কবি রঘুনাথ দাস-র গান
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
কদম্বতলে কে গো বংশী বাজায় |
এত দিন আসি যমুনা-জলে,
আমি এমন মোহন মুরতি কখনো,
দেখিনি এসে হেথায় ||
অঙ্গ অগৌর-চন্দনচর্চিত,বনমালা গলায় ;
গুঞ্জ বকুলের মালে,
বাঁধিয়াছে চূড়া, ভ্রমরা গুঞ্জরে তায় |
সই, সজল নব জলদবরন, ধরি নটবর বেশ--
চরণ উপরে থুয়েছে চরণ, এই কি রসিক শেষ |
চন্দ্র চমকে, চলিতে চরণ, নখরের ছটায় ;
আমার হেন লয় মন, জীবন যৌবন,
সঁপিব ও রাঙা পায় ||
তোরা দেখিবি লো যদি সখি! আয় আয় আয়
হায়! অনুপম রূপমাধুরী সখি!
হেরিলাম কী ক্ষণে--প্রাণ নিলে হরে,
ঈষৎ হেসে, বঙ্কিম নয়নে |
মন্দ মধুর মুচকি হাসি চপলা চমকায় :
কুলবতীর কুলশীল, গেল গেল,
মন মজিল হেরে উহায় ||
সই, অলকা-আবৃত বদন, তাহে মৃগমগ তিলক,
মনোহর সাজ, নাসাগ্রেতে গজমুকুতার ঝলক |
বিম্ব অধরে অর্পয়ে বেণু, সে রবে ধেনু চরায় ;
কীবা সুন্দর সুঠাম, ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিম,
রূপে ভুবন ভুলায় |
সই, বেষ্টিত ব্রজবালক সবে,
কী শোভা আ মরি হায়!
গগনেতে তারাগণ-মাঝে,
চাঁদ যেন শোভা পায় |
সই, কেন বা আপন খেয়ে, আইলাম যমুনায়!
হেরে পালটিতে আঁখি, নাহি পারি সখি !
রঘু কহে একী দায় ||



.                   ****************                                                       
উপরে


মিলনসাগর
*
.        কেমন বিচার করো কৃষ্ণ দেখব তাই ||
.        পাঠালেন জানতে ব্রজের রাজা রাই ||
.        বৃন্দে সভামধ্যে, কহিছে নিসাধ্যে,
.                কৃষ্ণে করিয়ে প্রণাম---
.                এলাম বৃন্দাবন ধাম হতে,
.        রাধার সঙ্গিনী আমি হে শ্যাম !
.        দেখলাম তব রাজ্যের শিক্ষা---
.        আমি আজ করব তার পরীক্ষা |
.        কচ্ছ রাজ্য ভালো, নব্য ভূপাল,
.        সুখ্যাতি শুনি হে সর্ব ঠাঁই ||
.        শুনেছি তব রাজ্যে অবিচার নাই |
.        ধন মন প্রাণ সঁপেছে যে যার ---
.        সে জন পায় কি তারে নাহি পায় ?
.        সূক্ষ্ম বল আছে, ধর্ম সহে ভার,
.        মর্মে ব্যথা  যেন নাহি পাই ||
.        দেখো সত্য ত্রেতা যুগে, যে যে হে আগে,
.                        জন্মেছিল ভূপতি ;
মান্ধাতা সগর,                                শ্রীরাম রঘুবর,
.                কার্তবীর্যার্জুন প্রভৃতি |
সে সব রাজন,                        প্রজার পালন,
.                করত যে ধর্ম বিচার ;
.                তুমি রাজ্য অধিপতি হয়ে,
.           বিচার করছ বলো কী প্রকার ||
.           রাধার মধুর প্রেমের বিষয়---
.          কী বিচার করলে বলো দয়াময় !
.        ন্যায্য বিষয়েতে অন্যায় কোরো নাকো,
.        কর্তা তুমি, তোমারই দোহাই ||
.        আমরা এই তো সবে জানি, ধর্ম না মানি,
.        পাপ করে যে প্রজা---
.        শাস্ত্র বিচারি, হয়ে দন্ডধারী,
.        দন্ড করে তারে রাজা |
.        আপনি রাজা হয়ে, নাহি বিচারিয়ে,
.                যদ্যপি কর কুনীত ;
.                 সব মন্ত্রী সহ বিবেচনা করো,
.                ভাবো না হে, যে হয় বিহিত |
.        কুলশীল সব করে পরিত্যাগ,
.        করেছে যে যার প্রতি অনুরাগ |
.        সে যদি হে তারে, বঞ্চনা করে,
.        তার কী দন্ড হবে শুধাই ||
আমার আরো হে, এক যে জিজ্ঞাসা আছে,
.        কও কপট ত্যজিয়ে--- অক্রূর উদ্ধব,
.                                সুমন্ত্রী লয়ে সব,
.        মন্ত্রণা স্থির করিয়ে |
.        আপনি শ্রীমুখেতে, বলেছে কুঞ্জেতে,
.        সর্ব-সখী-সন্নিধান ;
.        রস বৃন্দাবন, পরিহরি হরি,
.        যাবো না হে অন্য স্থান |
.        আপনার মুখে করে অঙ্গীকার,
.        যদি কেউ অন্যথা করে তার |
.        মিথ্যাবাদী সে জন, হয় কি না হয় হে,
.        ওই শ্রীমুখে একবার, শুনতে চাই ||
.        তুমি যে বিচার করি, এসে হে মুরারি |
.                ব্রজবাসীর প্রতি ;
.        সে সব বিচার, করব যে প্রচার,
.          আজ এ সভাতে ভূপতি !
.        আরো যে আছে কথা, মরণের ব্যথা,
.                সত্য করিবে বিচার ;
.          করে হে ত্যাগ যে পিতামাতায়,
.             বলো তার দন্ড কী প্রকার ?
.             শুনি দাস রঘু সত্য কয়---
.          এইবার বুঝব রাজা মহাশয় !
.         বৃন্দে দূতীর সব সন্ধ করো দূর,
.            বৃন্দাবনে গিয়ে গুণ গাই ||
.        তোমার এই কি ধর্ম ওহে দয়াময় ?
.        পর রাজ্যে পর ভার্যে সুখোদয় ||
.         স্বেচ্ছাময় হরি,     আসি মধুপুরী,
.                 করলে যে লীলা প্রকাশ ;
.          তোমার কর্ম তোমারে যে সাজে,
হয় অন্য জনার উপহাস, ভালো তো হে বনমালি,
.        মথুরায় করতেছ ঠাকুরালি |
.        কংস ধ্বংস করি, অংশ লয়ে তার,
.                উগ্রসেনে দিলে সমুদয় !
.        রাজনীত-কৃত কর্ম তো এমতো নয় !
.        কার ধন কারে করো সমর্পণ !
.        ভূপতির ধর্ম কর্ম এ কেমন ?
.        শ্রীমতী রাধার, প্রেমভান্ডার ভাঙিয়ে,
.                সব দিলে তুমি কুবুজায় ||
.        যখন, বৃন্দাবনে ছিলে, করতে যে লীলে,
.                সব তো জানি হে হরি---
.         রাধা রাধা নাম, করিয়ে অবিশ্রাম,
.                কুঞ্জেতে বাজাতে বাঁশরি |
.        রাধা ধ্যান জ্ঞান, রাধাগত প্রাণ,
.                ছিলে হে রাধার সহিত ;
.                এক ক্ষণ রাধায় না দেখিলে,
.                হতে হে চৈতন্য-রহিত |
.                সে সব তার করিয়ে পীতবাস |
.                আপনি আপনার সাধ পুরালে,
.                রাইকে করে এলে নিরাশ্রয়  ||
.                কত রঙ্গ, জান হে ত্রিভঙ্গ !
.                তোমার ভঙ্গি বুঝিতে নারি |
.সৃষ্টি-স্তিতি-লয়, কটাক্ষে সব হয়,কী কখন করো হরি
.        কায় বা রাখ সুখে, কেহ মরে দুখে,
.                কৃষ্ণ, তোমারই স্বেচ্ছায়  |
.                করে বৃন্দাবনে মহাপ্রলয়,
.        হল সৃষ্টি আসি মথুরায় |
.        আর সেই নিজ রস বৃন্দাবন,
.        একবার করলে না হে নিরীক্ষণ |
.        সৃষ্টি করে সব সংহারিলে হে,
.        কৃষ্ণ, হয়ে কঠিন হৃদয় ||


.                   ****************                                                       
উপরে


মিলনসাগর
*
কীসে এ প্রাণবিহঙ্গ বাঁচে বলো!
কৃষ্ণের আশালতা যদি ভাঙিল ||
করি মর্মচ্ছেদ, দারুণ সংবাদ,
বৃন্দে শুনালে আমায় ;
শুনে শূন্য হল মম দেহ,
দেহে প্রাণ তো রাখা হল দায় ||
হায়! হায়! হায়রে! সুখের পিঞ্জর |
বিনা সুখ দুঃখে হতেছে জর্জর |
শ্যাম তমালতরু আশ্রয় বিনে,
যত গোপিকা নৈরাশ হল |
ফুরাল গো ব্রজে, কৃষ্ণলীলা ফুরাল |
হায়! হবে বন, এবে বৃন্দাবন ;
বিনা সে জীবনধন, না রবে জীবন |
লতা হল তরুহীন, বারিহীন মীন ;
কী দুর্দিন, ফণী মণি হারাল ||


.          ****************      
                                                         উপরে


মিলনসাগর