. আমি গাহি তারি গান---- দৃপ্ত-দম্ভের রে-যৌবন আজি ধরি’ অসি খরসান হইল বাহির অসম্ভবের অভিযানে দিকে দিকে | লক্ষ যুগের প্রাচীন মমির পিরামিডে গেল লিখে তাদের ভাঙার ইতিহাস-লেখা ! যাহাদের নিঃশ্বাসে জীর্ণ পুঁথির শুষ্ক পত্র উড়ে গেল এক পাশে ! যারা ভেঙে চলে অপ-দেবতার মন্দির আস্তানা, বক-ধার্মিক নীতি-বৃদ্ধের সনাতন তাড়ি-খানা | যাহাদের প্রাণ-স্রোতে ভেসে গেল পুরাতন জঞ্জাল, সংস্কারের জগদল-শিলা, শাস্ত্রের কঙ্কাল | মিথ্যা মোহের পূজা-মন্ডপে যাহারা অকুতোভয়ে এল নির্মম---মোহ-মুদ্গর ভাঙেনের গদা ল’য়ে | বিধি-নিষেধের চীনের প্রাচীরে অসীম দুঃসাহসে, দু’হাতে চালাল হাতুড়ি শাবল ! গোরস্থানেরে চ’ষে ছুঁড়ে ফেলে যত শব কঙ্কাল বসাল ফুলের মেলা, যাহাদের ভিড়ে মুখর আজিকে জীবনের বালু-বেলা |
. গাহি তাহাদেরি গান বিশ্বের সাতে জীবনের পথে যারা আজি আগুয়ান | ------
. --------সেদিন নিশীথ-বেলা দুস্তর পারাবারে যে যাত্রী একাকী ভাসালো ভেলা, প্রভাতে সে আর ফিরিল না কুলে | সেই দুরন্ত লাগি’ আঁখি মুছি আর রচি গান আমি আজিও নিশীথে জাগি’ আজো বিনিদ্র গাহি গান আমি চেয়ে তারি পথ-পানে | ফিরিল না প্রাতে যে-জন সে-রাতে উড়িল আকাশ-যানে নব জগতের দূর-সন্ধানী অসীমের পথ-চারী, যার ভয়ে জাগে সদা-সতর্ক মৃত্যু-দুয়ারে দ্বারী !
তোদের শুভ্র গায়ে হানে ওরা আপন গায়ের গলিত পাঁক, যার যা দেবার সে দেয় তাহাই, স্বর্গের শিশু সহিয়া থাক্ ! শাখা ভ’রে আনে ফুল-ফল, সেথা নীড় রচি’ গাহে পাখীরা গান, নীচের মানুষ তাই ছোঁড়ে ঢিল, তরুর নহে সে অসন্মান ! কুসুমের শাখা ভাঙে বাঁদরের উত্পাতে, হায়, দেখিয়া তাই---- বাঁদর খুশীতে করে লাফালাফি, মানুষ আমরা লজ্জা পাই ! মাথার ঘায়েতে পাগল উহারা, নিস্ নে তরুণ ওদের দোষ ! কাল হবে বা’র জানাজা যাহার, সে বুড়োর’ পরে বৃথা এ রোষ !
যে তরবারির পুণ্যে আবার সত্যেরে তোরা দানিবি তখ্ত্, ছুঁচো মেরে তার খোয়াস্ নে মান, ফুরায় এসেছে ওদের ওক্ ত্ ! যে বন কাটিয়া বসাবি নগর তাহার শাখার দু’টো আঁচড় লাগে যদি গা’য় স’য়ে যা না ভাই, আছে ত কুঠার হাতের’ পর !
যুগে যুগে ধরা ক’রেছে শাসন গর্বোদ্ধত যে যৌবন----- মানেনি কখনো, আজো মানিবে না বৃদ্ধত্বের এই শাসন | আমরা সৃজিব নতুন জগৎ, আমরা গাহিব নতুন গান, সম্ভ্রমে-নত এই ধরা নেবে অঞ্জলি পাতি মোদের দান ! যুগে যুগে জরা বৃদ্ধত্বেরে দিয়াছি কবর মোরা তরুণ---- ওরা দিক গালি, মোরা হাসি’ খালি বলিব “ইন্না-----রাজেউন !”
নিরন্ধ মেঘে অন্ধ আকাশ, অন্ধ তিমির রাতি, কূহেলি-অন্ধ দিগন্তিকার হস্তে নিভেছে বাতি’---- চলে পথহারা অন্ধ দেবতা ধীরে ধীরে এরি মাঝে, সেই পথে ফেলে চরণ----যে পথে কঙ্কাল পায়ে বাজে !
নির্যাতনের যে যষ্টি দিয়া শত্রু আঘাত হানে সেই যষ্টিরে দোসর করিয়া অলক্ষ্য পথ-পানে চলেছে দেবতা----অন্ধ দেবতা----পায়ে পায়ে পলে পলে, যত ঘিরে আসে পথ-সঙ্কট চলে তত নববলে ! . ঢ’লে পড়ে পথ’ পরে, নবীন মৃত্যু-যাত্রী আসিয়া তু’লে ধরে বুকে ক’রে !
অন্ধ কারার বন্ধ দুয়ারে যথায় বন্দী জাগে, যথায় বধ্য-মঞ্চ নিত্য রাঙিছে রক্ত-রাগে, যথায় পিষ্ট হ’তেছে আত্ম নিষ্ঠুর মুঠি-তলে, যথায় অন্ধ গুহায় ফণীর মাথায় মানিক জ্বলে, যথায় বন্য শ্বাপদের সাথে নখর দন্ত লয়ে জাগে বিনিদ্র বন্য-তরুণ ক্ষুধার তাড়না সয়ে, যথা প্রাণ দেয় বলির নরীরা যূপকাষ্ঠের ফাঁদে,---- সেই পথে চলে অন্ধ দেবতা, পথ চলে আর কাঁদে,----- . “ ওরে ওঠ্ ত্বরা করি’ তোদের রক্তে-রাঙা ঊষা আসে, পোহাইছে বিভাবরী |”
তিমির রাত্রি ছুটেছে যাত্রী নিরুদ্দেশের ডাকে, জানেনা কোথায় কোন্ পথে কোন্ ঊর্দ্বে দেবতা হাঁকে | শুনিয়াছি ডাক এই শুধু জানে ! আপনার অনুরাগে মাতিয়া উঠেছে অলস চরণ, সন্মুখে পথ জাগে ! জাগে পথ, জাগে ঊর্ধ্ব দেবতা, এই দেখিয়াছি শুধু, কে দেখে সে পথে চোরা বালুচর, পর্বত, মরু ধূ--ধূ !
ছুটেছে পথিক, সাথে চলে পথ, অমাণিশি চলে সাথে, পথে পড়ে ঢ’লে, মৃত্যুর ছলে ধরে দেবতার হাতে | . চলিতেছে পাশাপাশি----- মৃত্যু, তরুণ, অন্ধ দেবতা, নবীন ঊষার হাসি !