অস্ত-আকাশ-অলিন্দে তার শীর্ণ-কপোল রাখি’ কাঁদিতেছে চাঁদ, “মুসাফির জাগো, নিশি আর নাই বাকী | নিশীথিনী যার দূর বন-ছায় তন্দ্রায় ঢুলু ঢুল্ , ফিরে ফিরে চায়, দু’-হাতে জড়ায় আঁধারের এলোচুল !”
চমকিয়া জাগি, ললাটে আমার কাহার নিশাস লাগে ? কে করে ব্যজন তপ্ত ললাটে, কে মোর শিয়রে জাগে ? জেগে দেখি, মোর বাতায়ন-পাশে জাগিছে স্বপনচারী নিশীথ রাতের বন্ধু আমার গুবাক-তরুর সারি !
তোমাদের আর আমার আঁখির পল্লব-কম্পনে সারা রাত মোরা ক’য়েছি যে কথা, বন্ধু পড়িছে মনে ! জাগিয়া একাকী জ্বালা ক’রে আঁখি আসিত যখন জল, তোমাদের পাতা মনে হ’তে যেন সুশীতল করতল !
হয়ত স্বপনে বাড়ায়েছি হাত লইতে পরশখানি, বাতায়নে ঠেকি’ ফিরিয়া এসেছে লইয়াছি লাজে টানি’ | বন্ধু, এখন রুদ্ধ করিতে হইবে সে বাতায়ন ! ডাকে পথ, হাঁকে যাত্রীরা, “কর বিদায়ের আয়োজন !”
. --------আজি বিদায়ের আগে আমারে জানাতে তোমারে জানিতে কত কি যে সাধ জাগে ! মর্মের বাণী শুনি তব, শুধু মুখের ভাষায় কেন জানিতে চায় ও বুকের ভাষারে লোভাতুর মন হেন ! জানি-----মুখে মুখে হবে না মোদের কোনোদিন জানাজানি, বুকে বুকে শুধু বাজাইবে বীণা বেদনার বীণাপানি !
হয়ত তোমারে দেখিয়াছি, তুমি যাহা নও তাই ক’রে, ক্ষতি কি তোমার, যদি গো আমার তাতেই হৃদয় ভরে ? সুন্দর যদি করে গো তোমারে আমার আঁখির জল, হারা-মোমতাজে ল’য়ে কারো প্রেম রচে যদি তাজ-ম’ল, . -----------বল তাহে কার ক্ষতি ? তোমাকরে লইয়া সাজাব না ঘর , সৃজিব অমরাবতী !--------
হয়ত তোমার শাখায় কখনো বসেনি আসিয়া শাখী, তোমার কুঞ্জে পত্রকুঞ্জে কোকিল ওঠেনি ডাকি’ | শূন্যের পানে তুলিয়া ধরিয়া পল্লব-আবেদন জেগেছে নিশীথে জাগে নি ক’ সাথে খুলি’ কেহ বাতায়ন | . ------সব আগে আমি আসি’ তোমারে চাহিয়া জেগেছি নিশীথ, গিয়াছে গো ভালবাসি’ ! তোমার পাতায় লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয়-লেখা এইটুকু হোক্ সান্ত্বনা মোর, হোক্ বা না হোক্ দেখা |-------
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না, কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না | . ------- নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ !------
শুধাইতে নাই, তবুও শুধাই আজিকে যাবার আগে----- ঐ পল্লব-জাফ্ রি খুলিয়া তুমিও কি অনুরাগে দেখেছ আমারে ----দেখিয়াছি যবে আমি বাতায়ন খুলি’ ? হাওয়ায় না মোর অনুরাগে তব পাতা উঠিয়াছে দুলি’ ?
তোমার পাতার হরিৎ আঁচলে চাঁদিনী ঘুমাবে যবে, মূর্চ্ছিতা হবে সুখের আবেশ,----সে আলোর উত্সবে, মনে কি পড়িবে এই ক্ষণিকের অতিথির কথা আর ? তোমার নিশাস শূন্য এ ঘরে করিবে কি হাহাকার ? চাঁদের আলোক বিস্বাদ কি গো লাগিবে সেদিন চোখে ? খড়খড়ি খুলি’ চেয়ে রবে দূর অস্ত অলখ-লোকে ? . --------অথবা এমনি করি’ দাঁড়ায়ে রহিবে আপন ধেয়ানে সারা দিনমান ভরি’ ?
ভুল ক’রে কভু আসিলে স্মরণে অমনি তা যেয়ো ভুলি’ যদি ভুল ক’রে কখনো এ মোর বাতায়ন যায় খুলি’, বন্ধ করিয়া দিও পুনঃ তায় !--- তোমার জাফ্ রি-ফাঁকে খুঁজো না তাহারে গগন-আঁধারে----মাটিতে পেলে না যাকে !
কে জানে কোথায় চলিয়াছি ভাই মুসাফির পথচারী, দু’ধারে দু’কূলে দুঃখ-সুখের---মাঝে আমি স্রোত বারি ! আপনার বেগে আপনি ছুটেছি জন্ম-শিখর হ’তে, বিরাম-বিহীন রাত্রি ও দিন পথ হ’তে আন্ পথে ! নিজ বাস হ’ল চির-পরবাস, জন্মের ক্ষণপরে বাহিরিনু পথে গিরি পর্বতে----ফিরি নাই আর ঘরে ! পলাতকা শিশু জন্মিয়াছিনু গিরি-কন্যার কোলে, বুকে না ধরিতে চকিতে ত্বরিতে আসিলাম ছুটে চ’লে !
জননীরে ভুলি’ যে পথে পলায় মৃগ-শিশু বাঁশী শুনি’, যে পথে পলায় শশকেরা শুনি’ ঝর্ ণার ঝুনঝুনি, পাখী উড়ে যায় ফেলিয়া কূলায় সীমাহীন নভোপানে, সাগর ছাড়িয়া মেঘের শিশুরা পলায় আকাশ-যানে,----- সেই পথ ধরি’ পলাইনু আমি ! সেই হ’তে ছুটে চলি গিরি দরী মাঠ পল্লীর বাট সোজা বাঁকা শত গলি !
. -----কোন্ গ্রহ হ’তে ছিঁড়ি’ | উল্কার মত ছুটেছি বাহিয়া সৌর-লোকের সিঁড়ি ! আমি ছুটে’ যাই জানি না কোথায়, ওরা মোর দুই তীরে রচে নীড়, ভাবে উহাদেরি তরে এসেছি পাহাড় চিরে ! উহাদের বধূ কলস ভরিয়া নিয়া যায় মোর বারি, আমার গহনে গাহন করিয়া বলে সন্তাপ-হারী ! উহারা দেখিল কেবল আমার সলিলের শীতলতা, দেখে নাই ---- জ্বলে কত চিতাগ্নি মোর কূলে কূলে কোথা !
. হায় কত হতভাগী----- আমিই কি জানি-----মরিল ডুবিয়া আমার পরশ মাগি’ ! বাজিয়াছে মোর তটে-তটে জানি ঘটে ঘটে কিঙ্কিণী, জল-তরঙ্গে বেজেছে বধূর মধূর রিনিক ঝিনি | বাজায়েছে বেণু রাখাল-বালক তীর-তরুতলে বসি’ , আমার সলিলে হেরিয়াছে মুখ দূর আকাশের শশী ! জানি সব জানি, ওরা ডাকে মোরে দু’-তীরে বিছায়ে স্নেহ, দীঘি হতে ডাকে পদ্মমুখীরা, “থির হও বাঁধি’ গেহ |”
আমি বয়ে যাই----বয়ে যাই আমি কুলু-কুলু কুলু-কুলু, শুনিনা----কোথায় মোরই তীরে হায় পুরনারী দেয় উলু ! সদাগর-জাদী মণি-মানিক্যে বোঝাই করিয়া তরী ভাসে মোর জলে,-----‘ছল ছল’ ব’লে আমি দূরে যাই সরি’ ! আঁকড়িয়া ধ’রে দু’-তীর বৃথাই জড়ায়ে তন্ত্তলতা, ওরা দেখে নাই আবর্ত মোর, মোর অন্তর-ব্যথা !
লুকাইয়া আসে গোপনে নিশীথে কূলে মোর অভাগিনী, আমি বলি, চল্ ছল্ ছল্ ওরে বধূ তোরে চিনি ! কূল ছেড়ে আয় রে অভিসারিকা, মরণ-অকূলে ভাসি’ ! মোর তীরে-তীরে আজো খুঁজে’ ফিরে তোরে ঘর-ছাড়া বাঁশী ! . সে পড়ে ঝাঁপায়ে জলে, আমি পথে ধাই----সে কবে হারায় স্মৃতির বালুকা-তলে !
জানিনাক’ হায় চলেছি কোথায়অজানা আকর্ষণে, চলেছি যতই তত সে অথই বাড়ে জল খনে খনে | সন্মুখ-টানে ধাই অবিরাম, নাই নাই অবসর, ছুঁইতে হারাই ----এই আছে নাই----এই ঘর এই পর ! ওরে চল্ চল্ ছল্ ছল্ ছল্ কি হবে ফিরায়ে আঁখি ? তোরি তীরে ডাকে চক্রবাকের তোরি সে চক্রবাকী !
তোমার কন্ঠে রাখিযা এসেছি মোর কন্ঠের গান------ এইটুকু শুধু র’বে পরিচয় ? আর সব অবসান ? অন্তর-তলে অন্তর-তর যে ব্যথা লুকায়ে রয়, গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয় ?
হয় তো কেবলি গাহিয়াছি গান, হয় তো কহিনিকথা, গানের বাণী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা ? হৃদয়ে কখন জাগিল জোয়ার , তাহারি প্রতিধ্বনি কন্ঠের তটে উঠেছে আমার অহরহ রণরণি’---- উপকূলে ব’সে শুনেছ সে সুর, বোঝ নাই তার মানে ? বেঁধেনি হৃদয়ে সে সুর, দুলেছে দুল হ’য়ে শুধু কানে ?
. হায় ভেবে নাহি পাই---- যে-চাঁদ জাগালো সাগরে জোয়ার, সেই চাঁদই শোনে নাই ! সাগরের সেই ফুলে’ ফুলে’ কাঁদা কূলে কূলে নিশিদিন, সুরের আড়ালে মূর্চ্ছনা কাঁদে, শোনে নাই তাহা বাণ্ ? আমার গানের মালার সুবাস ছুঁলনা হৃদয়ে আসি’ ? আমার বুকের বাণী হ’ল শুধু তব কন্ঠের ফাঁসি ?
. বন্ধু গো যেয়ো ভুলে’----- প্রভাতে যে হবে বাসি, সন্ধ্যায় রেখো না সে ফুল তুলে’ ! উপবনে তব ফোটে যে গোলাপ---প্রভাতেই তুমি জাগি’ জানি, তার কাছে যাও শুধু তার গন্ধ-সুষমা লাগি’ | যে কাঁটা-লতায় ফুটেছে সে-ফুল, রক্তে ফাটিয়া পড়ি, সারা জনমের ক্রন্দন যার ফুটিয়াছে শাখা ভরি,------ দেখ’ নাই তারে !---- মিলন-মালার ফুল চাহিয়াছ তুমি’ তুমি খেলিয়াছ বাজাইয়া মোর বেদনার ঝুম্ ঝুমি !
ভোলো মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়, আমি শুধু তব কন্ঠের হার, হৃদয়ের কেহ নয় ! জানায়ো আমারে, যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি---- কন্ঠ পারায়ে হ’য়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি !