কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্যর কবিতা
গতিস্তব
কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য

ইতিহাস জলাভূমি |
কচুরিপানার নীচে
শ্যাওলা জড়ানো জোঁক---
বিষধর রয়েছে অঢেল----
দাঁত দিয়ে জিহ্বা ঢেকে রাখে |
ঘরে ও বাইরে চরাচরে
শস্যক্ষেত, শীতের আগুনে
স্পর্ধিত নেতৃত্ব দেয় মাতব্বর,
কৌশল শানায়---
বলে শুদু আমাকেই দেখো
জেনে রাখো, তোমাকে দেখিনা |

তোমার চেয়েও দামি
হিরণ্যস্তবক আছে বুকে |
ইতিহাসে স্থান নেই তার,
পাতায় পাতায় কাদামাখা
মোড়লের পদচ্ছাপ, আর নয়
এবার ঘোরাও চাকা---
আনো মহাগতিবেগ
জ্যোতিষ্ক সমাজ টেনে আনো
উল্কার প্রবল দীপ্তি, জ্বলে যাক
স্বার্থ ও শাঠ্যের সমন্বয়  |

ফুলের ফোটার কাল এসে গেলে
কেউ যে মানে না তা নয়,
কিন্তু তবু পাপড়ি ও পরাগ ছেঁড়া
যে সব বৃত্তান্তকথা তৈরি হয়-----

.        ****************                 
.                                                                            
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
বুকপকেটে
কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য

বাঁ পকেটে খামের মুখ, খোলা হয়নি স্বর ;
মাথার ভিতর অসমতলে তীক্ষ্ণ মহানগর,
দুরকমের বৃষ্টি আসে ঘ্যানঘ্যানে ঝমঝম,
ভস্ম হয়ে যাবার আগে একটু গরম কম |

সন্ততিরা সঠিক স্থানে মুখ লুকিয়ে চুপ,
খোকার জন্য মোটর গাড়ি, মায়ের জন্য ধূপ,
হৃদপিন্ডটি টাটকা আছে ফুসফুসেতে দাগ,
রাগের দিকে কান পেতে রই, জানাই অনুরাগ |

যদিও গায়ে গেঞ্জি আছে বুকের বোতাম খোলা,
বুলেটপ্রুফ ছিলো না রাত স্থির বাথানিটোলা,
উনিশ গেলে একুশ আসে জাগরণের নিয়ম,
মানুষ যদি অস্ত্র হতো জব্দ হতো যম |

এই শ্রাবণে আসবে বলে জাগিয়েছিল সাড়া,
সেই পত্রটি এবার এল ভুবন বাক্যহারা,
হাতের লেখার ধরণ দেখে পত্রবয়ান বুঝি,
চিঠির গায়ে রক্তছোপ ---- ব্যস্ত আঙুল খুঁজি  |

খোঁড়ার ফলে বাজল বেহুঁস আরণ্যক ধ্বনি,
সারাদিনটা শুক্রবার, রাত্রিশেষে শনি,
নিদ্রাহীনের বন্ধু হলো অন্তবিহীন দাহ,
খাম খুলে যেই পড়তে গেলাম স্তব্ধ খাজুরাহো |

.                ****************                 
.                                                                            
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
setstats
চেয়ার
কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
শ্যামলকান্তি দাশ ও পীতম ভট্টাচার্য সম্পাদিত, ২০০৩সালে প্রকাশিত, “দুই বাংলার
আবৃত্তির সেরা কবিতা” সংকলন থেকে নেওয়া। কবিতাটি আমরা তুলেছি খ্যতনামা
বাচিক শিল্পী এবং সঞ্চালিকা স্বপ্না দের অনুরোধে, ১৬-৯-২০১৮ তারিখে।


আমাদের বাড়িতে একটা জান্তব এবং আজ্জব
চেয়ার আছে।

ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলের বিলিতি চেয়ার।
কারুকার্যখচিত এবং বেশ আঁটঘাট বাঁধা এবং
মজবুত।

সাতচল্লিশ সালে চেয়ারটা দুচার জনের
মাথায় চাপিয়ে দিয়ে তেনারা চ’লে গেলেন।
তবে সুখের বিষয় কিছুদিন যাবৎ
চেয়ারটায় বেশ ঘুন ধরেছে।
চেয়ারটার একটা বৈশিষ্ট্য আছে।

যে কেউ সেটাতে বসে সে-ই মাতব্বর হয়ে যায়
এবং তার শিঙ গজায়।
আর শিঙ গজালে
গুঁতোবার প্রশ্নটি এসে যায়।

আমাদের যৌথ পরিবার এবং বেশ বড়ো।
স্বীকার করতে আপত্তি নেই যে এতবড়
পরিবারে অশান্তির শেষ নেই। কিন্তু তবুও
ভুলেও কখনো চেয়ারটার ধার পাশ মাড়াই না।

কিন্তু পাড়ার কিছু লোকের চেয়ারটার উপর
লম্পট লোভ আছে।

এদের তিনভাগে ভাগ করা যায়।
একদল রাস্তায় হাঁটার সময় ডান দিকে হাঁটে,
অন্য দল বাঁ দিকে,
আরেকদল আছে তারা রাতারাতি
দল পাল্টে নেয়।

কিন্তু আরেকটা দল আছে যারা
চেয়ারটাকে ভাঙতে চায়।

এদের মধ্যে শেষ দলটিকে বাদ দিলে---
বাকি সব পন্থীদের লোলুপ চোখ
চেয়ারটাকে দিন রাত চেটে যাচ্ছে।

একদিন একদল এসে ঘোষণা করলো
“চেয়ারটা আমাদের ব্যবহার করতে দিন---
আমাদের শপথ রইলো---
আপনাদের পরিবারের
সব সমস্যার সমাধান করে দেবো।”
আমরা সাবধান করে দিলাম---
“শিঙ গজাবে কিন্তু।”
তারা গ্রাহ্য করল না।

ওদের যে নেতা বেশ হৃষ্টপুষ্ট---
গালে মসুর ডালের মতো একটা
আঁচিল আর সেই প্রথমে চেয়ারটায়
বসতে আরম্ভ করল। এবং বসেই
নির্ভেজাল মাতব্বরি শুরু করে দিলো।
এবং কিছুদিনের মধ্যেই---অনিবার্য ভাবে তার
কপালের দুদিকে দুটো ঢিবি দেখা দিলো।
ক্রশ দুটো সিঙ গজালো এবং লোকটা
কিছুদিন আধ্যাত্মিক আনন্দে আয়নায়
নিজের চেহারা দেখলো, তারপর সামনে যাকে পায়
গুঁতোতে আরম্ভ করলো। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই
দলের বদনাম শুরু হোলো, তারা অগত্যা
চেয়ারটা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে সরে পড়লো।

এবার অন্যদের পালা। এরা কিন্তু বেজায় ধূর্ত এবং
কৌশলবাজ। এরা আমাদের বললো---
“দেখুন আপনাদের বিরাট যৌথ পরিবার---
সমস্যার অন্ত নেই। আপনাদের মধ্যে যাতে
আংশিক শান্তি আসে তার ব্যবস্থা আমরা নিশ্চয়ই
করব। চেয়ারটা আমাদের দিন। আমরা
আপনাদের ফুলের মধু খাওয়াবো,
‘জ্যোত্স্না রাতে সবাই গেছে বনে’
গাইতে গাইতে আমরা রাতকে দিন বানাবো।”

আমরা খুশি হয়ে চেয়ারটা তাদের দিলাম এবং
দেবার সময় শিঙ গজাবার কথাটা বললাম---
“আমরা ওদের মতো নই, চেয়ারে বসাটাই
আমাদের একমাত্র লক্ষ্য নয়, আমাদের একমাত্র
উদ্দেশ্য আপনাদের বহুজাতিক পরিবারে আংশিক
শান্তি আনা।”

শান্তি এলো। তবে শ্মশানের শান্তি। কারণ
কিছুদিন চেয়ারে বসার পর যথারীতি তাদেরও শিঙ
গজালো এবং অধিকাংশ লোককে গুঁতিয়ে
পেটের নাড়িভুঁড়ি বার করে দিল।

এখন এই পুরুষানুক্রমে পাওয়া বজ্জাত চেয়ারটিকে
ভেঙে উনুন ধরানো ছাড়া আমাদের বাঁচার
কোন উপায় নেই।

চেয়ারটা ধ্বংসকারী দলের জন্য উন্মুখ প্রতীক্ষায়
রাত কাটাচ্ছি।

.                ****************                 
.                                                                            
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
পার্বতী
কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
১৯৮৩ সালে প্রকাশিত কবির "প্রাচ্যের সন্ন্যাসী" কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা ভীষণভাবে
কৃতজ্ঞ কবি দিলীপ কুমার বসুর কাছে কারণ তিনি এই কবিতাটি চয়ন করে আমাদের
পাঠিয়েছেন। মিলনসাগরে কবি দিলীপ কুমার বসুর কবিতার পাতায় যেতে
এখানে ক্লিক
করুন . . .

চোখের পাতায় জমিয়ে রাখো সারারাতের ঘুম,
পুব আকাশে লেপ্ টে গেছে কপালের কুমকুম,
ঘরকন্নায় পড়েছো বাঁধা সরলতম নদী---
অবধি নেই, অবধি নেই, তাই তো নিরবধি।

আকাশ-জোড়া রাত্রি ভাঙে পদ্ম পাতায় জল,
রূপনগরে মুক্তা ঝরে মূক্ত শতদল,
তোমার জন্য শ্মশানবাসী সর্বনাশের আশায়
ঘরের নেশায় পরের নেশায় সবকিছুকে ভাসায়।

অন্নবস্ত্র দিয়েছো তুমি এবার অস্ত্র দাও,
রক্তে মশাল জ্বালিয়ে দিয়ে ডম্বরু বাজাও,
স্বর্ণ কিংবা লৌহ যা-হোক চূর্ণ করো বলয়---
বলয় ভেঙে বলয় ভেঙে মহাকালের প্রলয়!

.                ****************                 
.                                                                            
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
প্রাচ্যের সন্ন্যাসী
কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
১৯৮৩ সালে প্রকাশিত কবির "প্রাচ্যের সন্ন্যাসী" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা।
আমরা ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ কবি দিলী পকুমার বসুর কাছে কারণ তিনি এই কবিতাটি চয়ন
করে আমাদের পাঠিয়েছেন। মিলনসাগরে কবি দিলীপ কুমার বসুর কবিতার পাতায়
যেতে
এখানে ক্লিক করুন . . .

কায়েদে-আজম যখন তেজগাঁ বিমানবন্দর থেকে
হাজার হাজার মানুষের পাঁজর ভেদ করে,
বিকেলের হঠাৎ-বৃষ্টিতে-নষ্ট-হয়ে-যাওয়া
তোরণগুলির তেরচা কুনিশ নিতে নিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন---
মকবুল তখন নদীর ধারে পলির ভিতর পা ডুবিয়ে
গর্তে লোহার শিক ঢুকিয়ে
বড় বড় কাঁকড়া বের ক'রে আনছিলো।

আইয়ুবের মার্কিন খাপ থেকে যেদিন ইয়াইয়া খান
মরচে-ধরা তলোয়ার বকশিশ পেলেন---
সেদিন মকবুল উঠোনে গাবের কষে
জাল সিদ্ধ করছিলো।

মনে সোয়াস্তি নেই মকবুলের---
বাদলার রাতে যখন দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে হাওয়া ওঠে
তার ঘুম ভেঙে যায়,
বহুদূর থেকে কালাপানি তাকে ডাক দেয়---
ভোর হতে না হতেই সে নৌকো ভাসিয়ে চলে যায়
দূরে দূরান্তে---কোথায় কুতুবদিয়ার চর, মৈশখালি, কক্ শবাজার,
কোথায় সেই পরণকথার দেশে---
"শঙ্খ নদী ফিরাইলো
মরা গরু জিয়াইলো”---
আবার সন্ধ্যার আজান আর কাঁসরঘন্টার রেশ
মিলিয়ে যাবার পর সুপুরিবনের অন্ধকার বেয়ে
তার নৌকো ঘাটে ফিরে আসে---
সঙ্গে লাইভরতি কোরাল কিংবা লাউক্খা মাছ।

কর্ণফুলির তীরে দাঅনা বেড়ার ঘর, পাশে মই আলুর ক্ষেত,
মাঝরাতে হরিণের পাল নেমে আসে,
উঠোনে আড়াআড়ি জাল শুকোয়,
তিনটে ছেলে মেয়ে সারাগায়ে আঁশটে গন্ধ জড়িয়ে
ছুটোছটি ক'রে ফড়িং ধরে---
পেছনে ভাডোইয়া গুঁজে উড়িয়ে দিয়ে হাততালি দেয়,
তারপর জাল থেকে খুঁজে খুঁজে শুকনো চুনো মাছ
ছাড়িয়ে নেয়, পুড়িয়ে পানিভাতের সঙ্গে খাবে ব'লে
জমিয়ে রাখে।

একগাল ধোঁয়া ছেড়ে হুঁকোর মুখটা মুছে
গোবিন্দের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে মকবুল বলে---
“বুইঝ্ঝস্ নি গৈন্দ, নদীত্ পেট ভরিব, মন ভৈরত্‌ ন।"

পূবদিকে গুণ্ডাহাতির পালের মতো সারি সারি টিলা---
বাড়ির পাশ দিয়ে অরণ্যের গান গেয়ে যায়
পাহাড়-ভেঙে-বেরিয়ে-আসা কর্ণফুলি---
দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে আলিশান দরিয়া---
শাওন ভাদ্র মাসে গভীর রাতে তাকে ডাক দেয়---
মকবুল সেদিক পানে উদাস চোখ মেলে সুতো পাকায়,
তার নজরবন্দী চেলা গোবিন্দের হাতেও সুতোর গুলি,
মনে বড় হাউশ---ওস্তাদ তাকেও সঙ্গে নেবে।

রমনা ময়দানে যেদিন
“বাংলার মুখ অমি দেখিয়াছি" হাতে নিয়ে
একের পর এক ঢেউ আছড়ে প'ড়ে মুজিবের গলায়
গর্জন করছি:লা, সেদিন মকবুল মিঞা
রাঙামাটির পাহাড়ে
একটা বেজায় ঝুনা শাকোয়ান গাছের গোড়ায়
কুড়ুল চালাচ্ছিলো॥

তার ডিঙি ছোট, বড় নৌকা চাই---
মকবুল অথৈ জলে পাড়ি দেবে---
যেখানে রোজ বিয়ানে এবং সাঁঝের বেলায়
আশমান সোনার শান্ কি ধুয়ে নেয়,
সেই অনন্ত কালো জলের মহাদেশ থেকে মাঝে মাঝে
খোদার ফরমানের মতো কালো তুফান উঠে আসে---
যেখানে সেয়ানা মানুষের সমস্ত দুনিয়াদারি খতম হয়ে যায়,
মকবুল সেই গজরানো গজবের দুনিয়ায়
নৌকো ভাসাবে। আল্লা কসম!

যেদিন চট্টগ্রাম বরিশাল রাজশাহী এবং ঢাকার
সমস্ত বাড়ির মাথায় রাত-জাগা-খলিপার শেলাই-করা
বাংলার উপরে সূর্য পত্ পত্ ক'রে উড়ছিলো---
সেদিন মকবুল নিশান ওড়ায় নি!
সারাদিন করাত চালিয়ে সন্ধ্যের পর বাতির আলোয়
ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে
তার্পিন তেল ডলতে ডলতে বেড়ার গায়ে
ভয়ে-দুলে-ওঠা ছায়ার সামনে সঞ্চুচিত গোবিন্দকে
শাসাচ্ছিলো---“ইন্ সান আল্লা, তোরে যদি
কাডি ন ফেলাইত আঁর নাম নাই।”
গোবিন্দ দুপুরে দুটো কাঠের গজাল
ভুল জায়গায় পুঁতেছিল।

মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রাপ্তির মধ্যে
স্বপ্ন এবং সংগঠনের মধ্যে
কোথাও একটা মস্ত খন্দ আছে।
জঙ্গম বাংলার গণসিন্ধু মন্থন ক'রে
একদিকে যখন সামরিক বিষ ফেনিয়ে উঠছে,
আর-একদিকে লাফিয়ে-ওঠা বাঘিনীর মতো
গর্জন করছে রক্তের ঢেউ---
তখন একদিন মকবুল দেখলো
লোহার মত শক্ত তক্তার এক জায়গায়
যে গাঁটের নক্সা ফুটে উঠেছিলো---
সেই অংশটা ঘুণে ঝুরঝুরে আর গোল হয়ে খ'সে গেছে।
নৌকো তৈরী শেষ,
সমস্ত তক্তাও ফুরিয়ে গেছে,
টিন লাগালে নোনা জলে মরচে ধরবে,
অন্য কাঠ লাগালে প'চে যাবে।
কী ক'রে গর্তটা ভরাট করা যায়
ভাবতে ভাবতে ভাবতে ভাবতে
নাওটাকে কর্ণফুলির ডাঙায় চিৎ ক'রে ফেলে রেখে
স্যাঙাত গোবিন্দকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে
বিরাট একটা কড়ই গাছের তলায় বসে
গেঁজিয়া-ওঠা দু'হাঁড়ি তালের রস খেয়ে
দু'জনেই ভোঁ হয়ে পড়ে রইলো।

এদিকে শহরের নাড়িভুঁড়ি ঘেঁটে দিয়ে
কখন যে সৈন্যরা গাঁয়ে ঢুকে
প্রথমে টুন্টু সদাগরের তারপর হাজি সায়েবের
তারপর ফকির মিস্তিরির এবং নিরঞ্জন পুরোহিতের
বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে,
বেহুঁশ মকবুল জানে না।
কেবল দক্ষিণের বাতাসে যখন উড়ে-আসা ছনের ছাই
চোখে পড়ল এবং কানে এলো বাচ্চাদের আর
মেয়েদের বুকফাটা কান্না
মকবুল চোখ রগড়ে উঠে বসলো।
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লুঙ্গিটা ঠিকঠাক করার আগেই
তার বুক-বরাবর তিনটে বেঁটে লোহার নল---
রোদ্দুরে চক্চক্ করে উঠলো।
পাকা লাউবিচির মত দাঁতের ফাক দিয়ে থুথু-মাখা কয়েকটা শব্দ
ছিটকে বেরিয়ে এলো---
"পহলে বহিন্ চোদ্‌, বোট্, লাগা দে.পানি পর।”

ট্রাক যাবার রাস্তা নেই, মুক্তিবাহিনী কেটে দিয়েছে---
নৌকোয় চেপে অন্য গাঁ-গুলিতে ঢুকে
বাড়ি জ্বালাবে, লুটপাট করবে আর মেয়েদের ছিঁড়ে খাবে---
পুরুষরা বেশীর ভাগই পাহাড়ে-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে।

মকবুল বলতে যাচ্ছিলো, নৌকোর তলায় গর্ত---
ওপরে ছই আর পাটাতনের জন্য গর্ত দেখা যাচ্ছে না---
কিন্তু মেয়েদের চিৎকার থেমে গেলেও তখনো
উত্তরের আকাশে ফুল্ কি, তখনো বাতাসে পোড়া গন্ধ,
মকবুল দাঁত বের ক'রে বলল---
"চল চল মিঞা এক্ষুনু দিয়ুম।"

গোবিন্দ কচুপাতার মত কাঁপছিলো আর
তাড়ির ঘোরে বেকুবের মত দুটো ড্যাবডেবে চোখ মেলে
ওস্তাদের দিকে তাকিয়েছিলো।

সৈন্যরা উঠে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মকবুল
নৌকো স্রোতে ঠেলে দিয়ে দু'পা পিছু হটে এলো---
একচক্কর ঘুরেই নৌকো কর্ণফুলির মাতাল টানে
বিদ্যুৎবেগে ছুটে চললো !

মকবুল খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর,
আকাশ ফাটিয়ে সে আচানক চীৎকার ক'রে ওঠে---
“আল্লা হো আকবর, ডুবি যা ডুব যা ডুবি যা---
বদর বদর ক” গাজি গাজি ক" হালারপূত হালারা__
ডুবি যা ডুবি যা ডুবি যা বাইন,চৎ ডুবি যা---"
ফেনী নদীর তীর থেকে আরাকান সীমান্ত পর্যন্ত
চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে ধূসর দিগন্তরেখার মতো সন্দ্বীপ---
সমস্ত পাহাড়ের ঢেউ আর চা-বাগান
সমস্ত নদীর জল ক্ষেতখামার আর স্বপ্নের মতো
দেবাগ্রি পাহাড় যখন মকবূলের বুক-ফাটা চীৎকারে কেঁপে উঠছে
তখন ধীরে ধীরে এ পাড়া ওপাড়া থেকে
কয়েকটা ভাঙাচোরা মানুষ আর একটা রোগা কুকুর
মকবুলের পিছনে এসে দাঁড়াল।
তাদের চোখের উপর কর্ণফুলির অরাজক টানে
কয়েকটা সামরিক টুপি ঘুরপাক খেতে খেতে
ছুটে চলেছে দক্ষিণে, সমুদ্রের দিকে।

মকবুল আবার রাঙামাটির পাহাড়ে যায়,
হাতে কুড়ুল, পাশে
ওস্তাদের মায়ায় আচ্ছন্ন গোবিন্দ---
মকবুল সমুদ্রে যাবে।

.                ****************                 
.                                                                            
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
আজ দ্বিতীয় ঘণ্টার পর ছুটি
কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
আমরা ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ কবি দিলীপ কুমার বসুর কাছে কারণ তিনি এই কবিতাটি চয়ন
করে আমাদের পাঠিয়েছেন। মিলনসাগরে কবি দিলীপ কুমার বসুর কবিতার
পাতায় যেতে
এখানে ক্লিক করুন . . .

ভোর থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি, কনিষ্ক ছাতাটা খুঁজে পেলেন না পুলিনবাবু।
দুটো খলি নিয়ে ভিজতে ভিজতে গলির ভিতরে ঢুকে দু'তিনটে আবর্জনার
স্তূপ এড়িয়ে একটা গরুর পাশ কাটিয়ে, বিচুলি কলের পাশের দোকানে ঢুকে
কার্ড জমা দিলেন।

“সব দেবো তো মাস্টারমশাই?" রেশনের দোকানের মালিক এবং শ্রমিক-
নেতা গদাই ওরফে দীনবন্ধু বোস জিজ্ঞেস করে। “শুধু চাল দিন, গম থাক।"
চালের থলি নিয়ে আরেকটা গলির ভিতর দিয়ে বড়ো রাস্তা পেরিয়ে বাজারে
ঢুকলেন, সোজা রাস্তায় গেলেন না, মুদির দোকানে তিন মাসের টাকা বাকি।

থলি দুটো বারান্দায় নামিয়ে রেখে তক্তপোষের উপরে বসে ভেজা আধ-
ময়লা পাঞ্জাবিটা খুলে শুঁকে নাক কুঁচকে পেরেকে ঝুলিয়ে দিলেন। “একটু
চা হবে নাকি রে? আধ কাপের মতো হলেই হবে।” মেজো মেয়ে বললো---
“চিনি একদম নেই বাবা, চৌদ্দটা পয়সা হবে? পঞ্চাশ মুড়ি নিয়ে আসি,
মিতু অন্তু চিলের মতে চেঁচাচ্ছে। “চিনি ছাড়াই দে।"

বড়ো মেয়ে বাচ্চা হবার জন্য এসেছিল, এখনো যায়নি --- উনুনের পাশে
বসে ভিজে কাঁথা শুকোচ্ছে। উঠে থলিটা উপুড় করলো। তিন আঁটি নটে
শাক, দুটো শোলাকচু, একফালি কুমড়ো, কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা। “শোলাকচু
দিয়ে ডাল করতে বল্‌ , একটু কাঁচা লঙ্কা দিতে বলিস --- বেশ হয়।”

সারাক্ষণ পচা বৃষ্টিতে বিরক্ত হন পুলিনবাবু, ছাতাটা কোথায় ফেলে
এসেছেন কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। হঠাৎ একটা কুকুর ঢুকে পড়লো,
উঠোনে লাউমাচার নিচে গিয়ে গা ঝাড়তে লাগলো, মাঝে মাঝে কুঁই কুঁই,---
পুলিনবাবু দু'একবার “হ্যাট্, হ্যাট্ করলেন, বের হোলো না। লাউমাচাটার
দিকে চোখ পড়তেই বড়ো ছেলের কথা মনে পড়ে --- মাচাটা তৈরী ক'রেছিলো
সারাদিন খেটে, ও-ই বিচি এনে পুঁতেছিলো। লেখাপড়া করেও কোনো!
কাজের হোলো না, পুলিনবাবু ভাবেন, সারারাত দেওয়ালে পোষ্টার সেঁটে
বাবু এখন জেলে আছেন। পাতাগুলো বিরাট আকার হয়েছে --- লাউ কেমন
হবে কে জানে! হাতলভাঙ্গা কাপ থেকে চায়ে চুমুক দিয়ে পুলিনবাবু
খবরের কাগজটা মেলে ধরেন :

“আজ শিক্ষক দিবস"

রাষ্ট্রপতি বলেছেন : "শিক্ষকেরা সুমহান জাতিসংগঠক।"
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন : “যা কিছু শিখেছি সেতো বাল্যকালে শিক্ষকের
                      কাছে।"
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন : "অ্যাঁও ওঁয়াও চ্যাঁও গ্যাঁও কিচ্ কিচ্ ভুক্‌ ভূক্ ভুক্‌
                      ভক্‌।"
চতুর্দিক, অন্ধকার করে বৃষ্টি নামলো, বৃষ্টি নামে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে---
মাচায় আপোষহীন দুর্দান্ত লাউয়ের ডগা নাচে।

.                ****************                 
.                                                                            
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
বাবা
কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
১৯৮০ সালে প্রকাশিত, কবির "দক্ষিণ সমুদ্রের গান" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
১৯৭৫ সালের
ভারতের রেল ধর্মঘটের কবিতা।
আমরা ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ কবি দিলীপ কুমার বসুর কাছে কারণ তিনি এই কবিতাটি চয়ন
করে আমাদের পাঠিয়েছেন। মিলনসাগরে কবি দিলীপ কুমার বসুর কবিতার পাতায়
যেতে
এখানে ক্লিক করুন . . .


বুধনের ছ-বছরের মেয়েটা আমাশায় ভোগে।
বার-বার ছুটে গিয়ে রেলের নর্দমার ধারে বসে,
তারপর দমকলের বিরাট চৌবাচ্চায় যায়,
ইজেরের দড়ি বাঁধতে-বাঁধতে মার কাছে ফিরে আসে,
মা উকুন বেছে দেয়।

কল্ ম্যান্‌ রতনলাল ডেরার সামনে এসে চিল্লায় ---
“হাই বুধনোআ, সালা সাহাব বোলাওতানি রে,
তুরন্ত চলা যা।"

বুধন আধময়লা একটা লাল গামছা পরে উঠোনে
খাটিয়ার এক কোনায় ব'সে ঝুঁকে প'ড়ে মেয়ের ছেঁড়া কামিজ
শেলাই করছিলো। রতনের ডাক শুনে গামছা খুলে
জলাদ হাঁটুর কাছে তাপ্পি-মারা নীল প্যান্ট প'রে হাতুড়ি নিয়ে
ইয়ার্ডে ঢোকে।
এক-একটা মালবোঝাই গাড়ি ইঞ্জিন ছাড়াই আর একটাতে গিয়ে
বেদম ঢুঁশ মারছে, আশপাশের রেলকলোনিগুলো
বাজ পড়ার শব্দে কেঁপে উঠছে,
সকাল থেকে হাম্ পিং চলছে।

ঘণ্টা তিনেক পরে উনত্রিশ ফুট জলের তলা থেকে
বুধনের মেয়ে ভার্ তীয়াকে যখন তোলা হ'লো,
শক্ত হ'য়ে গেছে।

হাতুড়ি ছুঁড়ে ফেলে উনত্রিশখানা ফাঁকা মালগাড়ির
তলা দিয়ে হামাগুড়ি দিতে-দিতে
তেলকালিমাখা বুধন
বেরিয়ে এসে
চৌবাচ্চার পাশে
দু-হাতে ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেলো,
মেয়েকে কোলে নিয়ে
ব'সে রইলো।

বুধনের মনে হ'তে পারতো---
'অবসানকে বিদায়কে মৃত্যুকে আজ আমরা ভক্তির সঙ্গে গভীরভাবে
জানবো --- তার প্রতি আমরা অবিচার করবো না। তাকে তাঁরই ছায়া
ব'লে জানবো, “যস্য ছায়ামৃতম্ যস্য মৃত্যুঃ” ।'

কিন্তু এ-সব কিছুই তার মনে হ'লো না।
তার চোখের জল ইঞ্জিনের ধোঁয়ার সঙ্গে বাষ্প হ'য়ে মিশে যায়,
সে দ্যাখে---ইয়ার্ডে গাড়ি শান্ টিং হয়,
রাস্তায় রিকশো চলে
একটু দূরে পারবতীয়া বেহুঁশ বুক চাপড়ায়,
আশমানে কয়লার ইঞ্জিনের মতো গর্ গর্ ক'রে
বাদলার মেঘ ছুটে আসে,
লছমনের লেড়্ কি ন্যাকড়াজড়ানো বাটিতে
তার বাবার জন্য রোটি আর ভাজি নিয়ে যায়,
কিন্তু তার মেয়ে কোনো কথা বলে না,
কেবল ভেজা চুল থেকে ফোঁটা-ফোঁটা জল গাড়িয়ে পড়ে।

কলোনির লোকের জটলা ঠেলে ইউনিয়নের নেতা
কমরেড দত্তবাবু এগিয়ে আসেন---
"এই নিয়ে তিন-তিনটে হলো,
আই-ডব্ল্যু-কে ব'লে চৌবাচ্চাটাকে গ্রিল্‌ দিয়ে
ঘিরে দিতে হবে, আর তোদেরও বলিহারি যাই---
আজকাল এতসব বেবস্থা-টেবস্থা ররেছে
তব গণ্ডায়-গণ্ডায় বিয়োস কেন বাপু।"
ইউনিয়নের কারবারে আজকাল একটু মন্দা যাচ্ছে, তাই
তিনি জরুরি নির্বীজকরণ ব্যাপারে কিছু কামিয়ে নিচ্ছেন
একদা-জঙ্গী দত্তবাবু আরো কিছ বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু
হঠাৎ একটা ঢাকা-খোলা ফায়ার-বক্স-এর দিকে চোখ পড়তেই
তান না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে হারিয়ে গেলেন---
ফায়ারম্যান সুলতান স্থিরদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে
রিকশোয় উঠে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন, জোড়া-জোড়া জ্বলন্ত চোখ
তাঁর পিছু নিয়েছে।

চোখে জল নেই,
বুধন বুকের ভিতর দাপিয়ে-দাপিয়ে কাঁদে।

শমীর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের মতো?

.                ****************                 
.                                                                            
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
আজ মহরম নয়
কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
১৯৭৪ সালে প্রকাশিত, কবির "গান্ধীনগরের রাত্রি" কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা ভীষণভাবে
কৃতজ্ঞ কবি দিলীপ কুমার বসুর কাছে কারণ তিনি এই কবিতাটি চয়ন করে আমাদের
পাঠিয়েছেন। মিলনসাগরে কবি দিলীপ কুমার বসুর কবিতার পাতায় যেতে
এখানে ক্লিক
করুন . . .


সন্ধা থেকে শুধু মানুষের স্রোত, ভগ্রকণ্ঠে ভেসে আসে উদাস তাজিয়া,
বিদ্যুৎ-মালার নিচে বেওয়ারিস হাহাকার ভেঙে যায় রাস্তার দু'ধারে,
জল, আজ একবিন্দু জল নেই, বে-আবরু বালুকারাশি শুষে নেয় চাপা আর্তনাদ
নির্জলা কাহিনী এই বেইমানী বধ্যভূমে, বাৎসরিক পাথেয় সন্তাপ।

কেবল নক্ষত্রলোক মাঝরাতে খুলে দেয় শানানো বর্শার অগ্রভাগ,
নিচে খরস্রোতে ভাসে বিনষ্ট তরমুজ, জবা, অশৌচবিজয়ী শব, বিচ্ছিন্ন আঙুল,
যে সব গরিষ্ঠ, ঋজু, ভূমিহীন কৃষকের লুণ্ঠিত শষ্যের পুরোভাগে
সূর্যের সন্ততি, এই উপমহাদেশ ঘিরে জেগে উঠেছিল---
যে প্রতিবিপ্লবী হিংসা সমস্ত দেওয়াললিপি মুছে দিয়ে
ফুসফুসের গোল ছিদ্রে উপড়ে-ফেলা চোখের ভিতরে
আলকাতরা ছিটিয়ে দিলো, উষ্ণ রাত্রি সেই সব মহান শিয়রে
মৌসুমী বাতাস নিয়ে বসে আছে, স্তব্ধ হয়ে গেছে
নিবন্ত নারকেলশ্রেণী, গাঙ্গের সৈকত আজ কারবালার কর্কশ প্রান্তর।

তবু রিক্ত, রক্তশূন্য নয় দেশ। বিপন্ন বাৎসল্যে রুদ্ধশ্বাস
বৃষ্টিতে পচানো রাত্রে মুখের খাবার তুলে দিয়ে
দ্রুত খিল বন্ধ করে, ক্ষতস্থানে ঢুকিয়েছে ন্যাকডা ও ওষুধ,
চার-চারটে রাবণের সঙ্গে আজ হাত মেলায় ঠোঁট-চাটা জন্তু ও ভুডাস্‌

চূড়াস্ত মরণখেলা সেদিন ফসল-প্রান্তে জ্বলে উঠেছিলো
দিকে দিকে আজো ফেরে ছিন্নপাখা ফেরারী জটায়ু।

কোনো পরাজয়চিহ্ন লেখা নেই নক্ষত্রের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগে
একটাও আপসখত্ ধরেনি মৃত্তিকা---
কেবল অমর অস্থি, কেবল স্বাধীন খুলি পাওয়া গেছে গোপন চিতায়,
মজা পুকুরের নিচে, লক্ আপ-এ, জেল-এর উঠোনে ;
রাবণের বংশ জুড়ে বড় ক্ষণস্থায়ী এই খল্ খল্ হাসি।

সময়সমুদ্র ভেঙে গর্জে উঠবে একটা নয়, বেঘোর জাঙ্গাল,
ঘিরে ফেলবে প্রলয়পয়োধিজলে ছিন্নভিন্ন লঙ্কা ও রাবণ
প্রস্তুত নক্ষত্রলোক, নিচে ক্ষিপ্ত বেকসুর মানবসমাজ জেগে আছে,
জেগে আছে কুরুক্ষেত্র দুভদ্রা, উত্তরা।

.                ****************                 
.                                                                            
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী
কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
১৯৭৪ সালে প্রকাশিত, কবির "গান্ধীনগরের রাত্রি" কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা ভীষণভাবে
কৃতজ্ঞ কবি দিলীপ কুমার বসুর কাছে কারণ তিনি এই কবিতাটি চয়ন করে আমাদের
পাঠিয়েছেন। মিলনসাগরে কবি দিলীপ কুমার বসুর কবিতার পাতায় যেতে
এখানে ক্লিক
করুন . . .


দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে রাত্রি নামে দিল-খোলা ছুরির ফলায়।

অবশ্য এশিয়া নয়, ভারতবর্ষ আমাদের দ্রষ্টব্য বিষয়,
আয়তন বড়ো হলে বস্তুর ঘনত্বটুকু কমে যায়, অন্ধকার
দক্ষিণাকালীর মতো জিভ নিয়ে নেমে আসে গঞ্জে ও শহরে।

শাক-পাতা সিদ্ধ হয় তিনখানা ইঁটে পাতা উনুনের আঁচে---
ম্যাকবেথের ডাইনী নয়, দলে দলে গাঁ-উজাড় খেতমজুর এসেছে খরায়
রাত্রির উদর থেকে শশব্যস্ত শিখাগুলি নাচে
সামনে ও পেছনে শুধু দীর্ঘাযু দিনের খরতাপ
ছোটো ছোটো দোকানির বিক্রি নেই, সন্ধ্যে হলে ফেলে দেয় ঝাঁপ
অনন্ত পেটেনা লোহা, শচী দাস বন্ধ করে তাঁত।

চায়ের স্টলের ধারে প্ল্যাটফর্মে ঘুমায় ষোলটি পরিবার---
দুটো বাচ্চা পেটফুলে মরে গেছে গতকাল রাতে
(আামুল-মাখন গলে মন্ত্রীদের দেরাদুন-ভাতে)
শেষ ট্রেন চলে গেলে গলায় সোনার হার ডান হাতে রেশমী রুমাল
একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় প্রৌঢ় লালাজি---
গরুর চামড়ায় বাঁধা দশখণড গ্রন্থে ছিলো বাণিজ্যের সহযোগী বাণী,
নোটের খস্‌ খস্‌ শব্দে হঠাৎ ফোঁপানো কান্না চাপা পড়ে,
.                        গর্জে ওঠে ইয়ার্ডের শ্লীল অন্ধকার---

চরকার ভিতরে ছিলো হাতবদল রাইফেল, ইস্ত্রি-করা টুপির ভিতরে
কয়েকটা কেউটের বাচ্চা রেখে গেছে লোচ্চা মাউন্টব্যাটেন কোম্পানী।

পোকার কামড়ে ঘুম চটকে গেলে দাসু ভাবে বৃষ্টি হবে কাল
ফিরে পাবে থালাবাটি শুদ্ধ হবে ফাটা মাটি এবং মেয়েটি,
দাসু কি জানে না বৃষ্টি ভালো হলে আদিগন্ত সবুজ বিপ্লবে
জোতদারের তেজারতি বাড়ে আর জমিজমা বাড়ে আর টিউকল বাড়ে আর
মেজো ছেলে কল্যাণীতে কৃষিবিদ্যা পড়ে!

যদিও কস্মিনকালে দাসু পাল পড়ে নাই গীতা
তথাপি গীতার মতে মুরগী যদি কর্ম হয় ফল তার গোটা কয় ডিম
যদিও দাসুর বুকে চৈত্রদিনে শানানো কাস্তের মতো রোদ আর
.                                        নীলকণ্ঠ অঘ্রাণের হিম
তবুও সন্ধ্যার ঘোর নেমে এলে খেসারিখেতের পরপারে
লম্পট উঠোন জুড়ে নিচু হাসি খেলে যায় দারোগাবাবুর ঐ
.                                        তরমুজবিচির মতো দাঁতে
এবং সমস্ত ডিম এবং মেয়েটি তুলে দিতে হয়
.                                ঘনশ্যাম রাত্রির করাতে।

ভোরের প্রথম গাড়ি ছেড়ে দিলে ফিকে হয় পুবের আকাশ
মেয়ে ফিরে এলে দাসু ভান করে পড়ে থাকে যেন তার কতো গাঢ় ঘুম,
সংবিধানে লেখা আছে হেথায় যে কোনো বাক্তি প্রাণ খুলে
.                                নিদ্রা দিতে পারে

সুতরাং দাদু পাল.....কিন্তু ইষ্টিশান থেকে দূরে কোথা বেজে ওঠে শাঁখ
চক্ষু তার ছানাবড়া দাসু আজ হতভম্ব এবং নির্বাক
স্টেশন কেবিনে ওড়ে চকচকে নতুন পতাকা
নিজেরই অজান্তে দাসু মেরে বসে কপালে চাপড়
লোকজন নিশ্চয়ই পাগল
নইলে কেউ কি আর নষ্ট করে এতখানি রঙীন কাপড়!

.                ****************                 
.                                                                            
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
ক্ষমা প্রার্থনা
কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য
১৯৭৪ সালে প্রকাশিত, কবির "গান্ধীনগরের রাত্রি" কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা ভীষণভাবে
কৃতজ্ঞ কবি দিলীপ কুমার বসুর কাছে কারণ তিনি এই কবিতাটি চয়ন করে আমাদের
পাঠিয়েছেন। মিলনসাগরে কবি দিলীপ কুমার বসুর কবিতার পাতায় যেতে
এখানে ক্লিক
করুন . . .


কী সব যেন বলেছিলাম ভুলে গেছি।
ভুলে গেছি তুমুল বাতাস ক্ষিপ্র করে
.        বরেণ্য এ ঘাড়ের উপর
.        চুলে যে অরণ্য ছিলো
ভুলে গেছি, এখন শুধু মনে পড়ে
হাজার হাজার ছেলের লাশ ঠাণ্ডা ঘরে।

ঐ কটাক্ষ শাঁখের করাত
আমার তো নগণ্য বরাত
নিখিল কালে জব্দ হয়ে আছি,
যা কিছু নীল শব্দ করি
স্তব্ধ প্রহর ছিন্ন করি---
ছেঁড়া পাড় তো শ্রীচরণেই লোটে---
ভিজে ভুরুর নরম ঘাসে
টিপের ফাঁকে জোয়ার আসে
যা কিছু মিল তিলের নিচে
.        তদন্তময় ঠোঁটে।

কী হবে আর পাতা উল্টে শঙ্খ ঘোষ বা হার্ট ক্রেনের?
ভারতবর্ষ রেসের মাঠ মুৎসুদ্দী-বেনের,
খবর হতে পারিনি, তাই
অভিমানে আঙুল ফোলাই,
এখন শুধু গদ্য পড়ি, ফ্রন্টিয়ারে,
.        সমর সেনের।

.                ****************                 
.                                                                            
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*