বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর "সন্ধ্যা"
থেকে কয়েকটি কবিতা
*
সন্ধ্যা , কাজী নজরুল ইসলাম


আমি গাহি তারি গান

.                        আমি গাহি তারি গান----
দৃপ্ত-দম্ভের রে-যৌবন আজি ধরি’ অসি খরসান
হইল বাহির অসম্ভবের অভিযানে দিকে দিকে |
লক্ষ যুগের প্রাচীন মমির পিরামিডে গেল লিখে
তাদের ভাঙার ইতিহাস-লেখা ! যাহাদের নিঃশ্বাসে
জীর্ণ পুঁথির শুষ্ক পত্র উড়ে গেল এক পাশে !
যারা ভেঙে চলে অপ-দেবতার মন্দির আস্তানা,
বক-ধার্মিক নীতি-বৃদ্ধের সনাতন তাড়ি-খানা |
যাহাদের প্রাণ-স্রোতে ভেসে গেল পুরাতন জঞ্জাল,
সংস্কারের জগদল-শিলা, শাস্ত্রের কঙ্কাল |
মিথ্যা মোহের পূজা-মন্ডপে যাহারা অকুতোভয়ে
এল নির্মম---মোহ-মুদ্গর ভাঙেনের গদা ল’য়ে  |
বিধি-নিষেধের চীনের প্রাচীরে অসীম দুঃসাহসে,
দু’হাতে চালাল হাতুড়ি শাবল !  গোরস্থানেরে চ’ষে
ছুঁড়ে ফেলে যত শব কঙ্কাল বসাল ফুলের মেলা,
যাহাদের ভিড়ে মুখর আজিকে জীবনের বালু-বেলা |


.                                     গাহি তাহাদেরি গান        
বিশ্বের সাতে জীবনের পথে যারা আজি আগুয়ান | ------                


.                            --------সেদিন নিশীথ-বেলা
দুস্তর পারাবারে যে যাত্রী একাকী ভাসালো ভেলা,
প্রভাতে সে আর ফিরিল না কুলে | সেই দুরন্ত লাগি’
আঁখি মুছি আর রচি গান আমি আজিও নিশীথে জাগি’
আজো বিনিদ্র গাহি গান আমি চেয়ে তারি পথ-পানে |
ফিরিল না প্রাতে যে-জন সে-রাতে উড়িল আকাশ-যানে
নব জগতের দূর-সন্ধানী অসীমের পথ-চারী,
যার ভয়ে জাগে সদা-সতর্ক মৃত্যু-দুয়ারে দ্বারী !



সাগর গর্ভে, নিঃসীম নভে, দিগদিগন্ত জু’ড়ে
জীবনোদ্বেগ, তাড়া ক’রে ফেরে নিতি যারা মৃত্যুরে,
মানিক আহরি’ আনে যারা খুঁড়ি’ পাতাল যক্ষপুরী,
নাগিনীর বিষ-জ্বালা সয়ে করে ফণা হ’তে মণি চুরি |
হানিয়া বজ্র-পাণির বজ্র উদ্ধত  শিরে ধরি,
যাহারা চপলা মেঘ-কন্যারে করিয়াছে কিঙ্করী !
পবন যাদের ব্যজনী দুলায় হইয়া আজ্ঞাবাহী,-----
এসেছি তাদের জানাতে প্রণাম, তাহাদের গান গাহি !
গুঞ্জরি ফেরে ক্রন্দন মোর তাদের নিখিল ব্যেপে-----
ফাঁসির রজ্জু ক্লান্ত আজিকে যাহাদের টুঁটি চেপে !
.                           যাহাদের কারাবাসে
অতীত রাতের বন্দিনী ঊষা ঘুম টুঁটি ঐ হাসে !

.                   **************



.                                                                             
পরে     

মিলনসাগর
*
সন্ধ্যা , কাজী নজরুল ইসলাম


জীবন-বন্দনা

.                                 গাহি তাহাদের গান----
ধরণীর হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান |
শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
ত্রস্তা ধরণীর নজ্ রানা দেয় ডালি ভ’রে ফুলে ফলে !
বন্য-শ্বাপদ-শঙ্কুল জরা-মৃত্যু ভীষণা ধরা
যাদের শাসনে হ’ল সুন্দর কুসুমিতা মনোহরা !
যারা বর্বর হেথা বাঁধে ঘর পরম অকুতোভয়ে
বনের ব্যাঘ্র মরুর সিংহ বিবরের ফণী লয়ে !
এল দুর্জয় গতি-বেগ সম যারা যাযাবর-শিশু
---তারাই গাহিল নব প্রেম গান ধরণী-মেরীর যিশু----
.                            যাহাদের চলা লেগে
উল্কার মত ঘুরিছে ধরণী শূন্যে অমিত বেগে !



খেয়াল-খুশীতে কাটি’ অরণ্য রচিয়া অমরাবতী
যাহারা করিল ধ্বংস সাধন পুনঃ চঞ্চলমতি,
জীবন-আবেগ রুধিতে না পারি’ যারা উদ্ধত-শির
লঙ্ঘিতে গেল হিমালয়,  গেল শুষিতে সিন্ধু-নীর !
নবীন জগৎ সন্ধানে যারা ছুটে মেরু-অভিয়ানে,
পক্ষ বাঁধিয়া উড়িয়া চলেছে যাহারা ঊর্ধ্ব পানে !
তবুও থামে না যৌবন-বেগ জীবনের উল্লাসে
চলেছে চন্দ্র মঙ্গল-গ্রহে স্বর্গে অসীমাকাশে |
যারা জীবনের পসরা বহিয়া মৃত্যুর দ্বারে দ্বারে
করিতেছি ফিরি, ভীম রণভূমে প্রাণ বাজি রেখে হারে |
আমি মর-কবি---গাহি সেই বেদে বেদুঈনদের গান,
যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান |
জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুণ উগ্রসুখে
সাধ ক’রে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে !
আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাব সম কোন বাধা মানিল না,
বর্বর বলি যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা,
কূপ-মন্ডুক “অসংযমী”র আখ্যা দিয়াছে যারে,
তারি তরে ভাই গান রচে যাই বন্দনা করি তারে !

.                   **************



.                                                                             
পরে     

মিলনসাগর
*
সন্ধ্যা , কাজী নজরুল ইসলাম

চল্    চল্     চল্

কোরাস :---

.        চল্   চল্   চল্ !
.        ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
.        নিম্নে উতলা ধরণী তল
.        অরুণ প্রাতের তরুণ দল
.        চল্  রে  চল্  রে  চল্
.                        চল্  চল্  চল্  ||



.        ঊষার দুয়ারে হানি’ আঘাত
.        আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,
.        আমরা টুটাব তিমির রাত,
.                     বাধার বিন্ধ্যাচল |
.        নব নবীনের গাহিয়া গান
.        সজীব করিব মহাশ্মশান,
.        আমরা দানিব নতুন প্রাণ
.                    বাহুতে নবীন বল |
.        চল্  রে নৌ-জোয়ান,
.        শোন্  রে পাতিয়া কান------
.        মৃত্যু-তোরণ-দুয়ারে-দুয়ারে
.                  জীবনের আহ্বান |
.        ভাঙ্ রে ভাঙ্ আগল,
.        চল্  রে চল্  রে চল
.                   চল্  চল্ চল্  ||

.        ঊর্ধ্বে আদেশ হানিছে বাজ
.        শহীদী-ঈদের সেনারা সাজ্,
.        দিকে দিকে চলে কুচ্ কাওয়াজ
.                   খোল্ রে নিদ্-মহল !
.        কবে সে খোয়ালি বাদ্ শাহী
.        সেই সে অতীত আজো চাহি’
.        যাস্ মুসাফির গান গাহি
.                   ফেলিস্ অশ্রুজল !
.        যাক্ রে তখ্ত্-তাউস
.        জাগ্ রে জাগে বেহুঁস !
.        ডুবিল রে দেখ্ কত পারস্য
.                  কত রোম গ্রীক রুষ |
.        জাগিল তারা সকল,
.        জেগে ওঠ্ হীনবল !
.        আমরা গড়িব নতুন করিয়া
.                   ধূলায় তাজমহল !
.                   চল্  চল্  চল্  ||

.                   **************



.                                                                             
পরে     

মিলনসাগর
*
সন্ধ্যা , কাজী নজরুল ইসলাম

যৌবন-জল-তরঙ্গ

এই যৌবন-জল-তরঙ্গ রোধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ ?
কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগনে যখন উঠেছে চাঁদ ?
যে সিন্ধু-জলে ডাকিয়াছে বান----তাহারি তরে এ চন্দ্রোদয়,
বাঁধ বেঁধে থির আজো নালা-ডোবা, চাঁদের উদয় তাদের নয় !
যে বান ডেকেছে প্রাণ-দরিয়ায়, মাঠে ঘাটে বাটে নেমেছে ঢল,
জীর্ণ শাখায় বসিয়া শকুনি শাপ দিক্ তারে অনর্গল |
সারস মারল ছুটে আয় তোরা ! ভাসিল কুলায় যে-বন্যায়
সেই তরঙ্গে ঝাঁপায়ে দুল্ রে সর্বনাশের নীল দোলায় !
খর-সেরোতজলে কাদা-গোলা ব’লে গ্রীবা নাড়ে তীরে জরদ্গব,
গলিত শবের ভাগাড়ের ওরা, ওরা মৃত্যুর কর স্তব !
ওরাই বাহন জরা-মৃত্যুর, দেখিয়া ওদের হিংস্র চোখ----
রে ভোরের পাখী  ! জীবন-প্রভাতে গাহিবি না নব পুণ্য-শ্লোক ?
ওরা নিষেধের প্রহরী পুলিশ, বিধাতার নয়----ওরা বিধির !
ওরাই কাফের, মানুষের ওরা তিলে তিলে শুষে প্রাণ-রুধির !


বল্ তোরা নবজীবনের ঢল ! হোক্ ঘোলা, তবু এই সলিল
চির-যৌবন দিয়াছে ধরায়ে, গেরুয়া মাটীরে করেছে নীল !
নিজেদের চারধারে বাঁধ বেঁধে মৃত্যু-বীজানু যারা জিয়ায়,
তারা কি চিনিবে----মহাসিন্ধুর উদ্দেশে ছোটে স্রোত কোথায় !
স্থাণু গতিহীন প’ড়ে আছে তারা আপনারে লয়ে বাঁধিয়া চোখ
কোটরের জীব, উহাদের তরে নহে উদীচীর ঊষা-আলোক !


আলোক হেরিয়া কোটরে থাকিয়া চ্যাঁচায় প্যাঁচারা, ওরা চ্যাঁচাক |
মোরা গা’ব গান, ওদের মারিতে আজো বেঁচে আছে দেদার
.                                                          কাক !
জীবনে যাদের ঘ’নাল সন্ধ্যা, আজ প্রভাতের শুনে আজান,
বিছানায় শুয়ে যদি পাড়ে গালি, দিক গালি-----তোরা দিস্ নে
.                                                         কান |
উহাদের তরে হ’তেছে কালের গোরস্থানে রে গোর খোদাই,
মোদের প্রাণের রাঙা জল্ সাতে জরা-জীর্ণের দাওত নাই |


জিঞ্জির-পায়ে দাঁড়ে ব’সে টীয়া চানা খায় ; গায় শিখানো বোল,
আকাশের পাখী !   ঊর্ধ্বে উঠিয়া  কন্ঠে নতুন লহরী তোল্  !
তোরা ঊর্ধ্বের----অমৃত-লোকের, ছুঁড়ুক নীচেরা ধূলাবালি,
চাঁদেরে মলিন করিতে পারে না কেরোসিনী ডিবে কালি ঢালি’
বন্য-বরাহ পঙ্ক ছিটাক, পাঁকের ঊর্ধ্বে তোরা কমল,
ওরা দিক কাদা, তোরা দে সুবাস, তোরা ফুল------ওরা পশুর
.                                                         দল !

তোদের শুভ্র গায়ে হানে ওরা আপন গায়ের গলিত পাঁক,
যার যা দেবার সে দেয় তাহাই, স্বর্গের শিশু সহিয়া থাক্ !
শাখা ভ’রে আনে ফুল-ফল, সেথা নীড় রচি’ গাহে পাখীরা গান,
নীচের মানুষ তাই ছোঁড়ে ঢিল, তরুর নহে সে অসন্মান !
কুসুমের শাখা ভাঙে বাঁদরের উত্পাতে, হায়, দেখিয়া তাই----
বাঁদর খুশীতে করে লাফালাফি, মানুষ আমরা লজ্জা পাই !
মাথার ঘায়েতে পাগল উহারা, নিস্ নে তরুণ ওদের দোষ !
কাল হবে বা’র জানাজা যাহার, সে বুড়োর’ পরে বৃথা এ রোষ !


যে তরবারির পুণ্যে আবার সত্যেরে তোরা দানিবি তখ্ত্,
ছুঁচো মেরে তার খোয়াস্ নে মান, ফুরায় এসেছে ওদের ওক্ ত্ !
যে বন কাটিয়া বসাবি নগর তাহার শাখার দু’টো আঁচড়
লাগে যদি গা’য় স’য়ে যা না ভাই, আছে ত কুঠার হাতের’ পর !


যুগে যুগে ধরা ক’রেছে শাসন গর্বোদ্ধত যে যৌবন-----
মানেনি কখনো, আজো মানিবে না বৃদ্ধত্বের এই শাসন |
আমরা সৃজিব নতুন জগৎ, আমরা গাহিব নতুন গান,
সম্ভ্রমে-নত এই ধরা নেবে অঞ্জলি পাতি মোদের দান !
যুগে যুগে জরা বৃদ্ধত্বেরে দিয়াছি কবর মোরা তরুণ----
ওরা দিক গালি, মোরা হাসি’ খালি বলিব “ইন্না-----রাজেউন !”

.                   **************



.                                                                             
পরে     

মিলনসাগর
*
সন্ধ্যা , কাজী নজরুল ইসলাম

অন্ধ  স্বদেশ-দেবতা

.                    ফাঁসির রশ্মি ধরি’
আসিছে অন্ধ স্বদেশ-দেবতা, পলে পলে অনুসরি’
মৃত্যু-গহন-যাত্রীদলের লাল পদাঙ্ক-রেখা !
যুগযুগান্ত-নির্জিত-ভালে নীল কলঙ্ক-লেখা !


নিরন্ধ মেঘে অন্ধ আকাশ, অন্ধ তিমির রাতি,
কূহেলি-অন্ধ দিগন্তিকার হস্তে নিভেছে বাতি’----
চলে পথহারা অন্ধ দেবতা ধীরে ধীরে এরি মাঝে,
সেই পথে ফেলে চরণ----যে পথে কঙ্কাল পায়ে বাজে !


নির্যাতনের যে যষ্টি দিয়া শত্রু আঘাত হানে
সেই যষ্টিরে দোসর করিয়া অলক্ষ্য পথ-পানে
চলেছে দেবতা----অন্ধ দেবতা----পায়ে পায়ে পলে পলে,
যত ঘিরে আসে পথ-সঙ্কট চলে তত নববলে !
.                   ঢ’লে পড়ে পথ’ পরে,
নবীন মৃত্যু-যাত্রী আসিয়া তু’লে ধরে বুকে ক’রে !



অন্ধ কারার বন্ধ দুয়ারে যথায় বন্দী জাগে,
যথায় বধ্য-মঞ্চ নিত্য রাঙিছে রক্ত-রাগে,
যথায় পিষ্ট হ’তেছে আত্ম নিষ্ঠুর মুঠি-তলে,
যথায় অন্ধ গুহায় ফণীর মাথায় মানিক জ্বলে,
যথায় বন্য শ্বাপদের সাথে নখর দন্ত লয়ে
জাগে বিনিদ্র বন্য-তরুণ ক্ষুধার তাড়না সয়ে,
যথা প্রাণ দেয় বলির নরীরা যূপকাষ্ঠের ফাঁদে,----
সেই পথে চলে অন্ধ দেবতা, পথ চলে আর কাঁদে,-----
.                     “ ওরে ওঠ্ ত্বরা করি’
তোদের রক্তে-রাঙা ঊষা আসে, পোহাইছে বিভাবরী |”



তিমির রাত্রি ছুটেছে যাত্রী নিরুদ্দেশের ডাকে,
জানেনা কোথায় কোন্ পথে কোন্ ঊর্দ্বে দেবতা হাঁকে |
শুনিয়াছি ডাক এই শুধু জানে ! আপনার অনুরাগে
মাতিয়া উঠেছে অলস চরণ, সন্মুখে পথ জাগে !
জাগে পথ, জাগে ঊর্ধ্ব দেবতা, এই দেখিয়াছি শুধু,
কে দেখে সে পথে চোরা বালুচর, পর্বত, মরু ধূ--ধূ  !



ছুটেছে পথিক, সাথে চলে পথ, অমাণিশি চলে সাথে,
পথে পড়ে ঢ’লে, মৃত্যুর ছলে ধরে দেবতার হাতে |
.                    চলিতেছে পাশাপাশি-----
মৃত্যু, তরুণ, অন্ধ দেবতা, নবীন ঊষার হাসি !

.                   **************



.                                                                             
পরে     

মিলনসাগর