্তব্ধ হইয়া গেল ! তখনো কিন্তু তারায় তারায় যেন ঐ বিজয়-
গীতির হারা-সুর বাজিয়া বাজিয়া ক্রমে ক্ষীণ হইতে  ক্ষীণ তর হইয়া মিলিয়া গেল-----]


ঐ ক্ষেপেছে পাগ্ লী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই !
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল সামাল তাই !
.                কামাল !  তু  নে কামাল কিয়া ভাই !
.     হো    হো  কামাল !  তু   নে কামাল কিয়া ভাই !


.                          **************



.                                                        
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

আনোয়ার   

       [ স্থান---প্রহরী  বেষ্টিত  অন্ধকার কারাগৃহ,  কনষ্ট্যান্টিনোপল্  |
                 কাল---অমাবস্যার নিশীথ রাত্রি |  ]


চারিদেক নিস্তব্ধ নির্ব্বাক | সেই মৌনা নিশীথিনীকে ব্যথা দিতেছিল শুধু কাফ্রি--সান্ত্রীর পায়চারীর বিশ্রী খট্ খট্ শব্দ |  ঐ
জিন্দান খানায় মহাবাহু আনোয়ারের জাতীয় সৈন্যদলের সহকারী এক তরুণ সেনানী বন্দী | তাহার কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ,
ডাগর চোখ, সুন্দর গঠন---সমস্ত কিছুতে যেন একটা ব্যথিত -বিদ্রোহের তিক্ত-ক্রন্দন ছলছল করিতেছিল | তুরুণ প্রদীপ্ত
মুখমন্ডলে চিন্তার রেখাপাতে তাহাকে তাহার বয়স অপেক্ষা অনেকটা বেশী বয়স্ক বোধ হইতেছিল |

সেই দিনই ধামা-ধরা সরকারের কোর্ট-মার্শালের বিচারে নির্দ্ধারিত হইয়া গিয়াছে যে, পরদিন নিশিভোরে তুরুণ সেনানীকে
তোপের মুখে উড়াইয়া দেওয়া হইবে |

আজ হতভাগ্যের সেই মুক্তি-নিশীথ, জীবনের সেই শেষরাত্রি | তাহার হাতে পায়ে, কটিদেশে গর্দ্দানে উত্পীড়নের লৌহ-
শৃঙ্খল | শৃঙ্খল-ভারাতুর তরুণ সেনানীর স্বপ্নে তাহার ‘মা’কে দেখিতেছিল | সহসা চীত্কার করিয়া সে জাগিয়া উঠিল |
তাহার পর চারিদিকে কাতর নয়নে একবার চাহিয়া দেখিল, কোথাও কেহ নাই | শুধু হিমানী সিক্ত বায়ু হা  হা স্বরে
কাঁদিয়া গেল, “হায় মতৃহারা |”

স্বদেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা স্মরণ করিয়া তুরুণ সেনানী ব্যর্থ-রোষে নিজের বামবাহু নিজে দংশন করিয়া ক্ষত-বিক্ষত
করিতে লাগিল | কারাগৃহের লৌহশলাকায় তাহার শৃঙ্খলিত দেহভার বারেবারে নিপাতিত হইয়া কারা-গৃহ কাঁপাইয়া
তুলিতেছিল |

এখন তাহার অস্ত্র-গুরু আনোয়ারকে মনে পড়িল | তুরুণ বন্দী চীত্কার করিয়া উঠিল,---- “আনোয়ার !”




.              আনোয়ার !     আনোয়ার !
.দিলওয়ার তুমি,  জোর তলওয়ার হানো , আর
নেস্ত্-ও-নাবুদ কর,   মারো যত জানোয়ার !
.              আনোয়ার !         আফ্ সোস্ !
.               বখ্ তেরই  সাফ্  দোষ্,
রক্তেরও  নাই ভাই আর  সে   যে তাপ জোশ
ভেঙে গেছে শম্ শের-----পড়ে আছে খাপ কোষ !
.                 আনোয়ার !   আফ্ সোস্ !
.        আনোয়ার !    আনোয়ার !
সব যদি সুম্ সাম্ , তুমি কেন কাঁদ আর ?
দুনিয়াতে মুসলিম আজ পোষা জানোয়ার !
.        আনোয়ার !  আর না !------
.        দিল্  কাঁপে  কার না ?
তলওয়ারে তেজ নাই !---- তুচ্ছ  স্মার্ণা,
ঐ কাঁপে  থরথর মদিনার দ্বার  না  ?
.                    আনোয়ার ! আর না !
.        আনোয়ার !    আনোয়ার !
বুক ফেড়ে আমাদের কলিজাটা টানো, আর
খুন কর----খুন কর ভীরু যত জানোয়ার !
.        আনোয়ার !     জিঞ্জির-
.        পরা  মোর  খিঞ্জির !
শৃঙ্খলে বাজে-শোনো রোণা রিণ-ঝিণ্ কির,----
নিবু নিবু ফোয়ারা বহ্নির ফিন্ কির !
.                গর্দ্দান  জিঞ্জির !
.        আনোয়ার !     আনোয়ার !
দুর্ব্বল এ গিদ্ ধড়ে কেন তড়্ পানো আর ?
জোর্ ওয়ার শের কই ?  জোর্ বার জানোয়ার !
.        আনোয়ার !  মুশ্ কিল
.        জাগা কঞ্জুশ-দিল,
ঘিরে আসে  দাবানল তবু নাই হুঁশ তিল !
ভাই আজ শয়তান ভাই-এ মারে ঘুষ  কিল !
.                আনোয়ার !   মুশ্ কিল !
.        আনোয়ার !      আনোয়ার !
বেইমান মোরা,  নাই জান আধ-খানও  আর !
কোথা খোঁজা মুসলিম ?    শুধু বুনো ঝানোয়ার !
.        আনোয়ার !         সব  শেষ !------
.        দেহে খুন  অবশেষ !--------
ঝুটা তেরি তল্ ওয়ার ছিন্ লিয়া যব্ দেশ !
আওরত সম ছি  ছি ক্রন্দন রব পেশ !!
.                আনোয়ার !     সব  শেষ !
.        আনোয়ার !      আনোয়ার !
জনহীন  এ বিয়াবানে মিছে পস্ত্ নো আর !
আজো যারা বেঁচে আছে তারা ক্ষ্যাপা জানোয়ার !
.        আনোয়ার !--------কেউ  নাই !
.        হাথিয়ার ? ----- সেও  নাই !
দরিয়াও থম্ থম্  নাই তাতে ঢেউ, ছাই !
জিঞ্জির গলে আজ বেদুঈন-দে’ও ভাই !
.                আনোয়ার !  কেউ নাই !
.        আনোয়ার !  আনোয়ার !
যে বলে সে মুসলিম -----জিভ ধরে টানো তার’ !
বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার !
.        আনোয়ার !      ধিক্কার !!
.        কাঁধে ঝুলি   ভিক্ষার-----
তল্ ওয়ারে শুরু যার স্বাধীনতা শিক্ষার !
যারা ছিল দুর্দ্দম আজ তারা দিক্ দার !
.                       আনোয়ার !      ধিক্কার !!
.        আনোয়ার !     আনোয়ার !
দুনিয়াটা খুনিয়ার,  তবে কেন মানো আর
রুধিরের লোহু আঁখি ? -----শয়তানী জানো সার !
.        আনোয়ার !  পঞ্জায়
.        বৃথা লোকে সম্ ঝায়,
ব্যথা-হত বিদ্রোহী দিল্ নাচে ঝঞ্ঝায়,
খুন-খেগো তল্ ওয়ার আজ শুধু রণ্ চায়,
.                আনোয়ার !  পঞ্জায় !
.        আনোয়ার !   আনোয়ার !
পাশা তুমি নাশা হও মুস্ লিম জানোয়ার,
ঘরে যত দুষ্ মন, পরে  কেন  হানো মার ?
.        আনোয়ার !     এসো ভাই !
.        আজ সব শেষ-ও  যাই !------
ইসলামও ডুবে গেল, মুক্ত স্ব-দেশও নাই !
তেগ ত্যজি বরিয়াছি  ভিখারীর বেশও তাই !
.        আনোয়ার !   এসো ভাই !!


সহসা কাফ্রী সান্ত্রীর ভীম চ্যালেঞ্জ্ প্রলয়-ডম্বরু-ধ্বনির মত হুঙ্কার দিয়া উঠিল-----“এয় নৌজওয়ান, হুঁশিয়ার !”  অধীর
ক্ষোভে তিক্তরোষে তরুণের দেহের রক্ত টগ্ বগ্ করিয়া ফুটিয়া উঠিল | তাহার কটিদেশের, গর্দ্দানের, পায়ের শৃঙ্খল খান্
খান্ হইয়া টুটিয়া গেল , শুধু হাতের শৃঙ্খল টুটিল না | সে সিংহ শাবকের মত গর্জন করিয়া উঠিল-----

এয়্ খোদা !   এয়্  আলী !     লাও  মেরী  তল্ ওয়ার !

সহসা তাহার ক্লান্ত আঁখির চাওয়ায় তুরস্কের বন্দিনী মাতৃ-মূর্ত্তি ভাসিয়া উঠিল | ঐ মাতৃ-মূর্ত্তির পার্শ্বেই  তাহার মায়েরও
শৃঙ্খলিতা ভিখারিণী বেশ | তাঁদের দুজনেরই চোখের কোণে দুই বিন্দু করিয়া করুণ অশ্রু |  অভিমানী পুত্র অন্য দিকে
মুখ ফিরাইয়া লইয়া কাঁদিয়া উঠিল------


.        ও  কে ?  ও  কে ছল  আর ?
না-----মা, মরা জানকে এ মিছে তর্ সানো আর !
.        আনোয়ার !      আনোয়ার !!


কাপুরুষ প্রহরীর ভীম প্রহরণ বিনিদ্র বন্দী তরুণ সেনানীর পৃষ্ঠের উপর পড়িল | অন্ধ কারাগারের বন্ধ রন্ধ্রে তাহারই আর্ত্ত
প্রতিধ্বনি গুমরিয়া গুমরিয়া ফিরিতে লাগিল-----


 “আঃ    আঃ     আঃ !!

আজ নিখিল বন্দী--গৃহে ঐ মাতৃ-মুক্তি-কামী  তরুণেই অতৃপ্ত কাঁদন ফরিয়াদ করিয়া ফিরিতেছে !  যে দিন এ ক্রন্দন
থামিবে, সেদিন সে কোন্ অচিন্ দেশে থাকিয়া গভীর তৃপ্তির হাসি হাসিবে জানি না  ! তখন হয়তো হারা-মা আমায়
“তারার পানে চেয়ে চেয়ে”  ডাকিবেন ! আমিও হয়তো আবার আসিব | মা কি আমায় তখন নূতন ডাকে ডাকিবেন ?
আমার প্রিয়জন কি আমায় নূতন বাহুর ডোরে বাঁধিবে ? আমার চোখ জলে ভরিয়া উঠিতেছে, আর কেন যেন মনে
হইতেছে, “----আসিবে সেদিন আসিবে |”


.                          **************



.                                                        
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

রণ--ভেরী


[গ্রীসের বিরুদ্ধে আঙ্গোরা--তুর্ক--গভর্ণমেন্ট যে যুদ্ধ চালাইতেছিলেন, সেই যুদ্ধে কামাল পাশার সাহায্যের  জন্য ভারতবর্ষ
হইতে দশ হাজার স্বেচ্ছা-সৈনিক প্রেরণের প্রস্তাব শুনিয়া লিখিত | ]


.                ওরে                         আয় !
ঐ       মহা-সিন্ধুর  পার হ’তে ঘন  রণ-ভেরী শোনা যায়------
.                ওরে                        আয় !
.                ঐ        ইস্ লাম  ডুবে  যায় !
.                যত                        শয়তান
.                সারা                        ময়দান
জুড়ি’    খুন তার পিয়ে হুঙ্কার দিয়ে জয়-গান শোন্ গায় !
.         আজ সখ ক’রে                 জুতি--টক্করে
তোড়ে   শহীদের  খুলি দুশ্ মন পায়  পায়----
.                ওরে                         আয় !
তোর    জান যায় যাক,  পৌরুষ তোর মান যেন নাহি যায় !
ধরে     ঝঞ্ঝার ঝুঁটি দাপটিয়া  শুধু মুসলিম-পঞ্জায় !
.         তোর মান যায়                      প্রাণ যায়-----
তবে     বাজাও  বিষাণ, ওড়াও নিশান ! বৃথা  ভীরু সম্ ঝায় !
.                রণ-দুর্ম্মদ  রণ চায় !
.                ওরে                   আয় !
ঐ        মহাসিন্ধুর পার হ’তে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায় !


.                ওরে                    আয় !
ঐ        ঝননননন   রণঝনঝন  ঝঞ্ঝনা শোনা যায় !
শুনি        এই ঝঞ্ঝনা-ব্যঞ্জনা  নেবে গঞ্জনা  কে  রে  হায় ?
.                ওরে                           আয় !
.        তোর    ভাই  ম্লান চোখে চায়,
.                মরি                        লজ্জায়,
.                ওরে                       সব যায়,
তবু     কব্ জায় তোর শম্ শের নাহি কাঁপে আফ্ সোসে হায় ?
.         রণ        দুন্দুভি শুনি’ খুন-খুবী
নাহি        নাচে কি  রে তোর মরদের ওরে দিলীরের গোর্দ্দায় ?
.                ওরে                        আয় !
মোরা  দিলাবার  খাঁড়া তলোয়ার হাতে আমাদেরি শোভা পায় !
তারা   খিঞ্জির যারা জিঞ্জীর-গলে  ভূমি চুমি’  মুরছায় !
.                আরে দূর দূর !   যত কুক্কুর
আসি   শের-বব্বরে  লাথি মারে ছি  ছি  ছাতি চ’ড়ে ! হাতি
.                                        ঘাল হবে ফেরু-ঘায় ?
ঐ      ঝননননন   রণঝন ঝন   ঝঞ্ঝনা শোনা যায় !
.                ওরে                        আয় !
বোলে  দ্রিম্  দ্রিম্ তানা দ্রিম্  দ্রিম্  ঘন রণ-কাড়া নাকাড়ায় !
.        ঐ         শের  নর হাঁকড়ায়------
.                ওরে                আয় !
.                  ছোড়্                মন-দুখ,
.                  হোক্                কন্দুক
ঐ বন্দুক তোপ, সন্দুক তোর পড়ে থাক্, স্পন্দুক বুক ঘায় !
.        নাচ্  তাতা থৈ থৈ  তাতা থৈ--থৈ |
থৈ        তান্ডব,  আজ পান্ডব সম খান্ডব-দাহ চাই !
.                ওরে                 আয় !
কর্        কোর্ বান আজ তোর জান দিল্ আল্লার নামে ভাই !
ঐ        দীন্  দীন্-রব  আহব বিপুল বসুমতী ব্যোম ছায় !
.                শেল-                গর্জ্জন
.                করি’                 তর্জ্জন
হাঁকে        ‘বর্জ্জন  নয় অর্জ্জন’ আজ,  শির তোর  চায় মা’য় !
.                সব  গৌরব যায় যায় ;
.                ওরে                    আয় !
বোলে  দ্রিম্ দ্রিম্ তানা দ্রিম্ দ্রিম্ ঘণ রণ-কাড়া-নাকাড়ায় !
.                ওরে                    আয় !
ঐ            কড়  কড় বাজে রণ-বাজা,  সাজ সাজ রণ-সজ্জায় !
.                ওরে                    আয় !
.                মুখ  ঢাকিবি  কি লজ্জায় ?
.                হুর্                    হুর্ রে !
.                কত                    দূর  রে
সেই        পুর রে যথা-খুন-খোশ্ রোজ খেলে হররোজ দুশ্ মন-খুনে ভাই !
.        সেই     বীর-দেশে             চল  বীর-বেশে,
আজ        মুক্ত  দেশে রে  মুক্তি দিতে রে বন্দীরা ঐ যায় !
.                 ওরে                     আয় !
বল্        ‘জয় সত্যম্ পুরুষোত্তম্’ ভীরু যারা মা’র খায় !
নারী        আমাদেরি  শুনি’ রণ-ভেরী হাসে খল খল হাত-তালি
.                                                দিয়ে রণে ধায় !
.                মোরা রণ্ চাই              রণ চাই,
তবে        বাজহ দামামা,  বাঁধহ আমামা, হাথিয়ার পাঞ্জায় !
মোরা        সত্য ন্যায়ের সৈনিক,  খুন-গৈরিক বাস  গা’য়
.                ওরে                      আয় !
ঐ        কড় কড় বাজে রণ-বাজা,   সাজ সাজ রণ-সজ্জায় !
.                 ওরে                    আয় !
অব-        রুদ্ধের  দ্বারে যুদ্ধের  হাঁক নকীব ফুকারি’ যায় !
.                তোপ্  দ্রুম্  দ্রুম্  গান গায় !
.                ওরে                       আয় !
ঐ        ঝনন   রণণ   খঞ্জর-ঘাত  পঞ্জরে মূরছায় !
.                হাঁকো                      হাইদার,
.                নাই                      নাই ডর,
ঐ        ভাই তোর ঘুর-চর্খীর  সম খুন খেয়ে  ঘুর্ খায় !
.        ঝুটা    দৈত্যেরে     নাশি’ সত্যেরে
দিবি        জয়-টীকা তোরা,  ভয় নাই ওরে ভয় নাই হত্যায় !
.                ওরে                       আয় !
মোরা        খুন্-জোশী বীর,  কঞ্জুশী লেখা আমাদের খুনে নাই!
দিয়ে        সত্য ও  ন্যায়ে বাদশাহী , মোরা জালিমের খুন খাই !
.        মোরা দুর্দ্দম,                         ভর্ পুর্ মদ
খাই        ইশ্ কের,  ঘাত শম্ শের ফের নিই বুক নাঙ্গায় !
.        লাল-         পল্টন মোরা সাচ্চা,
মোরা         সৈনিক,   মোরা শহীদান বীর বাচ্চা,
.        মরি            জালিমের  দাঙ্গায় !
মোরা         অসি বুকে বরি’  হাসি মুখে করি’ জয় স্বাধীনতা গাই !
.                ওরে                        আয় !
ঐ        মহা-সিন্ধুর  পার হ’তে  ঘন রণ-ভেরী শোনা যায় !!


.                          **************



.                                                        
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

কোরবানী

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্-বোধন !
.  দুর্ব্বল ! ভীরু ! চুপ রহো, ওহো খাম্ খা ক্ষুব্ধ মন !
.                ধ্বনি ওঠে রণি’ দূর বাণীর,----
.                আজিকার এ খুন কোর্ বানীর !
.                দুম্বা-শির           রুম্-বাসীর
.   শহীদের শির-সেরা আজি !-----  রহ্ মান কি রুদ্র নন ?
.                ব্যস্ !   চুপ খামোশ রোদন !
আজ  শোর ওঠে জোর “ খুন দে, জান দে, শির দে বত্স”  শোন্ !
ওরে  হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির  উদ্-বোধন !


ওরে        হত্যা নয় আজ  ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্ধোধন !
.                খঞ্জরে মারো গর্দ্দানেই,
.                পঞ্জরে আজি দরদ্ নেই,
.                মর্দ্দানীই             পর্দ্দা নেই,
.        ডর্ তা নেই আজ খুন-খারাবীতে রক্ত-লুব্ধ মন !
.                খুনে          খেল্ বো খুন-মাতন !
দুনো        উন্ মাদনাতে সত্য মুক্তি আন্ তে যুঝ্ বো রণ !
ওরে        হত্যা নয়  আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির  উদ্ধোধন !


ওরে         হত্যা  নয় আজ   ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্ধোধন !
.                চ’ড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার
.                মুস্ লিমে সারা দুনিয়াটার !
.                ‘জুল্ ফেকার’     খুল্ বে তার
.        দু’ধারী ধার শেরে-খোদার,  রক্তে-পূত-বদন !
.                খুনে        আজকে রুধ্ বো মন !
ওরে        শক্তি-হস্তে    মুক্তি , শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্ !
ওরে        হত্যা নয় আজ  ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন !



ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন !
.                আস্তানা সিধা রাস্তা নয়,
.                ‘আজাদী’ মেলে না পস্তানো’য় !
.                দস্তা নয়                সে সস্তা নয় !
.         হত্যা নয় কি মৃত্যুও ?          তবে রক্ত-লুব্ধ কোন্
.                কাঁদে----     শক্তি-দুস্ত শোন্-------
“এয়্        ইবরাহীম আজ  কোরবানী  কর শ্রেষ্ঠ পুত্র ধন !”
ওরে        হত্যা নয় আজ  ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন !

ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্ভোধন !
.                এ তো নহে লোহু তরবারের
.                ঘাতক জালিম জোর্ বারের !
.                কোরবানের  জোর-জানের
.        খুন এ যে, এতে গোর্দ্দা ঢের রে, এ ত্যাগে ‘বুদ্ধ’ মন !
.                এতে মা রাখে পুত্র পণ !
তাই        জননী হাজেরা বেটারে পরালো বলির পূত বসন !
ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন !


ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন !
.                এই দিন-ই ‘মীনা’- ময়দানে’
.                পুত্র-স্নেহের গর্দ্দানে
.                ছুরি হেনে’ খুন ক্ষরিয়ে নে’
.        রেখেছে আব্বা ইব্ রাহীম্ সে আপনা রুদ্র পণ !
.                ছি ছি !  কেঁপো না  ক্ষুদ্র মন !
আজ        জল্লাদ নয়,  প্রহ্লাদ-সম মোল্লা খুন-বদন !
ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন !


ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন !
দ্যাখ        কেঁপেছে ‘আরশ’ আস্ মানে !
.                মন-খুনী কি  রে রাশ মানে ?
.                ত্রাসে-প্রাণে ----তবে রাস্তা নে !
প্রলয়-বিষাণ ‘কিয়ামতে’  তবে বাজাবে কোন্ বোধন ?
.                সে কি                    সৃষ্টি-সংশোধন ?
ওরে         তাথিয়া তাথিয়া নাচে ভৈরব বাজে ডম্বরু শোন্ !----
ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন !


ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’  শক্তির উদ্বোধন !
.                মুসলিম-রণ-ডঙ্কা সে,
.                খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে ?
.                টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারে,
ওরে        হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম-কারা, ল’ড়বো রণ-মরণ !
.                ঢালে বাজ্ বে ঝন্-ঝনন্ !
ওরে        সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন !
ওরে         হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন !


ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’   শক্তির উদ্বোধন !
.                জোর চাই, আর যাচ্ না নয়,
.                কোরবানী-দিন আজ না ওই ?
.                বাজ্ না কই ?   সাজ্ না কই ?
.        কাজ না আজিকে জান্ মাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধরণ ?
.                বল্----“ যুঝ্ বো জান্ ভি পণ !”
ঐ        খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ,
আজ        আল্লার নামে জান্ কোরবানে ঈদের পূত বোধন !
ওরে        হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন !

.                     *********************************            

রহমান----করুণাময় |  খামোশ---নীরব |   গর্দ্দানে---স্কন্ধে |   
জুল্ ফেকার----মহাবীর হজরত আলির বিশ্বত্রাস তরবারী  |  
শেরে খোদা---খোদার সিংহ ;  হজরত আলীকে এই গৌরবান্বিত নামে অভিহিত করা হয় |
জোর্ বার---বলদীপ্ত |  জোর্ জান---- মহাপ্রাণ | আজাদী----মুক্তি |
ইব্ রাহীম---
Abrahim   |  হাজেরা--হজরত ইবরাহীমের স্ত্রী |  
আরশ-- খোদার সিংহাসন |  কিয়ামত--মহাপ্রলয়ের দিন |

.                          
.                                                                
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর
*
অগ্নিবীণা , কাজী নজরুল ইসলাম

মোহর্ রম

নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,-----
“আম্মা ! লা’ল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া !”
কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে !
রুদ্র মাতম্ ওঠে দুনিয়া-দামেশ্ কে----
“জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে ?”
‘ হায় হায় হোসেনা’,  ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তল্ ওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরো পঞ্জায় !
উন্ মাদ ‘দুল্ দুল্’ ছুটে ফেরে মদিনায়,
আদি-জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায় !
মা ফতেমা আস্ মানে কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস !
রণে যায় কাসিম ঐ দু’ঘড়ির নওশা,
মেহেদীর রঙটুকু মুছে গেল সহসা !
‘হায় হায়’ কাঁদে বায় পূরবী ও দখিনা----
‘কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেল সকীনা !’
কাঁদে কে রে কোলে ক’রে কাসিমের কাটা-শির ?
খান্ খান্ হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর !
কেঁদে গেছে থামি’ হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র !
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
“আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা !”
নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার,
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার !
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস,
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্ মনও ‘সাব্বাস্’ !
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর “শির দেগা, নেহি দেগা আমামা !”
কলিজা কাবাব সম ভুনে মরু-রোদ্দুর,
খাঁ-খাঁ করে কারবালা, নাই পানি খর্জ্জুর,
মা’র স্তনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়্ পায় !
জিভ চুষে’ কচি জান থাকে কিরে ধড়্ টায় ?
দাউ দাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর,
কাঁদে বানু----“পানি দাও, মরে যাদু আস্ গর !”
পেলো না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন,
ডাকে মাতা, পানি দেবো ফিরে আয় বাছা শুন্ !
পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে
ছিঁড়ে আনে মর্ম্মের বত্রিশ বাঁধনে !
তাম্বুতে শয্যায় কাঁদে একা জয়নাল,
“দাদা ! তেরি ঘর্ কিয়া বরবাদ্ পয়মাল !”
‘হাইদরী-হাঁক-হাঁকি দুলদুল-আসওয়ার
শম্ শের চম্ কায় দুষমনে ত্রাস্ বার |
খ’সে পড়ে হাত হ’তে শত্রুর তরবার,
ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার !
নিঃশেষ দুষমন্ ; ও কে রণ-শ্রান্ত
ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত ?
কোথা বাবা আস্ গর? শোকে বুক-ঝাঁঝরা
পানি দেখে হোসেনের ফেটে যায় পাঁজরা !
ধুঁকে ম’লো আহা তবু পানি এক কাৎরা
দেয় নি রে বাছাদের মুখে কম্ জাত্ রা !
অঞ্জলি হ’তে পানি প’ড়ে গেল ঝর্-ঝর্,
লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জ্জর !
হল্ কুমে হানে তেগ ও কে ব’সে ছাতিতে ?-----
আফ্ তাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে |
‘আস্ মান’ ভ’রে গেল গোধূলিতে দুপুরে,
লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে !
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে, আহ্----
‘আরশের’ পায়া ধরে, কাঁদে মাতা ফাতেমা,
“ এয়্ খোদা বদ্ লাতে বেটাদের রক্তের
মার্জ্জনা কর গোনা পাপী কম্ বখতের |”
কত মোহর্ রম এলো, গেল চ’লে বহু কাল---
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল !
মুস্ লিম ! তোরা আজ ‘জয়নাল আবেদীন্’ ,
‘ওয়া হোসেনা-----ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন !
ফিরে এলো আজ সেই মোহর্ রম মাহিনা,------
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না !
উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ্ আরবীর,
দুনিয়াতে নত নয় মুস্ লিম কারো শির,-----
তবে শোন ঐ বাজে কোথা দামামা,
শম্ শের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা !
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকীবের তুর্য্য,
হুঁশিয়ার ইসলাম, ডুবে তব সূর্য্য !
জাগো ওঠ মুস্ লিম, হাঁকো হাইদরী হাঁক |
শহীদের দিনে সব লালে-লাল হ’য়ে যাক্ !
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তীন,
ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস্ দিন !
হাসানের মতো পি’ব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের ;
আস্ গর সম দিব বাচ্চারে কোর্ বান,
জালিমের দাদ নেবো, দেবো আজ গোর জান !
সকীনার শ্বেতবাস দেবো মাতা কন্যায়,
কাসিমের মত দেবো জান রুধি’ অন্যায় !
মোহর্ রম্ ! কারবালা ! কাঁদো “হায় হোসেনা !”
দেখো মরু-সূর্য্যে এ খুন যেন শোষে না !

.           *****************************                

মাতম্---হাহা ক্রন্দন | লা’ল-- যাদু |
দুনিয়া দামেশ্ কে--------দামেশক্ রূপ দুনিয়ায় |
এজিদ--হোসেনের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজা |
দুল্ দুল্ --ইমাম হোসেনের ঘোড়ার নাম |
কাসিম--ইমাম হাসানের পুত্র, ইমাম হোসেনের জামাতা, সকীনার স্বামী  |
নওশা---বর |  সীমার---হোসেনের হত্যাকারী |
ফাতিমা--ইমাম হোসেনের ছোট মেয়ে
আমামা--শিরস্ত্রাণ |  বানু --আসগরের মাতা |  
আস্ গর---ইমাম হোসেনের শিশু পুত্র
বর্ বাদ--নষ্ট |  পয়মাল--ধ্বংস | জয়নাল---হোসেনের পুত্র |  
দুল্ দুল্ -আসওয়ার-- ‘দুল্ দুল্ ‘ ঘোড়ার সোয়ার, হোসেন |
কম্ জাতরা--নীচমনাগণ |  হল্ কুম--কন্ঠ্ |
তেগ---তরবারি | আফ্ তাব--সূর্য্য |  কম্ বখত্---হতভাগ্য |
মার্শিয়া--শোক গীতি | শম্ সের-- তরবারি | কহর-- অভিশাপ |
দাদ--প্রতিশোধ  | নকীব--তুর্য্যবাদক |

.                          
.                                                                
অগ্নিবীণা-র সূচির পাতায়  

মিলনসাগর