কবি রমাসুন্দরী ঘোষের কবিতা
*
বিদ্যাশিক্ষা বিষয়ে শিশুদিগের প্রতি
শ্রীমতী রমাসুন্দরী
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২) থেকে নেওয়া

শুন ওহে শিশুগণ!                 শুন ওহে শিশুগণ,
শৈশব অবধি কর, বিদ্যা উপার্জ্জন।
কর যতন এখন,                        কর যতন এখন,
যাহাতে পাইবে সবে বিদ্যা মহাধন॥
যদি এমন সময়,                        যদি এমন সময়,
আলস্য বা আমোদেতে অবসান হয়।
তবে না পাবে কখন,                তবে না পাবে কখন,
বিদ্যাধন হয় যাহা অমূল্য রতন॥
ক্রমে সংসার অনল,                ক্রমে সংসার অনল,
তাপিত করিবে সদা, হইয়া প্রবল।
ইথে বুঝ শিশুগণে,                 ইথে বুঝ শিশুগণে,
এই বেলা চেষ্টা কর, বিদ্যা উপার্জ্জনে॥
দেখ মূর্খ যেইজন,                দেখ মূর্খ যেই জন,
মনুষ্য নামেতে সেই, না হয় গণন।
শুদ্ধ বিদ্যাহীন নরে,                শুদ্ধ বিদ্যাহীন নরে,
সকলে তুলনা করে, বানরে বানরে॥
যায় জীবন বৃথায়,                যায় জীবন বৃথায়,
কাহারো নিকটে নাহি, সমাদর পায়।
হিতাহিত বিবেচিতে,                হিতাহিত বিবেচিতে,
নাহি পারে মূর্খ নর, আপন বুদ্ধিতে॥
আর বিদ্যাহীন জন,                আর বিদ্যাহীন জন,
বিজ্ঞ জ্ঞানী প্রায় সেই, না হয় কখন।
যদি দেখিয়া এসব,                যদি দেখিয়া এসব,
তথাপি না হয় ওহে, জ্ঞানের উদ্ভব॥
তবু সময় রতন,                তবু সময় রতন,
আমোদে মাতিয়া যদি, কর হে ক্ষেপণ।
তাহা হলে শিশুগণ,                তাহা হলে শিশুগণ,
জানিতে পারিবে নাহি, ঈশ্বর সৃজন॥
কত আছয়ে কৌশল,                কত আছয়ে কৌশল,
যাহার কারণ হয়, শোভিত ভূতল।
কিবা নদ নদী গণ,                কিবা নদ নদী গণ,
পর্ব্বত সাগর আর, নির্জ্জন গহন॥
কিবা তারা অগণন,                কিবা তারা অগণন,
নিশীথ কালেতে করে, আকাশ শোভন।
ফলফুলে বৃক্ষগণ,                ফলফুলে বৃক্ষগণ,
কেমন সুন্দর শোভা, করয়ে ধারণ।
কেবা রচিল এমন,                কেবা রচিল এমন,
কি কৌশলে এ সকল, হয়েছে সৃজন।
কিছু বুঝিতে নারিবে,                কিছু বুঝিতে নারিবে,
পশুর সমান নীচ, হইয়া থাকিবে।
দেখ জলের কারণ,                দেখ জলের কারণ,
কেমন বাস্পেতে তাহা, হয়েছে সৃজন।
পরে সেই জল হতে,                পরে সেই জল হতে,
পুনরায় বাস্পরাশি উঠে আকাশেতে।
এই জলবাস্প বলে,                এই জলবাস্প বলে,
বিদ্যুৎ গতিতে রথ, চলে কি কৌশলে!
সুধু বিদ্যার কারণ,                সুধু বিদ্যার কারণ,
অপূর্ব্ব কৌশল হেন, হয়েছে রচন।
কিবা শারীর বিধান,                কিবা শারীর বিধান,
গণিত ভূগোল কিবা, পদার্থ বিজ্ঞান।
কোন বিদ্যা না জানিবে,            কোন বিদ্যা না জানিবে,
অজ্ঞান তিমিরে মন আচ্ছন্ন থাকিবে।
তাই বল হে এখন,                তাই বল হে এখন,
শৈশব অবধি কর, বিদ্যা উপার্জ্জন।

. *************************  

.                                                                                          
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
শিল্পবিদ্যা
শ্রীমতী রমাসুন্দরী
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২) থেকে
নেওয়া

শিল্প বিদ্যা উপকারী হয় অতিশয়,
ইহাতে সবার মন শান্ত হয়ে রয়।
অবকাশ কালে মন কত দিকে ধায়,
চঞ্চল করয়ে তাহে, নানা কুচিন্তায়।
যদি লোক শিল্পকর্ম্ম, করে সে সময়,
তাহাতে না হয় মনে কুচিন্তা উদয়।
কোন দুঃখ কোন চিন্তা না থাকে তখন,
নির্ম্মল আনন্দে মন থাকে হে মগন।
কিবা যুবা কিবা বৃদ্ধ, কিবা শিশুগণ,
সকলের হয় ইথে, মঙ্গল সাধন। ১।

যদি কারো পতি পুত্র, লোকান্তরে যায়,
যদি কেহ পড়ে তাহে, দারিদ্র্য দশায়।
যদি নাহি জানে ভাল, লিখিতে পড়িতে,
যদি বহু পরিশ্রম, না পারে করিতে।
তথাপি যদি সে অতি, করিয়া যতন,
মনোহর শিল্পকর্ম্ম, করে অনুক্ষণ।
তাহা হলে শোক ভার হয়ে নিবারণ
অনায়াসে হয় তার তরণ পোষণ।
অতএব শিল্প বিদ্যা, নির্দ্ধনের ধন,
সকলের হয়ে ইথে, মঙ্গল সাধন। ২।

কেহ কেহ আছে হেন, রোষ-পরবশ,
সকলের প্রতি কহে, বচন নীরস।
ক্ষণকাল শান্ত নাহি, দেখা যায় তায়,
রাগের অধীন হয়ে, সবারে জ্বালায়।
কাহারো বচন নাহি মানে তার মন,
রাগে যেন হয়ে থাকে প্রচণ্ড তপন।
তথাপি যদি সে শেখে শিল্প বিদ্যাধন
তা হলে ক্রমেতে শান্ত হয় তার মন।
অতএব শিল্প করে, ক্রোধ নিবারণ,
সকলের হয় ইথে, মঙ্গল সাধন। ৩।

এদেশের কত শত মূর্খ বামাগণ,
বৃথায় যাপন করে, সময় রতন।
সঙ্গিনীগণের সহ, হইলে মিলন,
তাশ পাশা খেলি করে সময় হরণ।
যদি তারা এ সকল, করিয়া বর্জ্জন,
সযতনে শিল্প চর্চ্চা, করে সেই ক্ষণ।
ইহাতে থাকিবে ভাল, তাহাদের মন,
বৃথায় না যাবে আর সময় রতন।
অতএব শিপ্ল বিদ্যা, মানস রঞ্জন,
সকলের হয় ইথে, মঙ্গল সাধন। ৪।

যখন অন্তরে হয়, ভাবনা উদয়,
যখন না হয় মনে, কোন সুখোদয়।
যখন না ইচ্ছা হয়, করিতে পঠন,
যখন করিতে শ্রম নাহি যায় মন।
সুখপ্রদ শিল্পকর্ম্ম, করিলে তখন,
আন্রিক চিন্তাচয়, হয় নিবারণ।
হৃদয়ে উদয় হয় নিরমল সুখ,
তখন না হয় মনে আর কোন দুখ।
অতএব শিল্প করে, ভাবনা হরণ,
সকলের হয় ইথে মঙ্গল সাধন। ৫।

আহা ‘কিবা’ ‘পশমের, জুতা’ মনোহর!
পরিলে কেমন তাহে, দেখায় সুন্দর!
‘গলাবন্ধ’ ‘টুপি’ অতি, হয় প্রয়োজন,
শীতকালে ইথে করে, হিম নিবারণ।
‘মোজা’ যদি পরা যায় শীতের সময়,
‘পশমের জামা’ আর, পরিলে তখন,
একেবারে শীত তাহে, করে পলায়ন,
শিল্প হোতে শীতভয়, হয় নিবারণ,
সকলের হয় ইথে, মঙ্গল সাধন। ৬।

‘পশম’ নির্মিত ‘ছবি’ দেখায় কেমন,
আহা কি সুন্দর শোভে, উহার ‘আসন’!
কত উপকারে আসে, উহার ‘থলিয়া’,
যাইতে সুবিধা হয় বিদেশে লইয়া।
পশম হইতে শিল্প, হয় কত শত,
আমাদের উপকার, হয় নানা মত।
যেই জন লাভ করে, এ হেন রতন,
অনায়াসে হয় তার, অর্থ উপার্জ্জন।
শিল্প বিদ্যা লাভ কর, বঙ্গ নারীগণ,
সকলের হয় ইথে, মঙ্গল সাধন। ৭।

পুঁথি হতে কতদ্রব্য হয় হে নির্মাণ
জাল, গেঁজে, পাখা, ছাতা, কিবা সেজদান!
টুপিতে ‘পুঁথির’ ফুল, করিলে গাঁথন,
তাহাতে দেখায় আহা! সুন্দর কেমন!
কনক কাগজ চাঁপা গাঁথিয়া উহায়
মেজোপরি রাখিলে কি সুন্দর দেখায়!
এই রূপ ‘পুঁথি’ হতে কত দ্রব্য হয়,
হেরিলে উহার শিল্প, নয়ন জুড়ায়।
করিলে এসব কর্ম্ম, থাকে ভাল মন,
সকলের হয় ইথে, মঙ্গল সাধন। ৮।

ইংলণ্ডের বামাগণ, করিয়া যতন,
কেমন করিছে আহা! পোসাক সীবন।
দেখিতে সুন্দর কিবা নয়ন-রঞ্জন,
কত উপকার হয় ইহার কারণ!
অর্থব্যয় নাহি হয়, করিতে সেলাই,
যাহা প্রয়োজন হয়, করেন তাহাই।
যদি তাঁরা এ সকল, করেন বিক্রয়,
তা হলে তাঁদের কত, অর্থ লাভ হয়।
শিল্পেতে সুসিদ্ধ করে, বহু প্রয়োজন,
সকলের হয় ইথে মঙ্গল সাধন। ৯।

আহা! কি ইংরাজ জাতি, করিয়া কৌশল,
রচিতেছে নানাবিধ উপকারি কল।
যাইছে ছ দিনে লোক. ছমাসের পথ,
শিল্পের কারণ হেন, হইয়াছে রথ।
বহুদূর হোতে দিলে, তারেতে খবর,
উদ্দেশ্য স্থানেতে যায়, নিমেষ ভিতর!
শিল্প হেতু কত দ্রব্য, হতেছে নির্ম্মাণ,
সুন্দর প্রমাণ তার আছে বিদ্যমান।
হতেছে বিবিধ দ্রব্য, শিল্পের কারণ,
সকলের হয় ইথে, মঙ্গল সাধন। ১০।

শিল্পের মধ্যেতে গণ্য, হয় হে রন্ধন,
স্ত্রীলোকের শিক্ষা ইহা, অতি প্রয়োজন।
যে মহিলা পারে ভাল, করিতে রন্ধন,
সকলের কাছে হয়, প্রশংসা ভাজন।
স্বহস্তে করিয়া পাক, করালে ভোজন,
কত পরিতৃপ্ত হন আত্মীয় স্বজন।
তাহা হলে নাহি হয়, পীড়ার সঞ্চার,
কুশলে থাকয় অতি শরীর সবার।
শিল্প বিদ্যা ধরণীতে, আছে অগণন,
সকলের হয় ইথে, মঙ্গল সাধন। ১১।

কত শিল্প আছে, অবনী ভিতর,
কত উপকারী হয়, কিবা মনোহর!
কত লোক শিল্প কর্ম্ম, করিছে যতনে,
কত হিত সিদ্ধ হয়, ইহার কারণে।
দেখিয়া এসব যদি আমরা কেবল
না করিব শিল্প কর্ম্ম, পেয়ে বুদ্ধি বল।
মনুষ্য নামেতে তবে, কিবা প্রয়োজন ?
পশু সম চিরকাল, করিব হরণ।
অতএব এস এস, প্রিয় ভগ্নীগণ!
সযতনে লাভ করি, শিল্প-বিদ্যা-ধন।
তা না হলে হবো মোরা, পশুর মতন,
ঘৃণার ভাজন এত, ঘৃণার ভাজন।
এত পরাধীনা নাহি, রহিব তখন,
করিতে পারিব তাহে অর্থ উপার্জ্জন।
অতএব এস লাভ, করি শিল্পধন।
সকলের হয় ইথে, মঙ্গল সাধন। ১২।

.     *************************  

.                                                                                       
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
ধর্ম্ম
রমাসুন্দরী ঘোষ
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২) থেকে
নেওয়া

১।
যেই জন করে সদা, সৎ আচরণ।
যেই কভু পর ধন, না করে হরণ॥
পরের সামগ্রী যেই, করে তুচ্ছ জ্ঞান।
তৃণের সমান বলি, তৃণের সমান॥
প্রানান্ত হইলে তবু, না ভাঙ্গে পণ।
সকলের কাছে সদা বিশ্বাস ভাজন॥
সকলের অগোচরে, যদিও কখন।
হেন নারী পর দ্রব্য, করেন হরণ॥
তবু তাহা ব্যক্ত হয়, সর্ব্বদেশময়।
ধর্ম্মে দিলে ঢকে কাটি, ছাপা কি তা রয় ?

২।
সতী সাধ্বী পতিব্রতা খ্যাত যেই জন।
যতনে রাখেন যিনি নিজ ধর্ম্ম ধন॥
অপর পুরুষ প্রতি পিতার মতন।
পবিত্র ভাবেতে সদা, করে বিলোকন॥
কভু নাহি মন্দ ভাব, করয়ে চিন্তন।
সদা রাখে রিপুগণে করিয়া দমন॥
এমন সুশীলা যদি, করিয়া গোপন।
সতীত্ব হারায় কভু, দেখি প্রলোভন॥
তবু তাহা ব্যক্ত হয়, সর্ব্বদেশময়।
ধর্ম্মে দিলে ঢকে কাটি, ছাপা কি তা রয় ?

৩।
যেই জন হিংসা দ্বেষ, দিয়া বিসর্জ্জন।
সকল লোকের করে, মঙ্গল চিন্তন॥
যদি তাঁর করে কেহ, অনিষ্ট সাধন।
তিনি তাহা কভু নাহি, করেন গণন॥
পরের মঙ্গলে যদি, যায় তাঁর প্রাণ।
তথাপি পারেন তাহা করিতে প্রদান॥
গোপনে গোপনে যদি সরলা এমন।
কাহার অনিষ্ট কভু, করেন সাধন॥
তবু তাহা ব্যক্ত হয়, সর্ব্বদেশময়।
ধর্ম্মে দিলে ঢকে কাটি, ছাপা কি তা রয় ?

৪।
যেই জন রাগ রিপু করেছে দমন।
শান্ত ভাবে অনুক্ষণ, রহে যার মন॥
কাহাকেও কভু নাহি, কহে কুবচন।
সকলের প্রতি করে প্রিয় আচরণ॥
রাগের কারণ যেই, রাগের কারণ।
কভু নাহি মন্দ কার্য্য, করেন সাধন॥
যদি বা এমন ধীরা, লুকায়ে কখন।
রাগে অন্ধ হয়ে করে, মন্দ আচরণ॥
তবু তাহা ব্যক্ত হয়, সর্ব্বদেশময়।
ধর্ম্মে দিলে ঢকে কাটি, ছাপা কি তা রয় ?

৫।
অহঙ্কার পরিত্যাগ, করে যেই জন।
বিনয়ে সবার মন, করে আকর্ষণ॥
কাহাকেও নাহি যেই, করে হেয়জ্ঞান।
যথোচিত সকলের, করয়ে সম্মান॥
কিবা দীন হীন আর, কিবা মূর্খ জন।
কাহাকেও কভু নাহি, করেন হেলন॥
হেন নারী গুপ্ত ভাবে, যদিও কখন।
কাহাকেও অপমান করে অকারণ॥
তবু তাহা ব্যক্ত হয়, সর্ব্বদেশময়।
ধর্ম্মে দিলে ঢকে কাটি, ছাপা কি তা রয় ?

৬।
ন্যায় পরায়ণা অতি, হয় যেই জন।
অনুচিত কার্য যেই, না করে কখন॥
ভক্তি করে যেই সদা, গুরুজনগণে।
সমুচিত স্নেহ করে, স্নেহের ভাজনে॥
কাহার অন্যায় নীতি, করিলে দর্শন।
চেষ্টা পায় সদা তারে করিতে শোধন॥
এমন রমণী যদি, ছাপিয়া কখন।
অনুচিত কার্য্য কভু, করেন সাধন॥
তবু তাহা ব্যক্ত হয়, সর্ব্বদেশময়।
ধর্ম্মে দিলে ঢকে কাটি, ছাপা কি তা রয় ?

৭।
মোহের অধীন নাহি, হয় যেই জন।
পক্ষপাত শূন্য হয়, যাঁর আচরণ॥
সংসারে আসক্ত নাহি হয় যাঁর মন।
পরম পিতার আজ্ঞা, করেন পালন॥
মোহের কারণ যিনি, মোহের কারণ।
ধর্ম্ম সেতু কখন না, করেন লঙ্ঘন॥
গোপনেও যদি কভু, রমণী এমন।
বিষম মোহের জালে, হয়েন পতন॥
তবু তাহা ব্যক্ত হয়, সর্ব্বদেশময়।
ধর্ম্মে দিলে ঢকে কাটি, ছাপা কি তা রয় ?

৮।
যেই জন নীচ লক্ষ্য, করিতে সাধন।
ধর্ম্ম পথ হতে করে, বিধর্ম্মে গমন॥
মুখেতে কেবল কহে, ভক্তির কারণ।
কপট বচনে সবে করয়ে রঞ্জন॥
প্রথমে সবার কাছে পায় সে সম্মান।
যত দিন নাহি হয় সত্যের প্রমাণ॥
কিন্তু পরে সত্য যবে হইবে উদয়।
তখন সবার ভ্রম, যাইবে নিশ্চয়॥
ধার্ম্মিকা বলিয়া আর, তাহাকে তখন।
সমাদর করিবেক, হেন কোন জন ?
যতই করুক চেষ্টা, যতই যতন।
যতই করুক শ্রম, সুনাম কারণ।
তবু তাহা ব্যক্ত হয়, সর্ব্বদেশময়।
ধর্ম্মে দিলে ঢকে কাটি, ছাপা কি তা রয় ?

.        *************************  

.                                                                                       
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
মনের প্রতি উপদেশ
রমাসুন্দরী ঘোষ
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২) থেকে নেওয়া

শুন শুন ওরে মন, শুন শুন ওরে মন,
মোহপারাবারে আর হৈওনা মগন।
তুমি জান না কি মন, তুমি জান না কি মন,
তব বন্ধু সেই যিনি, জগৎ কারণ।
যিনি করেন সৃজন, যিনি করেন সৃজন,
চিরকাল যাঁহা হতে, হইবে রক্ষণ।
আর যাঁহার কৃপায়, আর যাঁহার কৃপায়,
দিবা নিশি কত সুখ, পাও হে ধরায়।
তবে কেন ভুল তাঁরে, তবে কেন ভুল তাঁরে,
মগন হইয়া থাকি, মোহ পারাবারে ?
কেহ না হবে আপন, কেহ না হবে আপন,
যখন করিবে গ্রাস, নিষ্ঠুর শমন।
শুদ্ধ সেই নিরাধার, শুদ্ধ সেই নিরাধার,
হইবেন ওরে মন, তোমার আধার।
ইথে হওহে চেতন, ইথে হওহে চেতন,
শেষেতে না হবে সঙ্গী, ভাই বন্ধু জন।
সবে ভ্রাতা জ্ঞান করি, সবে ভ্রাতা জ্ঞান করি,
সদ্ভাব করহ সদা, পক্ষপাত হরি।
কর তাঁহারে স্মরণ, কর তাঁহারে স্মরণ,
যিনি হন সকলের, দুঃখ-বিনাশন।
ভাবি মিথ্যা এ সংসার, ভাবি মিথ্যা এ সংসার,
ধর্ম্মের সঞ্চয় কর, শুন কথা সার।
আর ইন্দ্রিয় সেবায়, আর ইন্দ্রিয় সেবায়,
মত্ত হয়ে থাকি যেন, ভুলনা তাঁহায়।
তাঁর লহয়ে শরণ, তাঁর লহয়ে শরণ,
পাইবে তা হলে তুমি, অমূল্য রতন।
হবে আত্মার উন্নতি, হবে আত্মার উন্নতি,
যাহাতে পাইবে মন, চরমেতে গতি।
ধর এই সদুপায়, ধর এই সদুপায়,
তাহলে পাইবে তুমি, পরম পিতায়।

.        *************************      

.                                                                                                
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
ঈশ্বরের মহিমা
শ্রীমতী রমাসুন্দরী
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২) থেকে
নেওয়া

কোথা ওহে জগদীশ জগত জীবন।
কৃপা করি কর মোর, পাপ বিমোচন॥
অধর্ম্মের পথ হোতে, কর মোরে ত্রাণ।
পরাধীনা নারী আমি, নাহি কিছু জ্ঞান॥
নাহি পারি হিতাহিত, করিতে বিচার।
লঙ্ঘন করি হে কত, নিয়ম তোমার॥
এরূপ অজ্ঞানে অন্ধ, আমি মূঢ়মতি।
না পারি বর্ণিতে নাথ, তোমার শকতি॥
জগতের শোভা মরি , কিবা মনোহর।
সকল পদার্থ হয়, অতি হিতকর॥
হায়! কিবা চমত্কার, চারু শশধর।
কেমন শোভিত করে নক্ষত্র নিকর॥
কি দিব উপমা তার, নাহিক তুলনা।
করিতে না পারে কেহ তাহার বর্ণনা॥
যল ফুল বৃক্ষগণ, কিবা সুশোভিত।
মলয় পবন তায়, করয়ে মোহিত॥
পর্ব্বত গহ্বরে আর, নিবিড় কাননে।
শোভিত করয়ে কিবা! পসু পক্ষিগণে॥
এ সকল মহিমার, করিতে তুলন।
মনুষ্য নির্ম্মিত দ্রব্যে, না হয় কখন॥
অতএব ওহে নাথ এই ধরণীতে।
প্রকৃতির শোভা কেহ, না পারে বর্ণিতে॥
কাহার বা সাধ্য পিতঃ! হইবে এমন।
তোমার মহিমা নাথ! করিবে বর্ণন॥
তাহাতে আবার আমি, জ্ঞানহীনা নারী।
তোমার সৃজিত দ্রব্য বর্ণিতে না পারি॥
কেমনে এমন সাধ্য, হইবে আমার।
বর্ণিতে যাহাতে পারি, মহিমা তাহার॥
অতএব তাত মম, হয় এই মন।
দিবা নিশি তোমারে হে, করিতে স্মরণ॥
এই ভিক্ষা এ দীনায় দেহ কৃপাময়।
তোমার আশ্রয়ে কভু বঞ্চিত না হয়॥

.        *************************      

.                                                                                        
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
পুষ্প
শ্রী র, সু, ঘো,
( রমা সুন্দরী ঘোষ  )
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২) থেকে
নেওয়া

হায় কিবা ঈশ্বরের, রচনা অসীমা।
পুষ্পেতে তাঁহার কত রয়েছে মহিমা॥
বিবিধ বর্ণের ফুল হলে বিকশিত।
কিবা তাহে, বনস্থল হয় সুশোভিত॥
আহা! কি কৌশল আছে, পুষ্পের ভিতর।
পুষ্পকোষ বৃন্ত আদি, পাপড়ী কেশর॥
গন্ধবহে গন্ধ তার, লয় দিগন্তর।
সকলেরি হয় তাহে, প্রফুল্ল অন্তর॥
কি বালক, কিবা বৃদ্ধ, কিবা প্রৌঢ়জন।
সকলেই হয় তাহে প্রমোদিত মন॥
নাহিক এমন বুঝি পাষাণ হৃদয়।
দেখিলে পুষ্পের শোভা, মোহিত না হয়॥
পুষ্পময় সিশোভিত, দেখিলে কানন।
ঈশ্বরের হস্ত কেবা, না করে স্মরণ॥
আহা! যিনি করেছেন, পুষ্পের সৃজন।
ধন্যবাদ দাও তাঁরে ওহে নরগণ॥
কি কৌশলে পুষ্প সব, হয়েছে রচন।
কি কৌশলে দিন দিন, হয় হে বর্দ্ধন॥
কি কৌশলে হয় তাহে ফল উত্পাদন।
কি কৌশলে হয় তাহে, গন্ধের সৃজন॥        
ভাবিলে আনন্দে হয়, মোহিত হৃদয়।
ঈশ্বরের প্রতি কত প্রেম উথলয়॥
এ শোভায় যে না স্মরে শোভার আকর,
বিফল নয়ন তার পাষাণ অন্তর॥

.        *************************      

.                                                                                     
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
মধ্যাহ্ন বর্ণন
শ্রীমতী রমাসুন্দরী ঘোষ
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২) থেকে
নেওয়া

দিবা ভাগে তেজোময় মধ্যাহ্ন সময়।
সূর্য্যের কিরণে ধরা সুশোভিত হয়॥
এ সময় পশু পক্ষী, যত জীব গণ।
আহার কারণ সবে, করয়ে ভ্রমণ॥
হেন কালে কিবা জ্ঞানী, কিবা মূর্খ নর।
সকলেরে দেখা যায়, কার্যেতে তত্পর॥
নাহি কারো বুঝি হেন, অলস স্বভাব।
নিরুদ্যম থাকে দেখি, মধ্যাহ্নের ভাব॥
আহা কিবা শোভা ধরে, ধরণী তখন।
যখন আহারে সবে, হয় তৃপ্ত মন॥
যখন বিষয়িগণ, ধনের কারণ।
পরিশ্রম করে থাকে, করি প্রাণ পণ॥
যখম বালকগণ, বিদ্যা শিখিবারে।
সত্বর গমন করে, পাঠনা-মন্দিরে॥
যখন যুবকগণ, জ্ঞান উপার্জ্জনে।
অভীষ্ট করিয়া যায় সুধী সন্নিধানে॥
যখন কৃষক মাঠে, করিয়া গমন।
মৃত্তিকা উপরি করে, হল আকর্ষণ॥
যখন রাখাল গোষ্ঠে, করি গোচারণ।
যত্ন করি করে থাকে, গোপাল রক্ষণ॥
যকন করিয়া সুধী, শাস্ত্র আলোচন।
অনুপম তত্ত্বরস, করে আস্বাদন॥
যখন কুরঙ্গ কুল, তৃষার কারণ।
দিগ্ দিগন্তরে করে, জল অন্বেষণ॥
যখন বরাহ দল, করিয়া যতন।
মৃত্তিকা খুঁড়িয়া মুস্তা, করয়ে ভক্ষণ॥
যখন কেশরীগণ, ক্ষুধার্ত্ত হইয়ে।
আপনার খাদ্য জীব, লয় অন্বেষিয়ে॥
যখন দ্বিরদ গণ, লয়ে সহচর।
পল্লাবাদি খেতে যায়, বনের ভিতর॥
যখম মরাল কুল, জলের ভিতর।
খাদ্য দ্রব্য পেয়ে হয়, প্রফুল্ল অন্তর॥
যখন বিহঙ্গ দল, আহার কারণ।
শূন্য পথে ভ্রমি করে, খাদ্য অন্বেষণ॥
যখন বানর গণ, হয়ে সুখিমন।
বৃক্ষ হতে বৃক্ষান্তরে, করয়ে লম্ফন॥
দেখি ধরণীর এই নবতর বেশ।
নবভাব কার মনে না করে প্রবেশ ?

.        *************************      

.                                                                                     
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
কাশী দর্শন
কবি শ্রীমতী রমাসুন্দরী, কোণনগর’ (১৮৬৪)
বামাবোধিনী পত্রিকার ফাল্গুন ১২৭০বঙ্গাব্দে (ফেব্রুয়ারী ১৮৬৪খৃঃ) সংখ্যায় প্রকাশিত।
বামাবোধিনীতে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় কবিতা। কবিতাটি তার দাদা সত্যপ্রিয় দেবকে চিঠিতে
লিখে পাঠিয়েছিলেন।
এটিই সম্ভবত বাঙালি মহিলার লেখা প্রথম ভ্রমণকাব্য১৮৬৪
সালে এই কবি কাশী শিবলিংগের মধ্যে ঈশ্বর দেখতে পান না। না দেবাদিদেব নয় তিনি শুধু
পাথরের শক্তসৌন্দর্য  টের পান এবং এই কবিতা লেখেন। কবিতাটি আমরা পেয়েছি গবেষক
ডঃ দময়ন্তী দাসগুপ্তর লেখা থেকে, তাঁর ব্লগ - http://jaaichhetaai.blogspot.com/2015/ । তাঁর
ফেসবুক -
https://www.facebook.com/damayanti.dasgupta। যাঁরা ফেসবুকে শেয়ার করেছিলেন
রত্নদীপা দে ঘোষ, তাঁর ফেসবুক -
https://www.facebook.com/ratnodipa  এবং ব্রতী
মুখোপাধ্যায়, তাঁর ফেসবুক -
https://www.facebook.com/broteemukhopadhyay  । আমরা
তাঁদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ। মিলনসাগরে প্রকাশ - ১৮.৩.২০২১।      

বৃহস্পতিবারে যবে, যাইনু কাশীতে।
প্রথম আনন্দ মোর, হইল হৃদিতে॥
মনে করিলাম বুঝি, ভাল এ নগর।
যার নাম হয় ওহে, খ্যাত চরাচর॥
পরেতে যখন গেনু, গলীর ভিতর।
দুর্গন্ধ আইল যবে, নাসিকা ভিতর॥
তখন হইল মম, যে রূপ অন্তর।
লিখিব কি তাহা ওহে, করি সবিস্তার॥
তৎপরে যাইনু যবে, বাসার ভিতর।
গ্রীষ্মেতে হইল মম, দেহ জ্বর জ্বর॥
ভাল বায়ু যাইবারে, নাহি আছে দ্বার।
সে সকল গৃহ যেন, হয় কারাগার॥
তখনি বুঝিনু ইহা, যে রূপ প্রদেশ।
যার নাম হয় ওহে, বিখ্যাত বিশেষ॥
পর দিন যে সময়, দেখিতে দূর্গেশ।
যাইলাম মনে করি, আনন্দ অশেষ॥
যেমন দেখিব এবে, বারাণসী শিব।
যাহার কারণ মুক্তি, পায় যত জীব॥
দেখিনু পরেতে ওহে, সেই বিশ্বেশ্বর।
মন্দিরের মধ্যে আছে, কেবল প্রস্তর॥
দেখিতে না হয় ভাই, কিছু চমৎকার।
কেবল তাহাতে আছে, কাপট্য আচার॥
পুষ্পদন্ত কেদারেশ, আদি দেবগণ।
নাহি হয় তারা কেহ, নয়ন রঞ্জন॥
কেবল মুর্খেতে ওহে, ভক্তির কারণ।
সাক্ষাৎ ঈশ্বর যেন, করে দরশন॥
সে সময় মম মন, যে রূপ হইল।
একেবারে দুঃখ নীরে, মগন হইল॥
কেবল সন্তাপ হলো, অজ্ঞানীর তরে।
আহা, যারা ইহাদের দেব জ্ঞান করে॥
মনে ভাবে আর যারা, করে হেথা বাস।
মোক্ষ ফল পেয়ে হব, পূর্ণ মন আশ॥
আহা তারা হয় অতি, কৃপা পার দীন।
অজ্ঞানতা পিশাচের কেবল অধীন॥
এই রূপ মম মনে, কত দুঃখোদয়।
হইল যে তাহা ওহে, নাহিক নির্ণয়॥
লেখনী না পারে তাহা, করিতে লিখন।
রসনা না পারে তাহা, করিতে বর্ণন॥

.        *************************      

.                                                                                  
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর