কবি শ্রীজাতর কবিতা
*
ফাগুন
কবি শ্রীজাত

এসেছে বসন্তরাজা এই কলকাতায়
আগে পিছে সে কত না লোকজন পাঠায়

বাঁকে বাঁকে ফুটে ওঠে কৃষ্ণচূড়ামণি
বসন্ত কী চীজ, তুমি জান না মামনি

তাহারে ছাড়ায় প্রেম, সাধ্য আছে কার
শাখে-শাখে মাথা কুটছে ডবল ডেকার

বসেছ জানলার সিটে, কোলে পড়ল পাতা
তখন উদাস তুমি। খুলেছ খোঁপাটা . . .

পাতাটা খোলোনি। সে তো চিঠি। টেলিগ্রাম।
বসন্তে না থাকতে পেরে তোমাকে লিখলাম।

একখানা পাগল আজও হাওয়াগন্ধ মাখে
কয়েকদিন দূর থেকে দেখেছে তোমাকে

এবার সিদ্ধান্ত করো--- ভাব অথবা আড়ি
বিশ্বাসে মিলায় ছবি। সান্যালে পাহাড়ি।

.            ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
রাতে যেসব স্বপ্ন আসে
কবি শ্রীজাত

শরীর, শুধু শরীর থেকে গড়ায়
তোমার দিকে আঠালো সম্প্রীতি
সেটাই তফাত জ্যান্ত আর মড়ায়
হুক আর বোতাম খুলছে মেগাসিটি

ফ্লাইওভারে বাঁক খেয়েছে কোমর
হাঁটলে দোলে ইত্তেজনার পারা
সেটাই তফাত হেটেরো আর হোমোর
ভোল্যাপচুয়াস দিগন্তে নীল তারা

দেখতে দেখতে গভীর হল ক্লিভেজ
আজ দু’হাতে দু’দিক চেপে ধরি
ঘাস সরিয়ে জড়িয়ে নিই জিভে
এই শহরের তুলতুলে ক্লিটোরিস

জায়গা মতো ঢাকনা খোলা পেলে
উওম্যান-হোলে ঢুকিয়ে দেব মাথা
একবিছানা ছটফাটানো ছেলে . . .
আমার সঙ্গে সোবে না, কলকাতা ?

.         ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
যাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিলাম
কবি শ্রীজাত

ভাত কাপড় জোটাতে হবে। তাই তো
ফেরার পথে বিক্রি করি আত্মা
যারা সেদিন বন্ধু হতে চাইত,
তাদেরও আজ স্বভাবদোষ। হাতটান।

নতুন মেঘে স্বীকার করি বৃষ্টি।
জলের গায়ে ভাসিয়ে দিই দূরবিন
সময় বলে--- ‘এটাই শেষ কিস্তি।
বাকি জীবন পাগল হয়ে ঘুরবি।’

ঘুরেছি। আর গোপন সব চিহ্নে
খুঁজেছি মরা জাদুকরের পসরা
বুঝেছি তাকে পাবার কোনো সিন নেই
ওষুধ খেয়ে ঘুম হয় নি দশ রাত।

ঘুমের নীচে নানারকম টুথপিক
তাতে আমার দু’চোখ যায় ঠিকরে
সময় বলে--- ‘বাকি জীবন ছুটবি।
বুকের কাছে পাথর হবে সিক্রেট।’

হয়েছে। তাই বিক্রি হওয়া সার্থক।
ভাঙা মুঠোয় আংকড়ে ধরি নীল দাঁত
আমায় শুধু বাঁচিয়ে দিতে পারত
মেয়েটি, যার নাম ছিল মাতিলদা . . .

.         ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
চিলেকোঠার ঘুম
কবি শ্রীজাত

সর্বনাশের মাথায় বাড়ি
বাড়ির মাথায় ছাদ

একটা মাদুর, তিনটে বালিশ
আটখানা আহ্লাদ

খোশমেজাজের গন্ধ ঘেরা
চিলেকোঠার ঘুম

পাঁচিল খসায় পলেস্তারা
পাখিরা নিঃঝুম

আঁচল থেকে নকশা নামে
উনুন থেকে আঁচ

মুঠোর ভেতর খচরমচর
বন্ধু ভাঙা কাচ

তিনটে বালিশ, একটা মাদুর
দোহারা পিলসুজ

আকাশ থেকে আলো পাঠায়
রূপোলি তরমুজ

নোনতা রঙের জোছনা লেগে
শরীররে হৈ চৈ

মিনিট জমে রাত বানাল
আড্ডা জমে দই

চামচ দিয়ে আলতো ক’রে
তিনটে সমান ভাগ

ঝাপতালে তার শব্দ থাকে।
কামড়ালে তার দাগ।

চিলেকোঠার ঘুম ভাঙে না
কীসব খেলা হয়

তিনজোড়া হাত খিদের ছকে
চেলেছে সংশয়

বাকিটা ভুল, বাকিটা ঝড়
বাকিটা নিশ্বাস

ক্লান্ত, সুখী, তপ্ত, নরম,
অল্প ভেজা ঘাস

এরপরে যেই সকাল হবে
কাজ পোহাবে লোক

রোদের টোকায় ঘুম ছাড়াবে
চিলেকোঠার চোখ

দেখতে পাবে চৌকাঠে তার
নতুন রকম স্বাদ

জল খাবারে গরম বালিশ
মাদুর পাতা ছাদ . . .

.       ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
তোমাকে শেষ চিঠি
কবি শ্রীজাত

ঘুমে ঝগড়ায় ঘুমে ঝগড়ায় ঘুমে
ছেড়ে তো এলাম বরফের মরশুমে

এখনো তোমার ওভারকোটের কাছে
আদরের মতো কী একটা লেগে আছে . . .

ও নিয়ে ভেবো না। উইকেণ্ড-এর রাতে
আমাকে যদি বা না-ও মনে পড়ে, তাতে

বিস্ময় নেই। হাইওয়ে আছে শুধু
ছেড়ে আসা যত, তার চে’ওবেশী ধূ-ধূ . . .

মাঝে টিম টিম দেকোনপাটের বাকি
ছেড়ে তো এলাম বয়েসের বরসাতি

এখনো ওখানে সামান্য বিনিময়ে
দু’জনের ঠোঁট রাখা যায়, একই স্ট্র-এ ?

একা যদি যাও ড্রাইভে, কিনো
হাইওয়ে থেকে, মাঝরাতে, ক্যাপুচিনো

.          ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আষাঢ়
কবি শ্রীজাত

ভেসে গেল আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে---
ক্যাপচার করেছ মম হৃদয় কী বসে

নাওয়া নাই খাওয়া নাই হাওয়া নাই কোনও
কেবল জলের তোড়ে দাওয়াটি নিকোনো।

বৃষ্টি আসে ঝেঁপে, আমি কান্না চেপে আছি
ঠাণ্ডা বুকে ঠেসে ধরছি গরম পেঁয়াজি

কেহ বলে পথ্য খাও, দেখাও ডাক্তার
কেহ বলে শুনে দ্যাখো বেগম আখতার---

কেহ বলে ও কিছু না। বর্ষার বিলাস
টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে। কী জ্যান্ত, কী লাশ।

গুটিয়ে নিয়েছি প্যান্ট, হাঁটু অব্দি জল
জোয়ারের স্রোতে একা ছিপছিপে হিজল

ডুবেছে প্রথম দিনে। বোঝে বা ক’জনই
কী ভাবে সাঁতরাই বলো, সহস্র রজনী

.          ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
শ্রাবণ
কবি শ্রীজাত

সে ছিল আমারই দেশ, মেঘের পুজারি
এখন সন্ত্রাস চলে। দ্যাখো, কার্ফু জারি---

১৪৪ ধারা। যে বেরোবে, লাশ।
ভরেছে শ্রাবণ ? তব জলের গেলাস ?

সমুদ্রের তীরে বসে কাঁঠেলে ছোঁয়াচ
দেশ কাল ডুবিয়ে, আহা, ঘুম যাচ্চো আজ . . .

ডাকতে গেছি, বলে দিলে--- ‘রেস্ট নিচ্ছি। যা তো!’
তোমার ধুমের নীচে ক’লক্ষ শ্রীজাত

ডুবে মরতে-মরতে যাবে, ঝরতে-ঝরতে যাবে . . .
তার আগে তোমার স্বপ্ন ঝলসাক তেজ়াবে

কে আছো ? জাগাও ওকে। চড় মেরে ওঠাও---
মুখ ধুলে কুলকুচিতে ডুবে মরব, তাও

পরাবো কংক্রিট-স্মৃতি, নিজ হাতে বোনা
ভুলবে শ্রীজাতদের ? সুজোগ দেব না!

.           ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কার্তিক
কবি শ্রীজাত

সামনে বি.এ. ফাইনাল। বইয়ে মন দিয়ো।
যা কিছু উদাস, ফালতু, জীবনানন্দীয়,

যে বাংলা মদের রাজা, যে বাংলা রূপসী
তার সামনে নত হই। আলুথালু বসি।

কোথাও যাব না। সেই এক গোঁয়ার্তুমি।
আমাকে জ্বালায় রাগ। ঝগড়া। আর তুমি ?

তোমাকে মানায় শুধু কোচিংয়ে-কলেজে
‘হৃদিপথে এসো প্রিয়া’---এ কথা বলে যে,

তারে অন্ধ করে দাও। ভিক্ষায় বসাও।
একবেলায় ঘুচে যাক প্রেমিক দশাও

হাওয়ায় হিমের ঠাণ্ডা, স্পর্শ রেখ চিনে
তোমাকে মানিয়ে যাক কলেজে-কোচিংয়ে

ঝরুক হলুদ পাতা... হেঁটো না ও পথে
হেমন্ত ঋতুর শ্রেষ্ঠ। মুখার্জিরও বটে।

.           ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ডিপ্রেশন
কবি শ্রীজাত

ডিপ্রেশনের বাংলা নাকি নিম্নচাপ ?
বৃষ্টি এল। সঙ্গে কফি এক-দু’কাপ

নামছে বিকেল, অল্প ভিজে রাস্তাঘাট
ছাতার নীচে মিইয়ে গেল পাপড়ি চাট

বন্ধুরা সব ফিরছে বাড়ি দূর থেকে . . .
কেন যে আজ হিংসে হল তাই দেখে,
দেখতে গিয়ে সন্ধে হল জানলাতেই
আগের মতো মেঘ করেছে . . . কান্না নেই

কেবল মুঠোয় বন্দী কফির একলা কাপ
ডিপ্রেশনের বাংলা জানি। মনখারাপ।

.           ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সমাপতন
শ্রীজাত
(
সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন চলাকালীন এই কবিতাটি 'পর্বান্তর' পত্রিকার মে - আগস্ট ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত
হয়েছিল |
)

সমাপতন এমনই হওয়া উচিত
আমার মাথা তোমার বন্দুক |
কর্ম থেকে আলাদা হল সূচি
মুখোশ থেকে বেরিয়ে এল মুখ |

তোমার নাকি রাস্তাই ছিল না
মানুষ কেটে ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া ?
আমার কাজ মৃত্যু হাতে গোনা
মপলে তবে শান্ত হয় পাড়া |

দেখালে তুমি কি ভাবে নিতে হয় |
গণতন্ত্রে এমনই হওয়া উচিত |
পাতাল থেকে উথলে উঠে ভয়
পোশাক খুলে দাঁত দেখায় রুচি |

আমরা সেই রুচি খাই-পড়ি
আমরা সেই রুচির গান গাই
মুখে যখন বলেছি "মরি মরি"
বুকে তখন বুলেট বেঁধা চাই |

বিঁধেছে | তারই রক্ত লাগে হাতে |
বাকি জীবন তোয়ালে দিয়ে মুছি ?
তুমি তখন ছিলে না সাক্ষাতে
সমাপতন এমনই হওয়া উচিত |

.           ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   
.                             
অন্যান্য কবিদের সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের কবিতার সূচির পাতায় . . .    
.                                           
সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের কবিতার মূল সুচির পাতায় . . .   



মিলনসাগর