তুই যখন বাচ্চা ছিলি "রাজহাঁস" কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
তুই যখন বাচ্চা ছিলি, ঝুড়ি ঢেকে রেখেছি উঠোনে, রোদ্দুরে চোখ থেকে পড়শির মুখ থেকে দূরে, তোর বিশ্রী শরীরের কী রকম নিন্দে র’টে যেতো, পালক ছিলো না, তুই সুন্দর ছিলি না, তোর কাছে ও বাড়ির হুলো নাকি ঘুরঘুর করতো সারাক্ষণ, তাছাড়া রাত্রির ঝোপে ওঁৎ পেতে ছিলো যে শেয়াল তারও দফা রফা হ’লো এ হাতের দেয়া সেঁকোবিষে, ছোটোখাটো হাঁস থেকে রাজহংস হ’লি তো সেদিন !
এখন শরীরে তোর দক্ষিণের বাতাস জেগেছে, নানা কান্ডকারখানা জনস্বার্থে গোপন রেখেছি, এখন কোথাও তোর আসা যাওয়া নিষেধ মানে না, তোর জন্য বন্ধুরাও বয়কট করেছে আমাকে | এখন নিজেকে যেন ঠিক মত চিনতেও পারি না, জ্যোত্স্নায় উঠোনজোড়া তোর ছায়া গিলছে আমাকে |
তখনো ডাকেনি পাখি "রাজহাঁস" কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
তখনো ডাকেনি পাখি, নীল হলো চারিদিক, তুমি বানানো খাঁচার মধ্যে বড্ড বেশি ছটফট কর, কাঁচা ঘুম নষ্ট ক’রে উঠে এসে দোর ঘুলে দেই, একবারও না তাকিয়ে সটান দিঘিতে চ’লে যাও | বন্ধুরা ‘পুষেছো কেন’ ‘কী লাভ’ ইত্যাদি উপদেশে তোমাকে আমার কাছে পর ব’লে রটিয়ে বেড়ায়, মনে মনে একটু হেসে আনমনে দেশলাই জ্বালি সিগারেট জ্বলে আর জ্বলে ওঠে নীল অন্ধকার |
সেই কবে সন্ধ্যে হবে আবার নীলের সরোবরে ফিরে আসবে, কাজ সেরে তারাতাড়ি চ’লে আসি আমি চূড়ান্ত চুনকাম দেখি, শ্বেতবর্ণ হবার তাগিদ বোধ করি, বোধ করা করানোয় অনেক তফাৎ অনেকেই বোধ করে, তার বেশি কিছুই করে না, একাত্ম হয় না তাই করে না, এছাড়া কোনো সদুত্তর নেই
বড় মৃদু বিষক্রিয়া "রাজহাঁস" কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
বড় মৃদু বিষক্রিয়া, ছোট ঢেউ, ঢেউয়ের ছায়ায় জলের তরঙ্গ-ভাঙা রূপ, তাও সহ্যহতে পারে, কিন্তু তিলে তিলে এই গড়া, তীব্র মাধুর্য রচনা তোমার খেয়ালে ফের ভেঙে ফেলা, একি কোনো রীতি, তুমি খেলা ভালোবাসো, আসক্তিবিহীন ছচ্ছল জলময় সন্তাপের কন্ঠলগ্ন বৈরাগ্যের স্তব্ধতা তুমি পারো, মানুষের বুকে কভু মানুষ পারে না প্রীতিস্তব্ধ | মানুষের অন্য রূপ স্নিগ্ধ ভালোবাসা |
ধমীনিতে তাই মৃদু ঢ’লে পড়া, কারণ তোমার বৈরাগ্যের চেয়ে কোনো তীব্রতম হলাহল নেই এই যদি রচনার শিরোনাম, যদি আমাদের গড়া ও ভাঙার মধ্যে তিলমাত্র শোক নেই, তবে কেন এলে অপরাহ্নে ভোরের শ্বেতাঙ্গ কলরোলে সেও কি প্রস্তাব, কিংবা ঔদাসীন্যে স্খলিত তটিনী !
যেমন রাজন্যবর্গ কোলাহলে পদযাত্রা করে "রাজহাঁস" কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
যেমন রাজণ্যবর্গ কোলাহলে পদযাত্রা করে সাম্রাজ্য প্রসারে, কিন্তু পড়ন্ত নক্ষত্রে তার ধ্বনি ----- যেমন যৌবন যায় সরসী নীরে ও ছায়াতলে, রূপাতীত বিস্ময়ের পাদদেশে সমবেত হয় সেইসব পরাক্রান্ত নরপতি, তাদের কঙ্কালে ঘাসের সমাধিস্তম্ভে উল্কাপাতে বিরতি ঘনায়----
তুমি সেই পদযাত্রা আপন শরীরে নিয়ে কাল ঝিলের গহন থেকে কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলে, যবে অন্ধকার এলো, ক্ষিতিতল সিক্ত হোলো, আর রক্তে ও নক্ষত্রে মৃদু মন্থর গমন ছলে তুমি সামাজিক উচাটন স্তব্ধ ক’রে ফিরে যাও, যেন দাম্ভিক নৃপতি তার জয়োল্লাসে রাজধানী মুখে : তেমনি কোনো হন্তারক আয়োজন আমারও শরীরে বোধ করো, ধ্বনি আসে প্রতি স্তরে, বিজয়াভিযানে |
সূর্যের শাসন থেকে চুরি-করা "রাজহাঁস" কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
সূর্যের শাসন থেকে চুরি-করা ছায়ার আড়ালে স্বতন্ত্র সৌন্দর্যরাশি ঝ’রে যায় অপরাহ্ন বেলা, মাছেরা গভীর দেশ বাস করে, অঙ্গুরী হারালে অরণ্যে বিজনপথে নিজস্ব পরিধি-মগ্ন খেলা শুরু হয় মত্স্যাধম রীতিনীতি অনায়ত্ত থাকে ; অলোকসামান্য কোনো বিভা নেই, বড্ড অভিমানী, জেনে গেছো, শুধুমাত্র পদচিহ্ন পড়েছে বিপাকে,---- প্রণত বিকচ কান্তি পালকের সিক্ত রূপখানি |
জেনেছি জীবন তবু মহাকাব্যে খন্ডিত বিস্ময়, নিখিল নিসর্গ কিংবা ছত্রাকার মানবসমাজ অভিনব বৃত্তিগুলি নষ্ট করে, নিবৃত্তির দিকে আপনাকে নিয়ে যায়, সন্ন্যাসীতে ছেয়ে যায় দেশ, অথচ সৌন্দর্যটুকু সন্ন্যাসের উল্টো দিকে রয়--- সে কেবল তুমি পারো, সংগ্রামই তো চিত্তবিনোদন |
ঈশ্বরের কাছে থেকে ফুল হয়ে উত্সবে এসেছো "রাজহাঁস" কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
ঈশ্বরের কাছে থেকে ফুল হয়ে উত্সবে এসেছো, উল্কার ওড়ানো রাত্রি সমস্ত ধারণা শেষ করে আমার সর্বস্ব নিয়ে যন্ত্রণাকে জাগিয়ে ফিরেছে, তোমার পালকে শুধু গার্হস্থ্যের দীর্ঘায়ু অর্চনা কেবল ঘূর্ণির টানে ডালপালা উড়িয়ে আবার স্বস্থানে আলোকরাত্রি যাপন করেছি স্মৃতিময় এত কথা জেগেছিলো, এত লোকবৃত্ত ছিলো শেষে পুরোনো কথার নীচে অগ্নিমালা উদাসীন হোলো
ভেবেছি তোমার কাছে রিক্ত পাত্রে শব্দ হয়ে যাবো ধাতব ঝংকার তুলে চলে যাবো দক্ষিণে উত্তরে বেশিদিন থাকবো না অতিথির কোমলতা নিয়ে ফুরাবে যখন আয়ু ঘুণাক্ষর বসতি বানাবো ঈশ্বরের কাছ থেকে ঘুম নিয়ে আমাতে এসেছো শুধুই রাত্রির নীচে খেলনাগুলি কুড়িয়ে বেড়াবো---
চোখের পিপাসা রেখে দীর্ঘ বেলা অবসিত হোলো "রাজহাঁস" কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
চোখের পিপাসা রেখে দীর্ঘ বেলা অবসিত হোলো এখন বাসার মধ্যে পালকের মর্মজ্ঞ করুণা ঘুমের ভিতরে কিছু প্রজাপতি ডানার স্পন্দনে রঙ মেখে বাতাসের গোপন ভান্ডারে জমা করে একে একে ঝরে পড়ে দেবতার দুহাতে কামিনী তুমি তো বিরাম চাও বিরতির আড়ালে কখন ফুটে ওঠো পুষ্পব্যথা শেষ করে সমস্ত পঠন হলুদ বরণ কান্তি ঐশ্বর্যের লবঙ্গলিপিকা, আমাদের সত্য ছিলো গায়ে মুখে পায়ের পাতায় মিলেমিশে ধরে রাখি বিশ্বাসের ধর্ম ও ধরণী আমাদের শেষ নেই, যে কোনো শেষের শেষ টানে বেরিয়ে এসেছি একা মহাবোধে গার্হস্থ্য নিবাসে, তোমাকে দুচোখে রেখে ত্রাণ মান অভিপ্রায় ছিলো ছিলো সে মুহূর্তকথা তীর্থকালে উড়ন্ত দিবসে ----
নদীকে কোনো প্রশ্ন কোরো না, তার উত্তর তুমি সহ্য করতে পারবে না --- কারণ তুমি প্রবাহমান নও |
সমুদ্রকে তুমি কোনো প্রশ্ন কোরো না, তুমি লবণাক্ত হলেও দিগন্তস্পর্শী নও |
পর্বতমালাকে কোনো প্রশ্ন কোরো না, তুমি তার মত অবিচলিত নও |
তুমি বন্ধুকে কোনো প্রশ্ন কোরো না, কারণ তোমার সমগ্রতা এখনো দ্বিধাহীন নয় |
তবুও একদিন না একদিন কোনো শ্রাবণরাত্রে আকাশ উজার করা শূন্যতার মধ্যে বা কোনো হৃদয়বিদারক ঊষালগ্নে তোমাকে প্রশ্ন করতে হবে ---- নদীকে সমুদ্রকে পর্বতকে মানুষকে |
হাতে সুরমন্ডল নিয়ে ডেকে বলতে হবে---- তোমাকে শুশ্রূষা দিতে আমি প্রস্তুত |