পাতাগুলি ঘুরে-ঘুরে পড়ে যাচ্ছে ঘাসে অলৌকিক জীব জলের উপরে ভাসছে হননের আপ্রাকৃত তৃষা সে এখন পুরাতন রোমহর্ষে আবেগে রয়েছে যেহেতু সাঁতরে আসছে জলের পর্দার নিচে সেইসব ক্ষতের গভীরে যেখানে কবিতা লেখা মরে যাচ্ছে রোগ শোক জরার ভিতরে যাত্রাগানের ব্যাঙেদের যে-সব চামড়া সোনালি ছিল, তারা অবসন্ন হয়ে পড়তে থাকে যেহেতু ভিমরুলের ঝাঁক উজ্জ্বল দাঁতের ফাঁকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছে তাদের সুনীল কাঁচির ফলা দুটি খুলে গেলে যে-রকম নিরিবিলি পরিশিষ্ট জাগরুক হয় মাঝামাঝি অন্ধকারে নির্বিশেষে শেষ করে দিতে সে-রকমভাবে শেষ হয়ে যেতে থাকি . **************** . সূচিতে . . .
উত্তরপুরুষ ১৪ কবি ভূমেন্দ্র গুহ অনুপকুমার মহাপাত্র সম্পাদিত “সহজ পাঠের কবিতা” থেকে নেওয়া।
এবার পিতাকে আমি তাঁর ক্ষুণ্ণ হতোদ্যম তক্তপোশ থেকে তুলে এনে বসালুম | পুরাতন ছিটেফোঁটা কাপড়চোপড় যা সব পরতেন তিনি, পরে তাঁর গৃহাঙ্গনে গিয়ে দাঁড়াতেন
যে-সব শরীরে তাঁর সন্তর্পণে সাজালুম : ছেঁড়া পাঞ্জাবিটি ভাঁজে-ভাঁজে কেটে গেছে – শুধু বৃথা পড়ে ছিল : তাঁতের ধুতিটি ছেলে দিয়েছিল, তবি পরেন নি, পরবেন দূরে যেতে হলে ;
জামার বোতামগুলি প্লাসটিক, বেঁধেছেন নিজেই সুতোতে ; ক্যাম্বিসের জুতো, তার কোনা ফাটা, রেখেছেন যথেষ্ট ঝকঝকে ; বললেন, এই জল কোথায় যাবে কি জানো, গঙ্গায় যাবে ?
বললুম, সমুদ্রে যাবে, সেই সব নুনে যাবে, নুনে মাছগুলি শক্ত থাকে | তিনি জলে ঝুঁকলেন ঝুঁকে পড়ে বললেন, তরী, এবার ভাসো তো | ব’লে নৌকার পালের সব সিক্ত দড়িদড়া খুললেন, তুললেন, ললাটে সিঁদূরলেপা বর্ণাঢ্য নৌকোকে জলের আক্রোশে নিয়ে ফেললেন, বললেন, এই বার আসি | এত রঙ জ্বলে উঠল, এত আভা, এত জল, লোহিত আগুন |
পাখিগুলি এত শাদা পতাকার মতো যেন নভোনীলে উড়ে ঘুরে ঘুরে চোখে তাঁর খ’সে প’ড়ে যাচ্ছে, তিনি নির্ণিমেষ রোদে অন্ধকার দেখলেন শরীরের আদি-অন্তে নববাসে ঘরে |
সেই ক্ষুদ্র পাটাতনে লাফিয়ে উঠলেন আর উজ্জ্বলন্ত বায়ু তাঁর কন্ঠে ওতপ্রোত কথা বলল দেখলুম, তাঁর সমারূঢ় নৌকোটি স্রোতের শীর্ষে বিবিক্ত হাওয়ার শীর্ষে লাফাল --- লাফাল----
কাৎ হয়ে গেল ব’লে ফেনপুঞ্জ নৌকোয় ঢেলে দিল জল | আমি কেঁদে ডাকলুম, বললুম, এখন ফেরো, কোথায় যাবে যে, কী পাবে কী দেখবে, তা কি জানো তুমি ? জানো না তো, ফেরো ! এবার নৌকোর মুখ পিছনের দিকে গেল ; লেলিহান শিখা আকাশের কাছাকাছি লাল হয়ে ফুলে উঠল ; অবিশ্রান্ত জল দারুণ কোটালে ফিরল এক অবজ্ঞাতে থেমে আর এক অজ্ঞাতে |
সেই সব লাল ঝড় শান্ত হল তাঁর চোখে নদীর চড়ায় এবং আমার চোখে তিনি তাকালেন ঝুঁকে ; বন্দর জন্মাল | আমি বললুম, পিতঃ, তখন কী হল বলো যখন তোমার
মৃত্যু হল, পুড়ে গেলে ? বললেন সমস্ত জল কোথায় গিয়েছে এবং আমাকে তিনি সাজালেন চীরবাসে ফতুয়া-পাজামায় | . **************** . সূচিতে . . .
তার মুখে আভা ছিল ফসলের মতন সরল, তার মুখে অন্ধকার শ্মশানের নিস্পৃহ কাঠের, যতদিন তৃণশয্যা রয়েছে ভূমিতে, আছে কৃষ্ণকান্ত অবিরল হিম, ততদিন তাকে ভুলে যেতে পারা অবিমৃশ্য হবে |
তারপর রোদ জ্ব’লে উঠল মিঠে, পলাশ শিমুল ফুল ফুটল অদূরে, বিশেষ্যকে পাশে নিয়ে বাক্যগুলি শুয়ে থাকল ঘাসে নিঃশব্দতাতে | একাকী অন্বয় এসে যথেষ্ট নিঃস্বার্থ ভাবে উচ্চারণ করে গেল ‘এবং’----- ‘এবং’---- শিহরিত বনানীও বিভ্রাম্ত হয়েছে সেই শব্দপুঞ্জে, তবু সমস্ত সবুজ পাতা প্রতারিত হয়ে রইল সর্বনাম তার অঙ্গশোভা আলিপ্ত শরীরে এসে জলকন্যা হল না আবার |
এই ভাবে হল সব, সময় নিশ্চল স্থির হয়ে রইল মেঘে ওই ঠোঁটে দাঁতে গালে গলার আড়ালে আলজিভে ঘাড়ের পিছনে সেই কৃষ্ণবর্ণ বিন্দুটিতে সজাগ জীবন্ত হয়ে ছিল যা একদা সর্বনাম গিলে ফেলে পরিপাক করেছিল বাক্যটি যেহেতু | একটি চুম্বন শুধু বিমোহিত থেকে গেছে ঠোঁটের উপরে, ইরেজার ঘ’ষেও বিবর্ণ করা যাবে না কখনো যাকে, যতদিন ভাষা সব ব্যাকরণ ধ্বংস ক’রে ফেলে সেই ছাই মেখে নিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে | . **************** . সূচিতে . . .
আমার নার্সটি কবি ভূমেন্দ্র গুহ নিতাই জানা সম্পাদিত “পোস্টমর্ডান বাংলা কবিতা” থেকে নেওয়া।
আমার নার্সটি ছেলেমানুষ, ছোটো, সাত-আট বছরের একটি মেয়ে যেন, ছোটো, হাঁটু থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত যদ্দুর দেখা যায়, মসৃণ, উজ্জ্বল, ছোটো একটি নাবালিকা কালীমূর্তির মতো, তার পায়ের উর্বর গোছের মতো, ছোটো মুখ, ছোটো নাক, ভাসা চোখ, নাকে নোলক, কানের সরু লতিতে ফুল, কপালে বিন্দি, কালো পুঁতির মালা গলায়, ছোটো মেয়ে, কালো, বাঁশীর মতো সুচলো গলা, কথা বলা, অর্থাৎ আদেশ করা, অর্থাৎ শুশ্রূষা, সরু সিঁথিটি শাদা বা ধুলোমাখা, চুল সামান্য রুক্ষ অতএব আগোছালো, কাঁধ পর্যন্ত, ছোটো, কালো, দেখা যায় কী যায় না, যা দেখা যায় না, তার চিহ্নগুলি গূঢ় গহন, মেপে নিতে হয়, খুঁজে-পেতে নিতে হয়, নিতে-নিতে বললুম, তুই তো চিনু | সে বলল, না, মল্লিকা |
এক নাগাড়ে কথা বলতে-বলতে অবসন্ন হয়ে পড়েছিলুম, মাথার ভিতর ধোঁয়া ফেনিয়ে উঠছিল, বললুম, বেশ, তুই চিনু—
সে বলল, আপনি বড়ো বেশি কথা বলছেন, এত বলছেন যে ঘুমোচ্ছেননা, এ-রকম বড়ো খোলা ঘরে তো রাখা চলবে না আপনাকে--- আমি আপনাকে একটি ছোটো ঘরে, আরো ছোটো ঘরে, আরো আরো ছোটো ঘরে রেখে দেব, ঘুমের ওষুধ দেব---
আমি বললুম, আমি বড়ো, এত বড়ো, তুই ছোটো, এত ছোটো, ছোটো ঘরে রাখবি কী ক’রে, তোর লাগবে না ?---
সে বলল, রাখবই--- ঘুমোন না কেন---
সে আমাকে তার পছন্দসই ছোটো ঘরটির ভিতর রেখে দিল | আমি বললুম, তুই যখন এত ব্যথা পেতে ভালোবাসিস, রাখ | আমি ব্যথা দিতে ভালোবাসি না, খোলা দরজা ভালোবাসি | ছোটো ঘরের বড়ো দরজাটা তুই খুলে রাখিস---
সে দরজা খুলে রাখতে চাইল না, তবু রাখল |
সেই রাত্রে দরজা পেরিয়ে আমি অনেক এলুম গেলুম | কিন্তু কথা বললুম না | সমস্ত রাত যুদ্ধ করলুম, তবু কথা বললুম না | কার সঙ্গে যে যুদ্ধ না করলুম | সেই যে কেমন এক রকম ভাবে অশক্ত আঙুলে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখা, অর্থাৎ প্রশ্নমালা ; সেই যে আবছা মতন চাঁদের আলোর ভিতরের ঘনকৃষ্ণ ইচ্ছেগুলি, অর্থাৎ প্রচ্ছদের ওপারের আলো- অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে দেখা, চোখ খুলেই কুয়াশামলিন জলের নদীটিকে নিঃসাড়ে বড়ো জলের দিকে ব’য়ে যেতে দেখা, তার বিলীন অভিজ্ঞতা ; এই সমস্ত কঠোর ভীষণ জিনিসপত্রে শীতের দীর্ঘ রাত্রি নিবন্ধন হিসিতে-ভেজা হিম কাঁথার প্রলেপে লুকিয়ে রেখে ভয়ে কাঁপতে থাকা ; ভয়, যে-ভয় এই সমস্ত জানাগুলিকে হজম করতে পারার মতো সাবলীল সাহস সঞ্চয় করতে না পারার জন্য, যে-ভয় প্রায় অলঙ্ঘ্য : যুদ্ধ এদের সঙ্গে ! আসা-যাওয়া কী সেই দুর্নিরীক্ষ্য না-কথা-বলা মৌনের ভিতরে বাহিরে !
খাড়া উত্তুঙ্গ একাকী পাহাড়টির গা বেয়ে উঠতে খুব কষ্ট হতে লাগল | সামনে যাঁরা হেঁটে যাচ্ছেন চুপচাপ খোলা পায়ে খোলা গায়ে, তাঁরা তাঁদের কষ্ট উপভোগ করছেন সারাবেলা | সব কষ্ট গুছিয়ে তুলছেন তাঁদের নিঃস্ব উত্তরীয়গুলির খুঁটে | আর কৃশ রূগ্ ণ রোঁয়া-ওঠা সেই কুকুরটি, আকাশের এত ভিতরেও, বরফের এত ভিতরেও, আলোকের এত ভিতরেও, সমূহ প্রত্যাখ্যানের এমন মুখোমুখি, সে-ও তো তার সকল কষ্ট গোলাপি জিভের ডগায় কেমন চেখে দেখতে পারছে ! আমি আমার নার্সটিকে প্রায় চিৎকার ক’রে বললুম, আমি আর ঘুমের ওষুধ খাব না----
মল্লিকা প্রতিবাদ ক’রে উঠবার মুখে আমি আবার প্রায় নিভে যেতে-যেতে বলতে লাগলুম, চিনু, তোর এত বেশি ব্যথা পাওয়া আমার আর সহ্য হচ্ছে না, তোর এত বেশি নিজেকে দিয়ে দেওয়া আমি আর নিতে পারছি না, আমার এত বেশি কষ্ট আমি তো নষ্ট করব না--- আমি ওষুধ খাব না---- আমি ঘুমোব --- . **************** . সূচিতে . . .
নতুন বছরের সকাল কবি ভূমেন্দ্র গুহ নিতাই জানা সম্পাদিত “পোস্টমর্ডান বাংলা কবিতা” থেকে নেওয়া।
নতুন বছরের সকালবেলাটা আর তেমন নরম নেই এখন, পেকে উঠছে ধীরে | খাবার-টেবিলে বসেছি যখন, খাবার মুখের কাছে উঠেছে যখন, প্রায় তখনই ঝড় উঠল বাইরে, জানালার ঠিক বহির্মুখে, দরজায় | আমাদের হতদরিদ্র মলিন গ্রামটিতে, যা কিনা আমাদের অতিযাপিত অভ্যাসগুলির মতো একটেরে ও খোঁড়া |
হঠাৎ----নিদারুণ ---বাজ পড়ল কাছে ; পাতা উড়ল ধারালো তীরের মতো ক্ষিপ্র ; জল পড়ল জ্বলন্ত ফোস্কার মতো গোল পাতলা, দিনগত পাপক্ষয়ে আমার যে-বউটি--- তার খসখসে চামড়ায়, উঠোনে খেলে বেড়ানো আমার যে বেরিবেরি-হওয়া ছেলেটি হাবাগোবা রুগ্ ণ ধুলোমাখা – এক্কেবারে তার খড়িওঠা ক্ষীণ শরীরটির উপরে ; ঝড় জল বাজ ঘূর্ণি ছেলেটিকে শোলার মতো প্রায় রাস্তার শিখার উপরে উড়িয়ে নিল, সমন ধরিয়ে দিল হাঘরে, খুন ক’রে ফেলবে,. ঠিক খুন ক’রে ফেলবে, এ-রকম ভাবে ডেকে নিতে গেল তাকে বধ্যভূমিতে----
বিদ্যুতের ঝকঝকে খাঁড়া লাফাতে লাগল, দেখলুম ; ফেটে যেতে লাগল আগুনের গোলাগুলি, দেখলুম ; আরও আমি দেখলুম, ছেলেটি অসাড় অশক্ত প’ড়ে থাকল ব’লে সে আগুনের ভিতরের নীল শাঁসের মতো একটি উজ্জ্বল ছবি হয়ে উঠতে লাগল চুপিসারে |
এবং আমাদের অস্তিত্বের একগুঁয়ে সব কাঠামোগুলি তখন ভেঙে পড়তে লাগল, গড়িয়ে যেতে লাগল উড্ডীন দেয়ালের গুহাচিত্রে, বাইরে | রঞ্জনরশ্মিসিদ্ধ একটি আলোকচিত্র গড়ে উঠল--- হাড় মাস রক্ত একটি নিটোল অবশিষ্ট ছায়া মাত্র তখন---- হাড় মাস রক্ত ও হৃৎপিণ্ড তার বেশি সে-সব আর কিছু মাত্র নয় |
মূলত বিভিন্ন কিন্তু সমষ্টিভাষিত একটির পর একটি অনস্তিত্বে চেহারা তারপর প্রতিভাত হতে দেখতে লাগলুম আমি : ধুলোমোড়া তবু ভিজে গ্রামের সেই রাস্তাটি, সিঁড়িঘরের নিচের কাতর বেড়ালছানাগুলি, চড়ুই পাখিগুলি জলে-ভেজা ঘুলঘুলিতে, দারাপুত্রপরিবার --- এবং আমি--- কপালের বিলীয়মান দইয়ের ফোঁটার মতো সেই স্বাতন্ত্র্য বা নিজস্বতা, যা এই মুহূর্তে ঝড়েজলে দাপাতে-থাকা প্রাচীন বটগাছের শিকড়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে আগাগোড়া, উড়ে যাচ্ছে তারপর কৃষ্ণচূড়ার থেকে দূরে মেঘে তারপর নেমে আসছে আবার দীর্ঘ শরবনের বিস্ফারিত ফলকগুলিতে----
সময়ের দীন বালুকণাগুলি এখন বিশ্লিষ্ট হচ্ছে, হয়ে গিয়ে স্বচ্ছ ঘাসের মতো হচ্ছে সব | নিজেরাই হয়ে উঠছে, কী হয়ে উঠতে পারে স্বাবলম্বে নিজেরাই ঠিক ক’রে নিচ্ছে তারা | এবং সব উজ্জ্বলতা ও অহঙ্কার, স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য, যা উপার্জিত হয়েছে আমার সব খোঁড়া হয়ে যাচ্ছে---- জাদুকরের অবিনশ্বর সেই হাড়ের লাঠিটি ন’ড়ে উঠছে ব’লে, গ’লে যাচ্ছে সব শরীর, একাকার হয়ে যাচ্ছে সব অকাল-অন্ধকারে . এখন শুধু নিস্তব্ধতা, অনিশ্চয়তা ও অনির্ণয় . ছেলেটির অমৃত অসাড় বিবর্ণ ইচ্ছাগুলির মতো যেন . এখন সব স্বচ্ছ ও স্ফুরিত ও বর্ণহীন | . **************** . সূচিতে . . .
’৪৯ মডেলের ফিয়াট কবি ভূমেন্দ্র গুহ নিতাই জানা সম্পাদিত “পোস্টমর্ডান বাংলা কবিতা” থেকে নেওয়া।
. আমার সেই ৪৯-মডেলের ফিয়াট গাড়িটি এখনও রয়ে গেছে | আজকের দিনে এই গাড়িটাকে নিয়ে আর আমার চলে না, ভাবি |
তবু আমি গাড়ি চালানো শিখেছিলুম তো একদিন |
মাস্টারমশাই বলেছিলেন, সামনের রাস্তায় হাম্প আছে, তার পরেই একেবারে ইউ- টার্ন ডান দিকের বাঁক | ব্যাক গিয়আএ পিছনের দিকে ঘোড়াও, সাবধানে |
. তিনি যা বলেছিলেন, সত্যি | অধিকন্তু, রাস্তাটা অন্ধ ছিল, উপরে-নিচে টালমাটাল ছিল, গুঁতোগুঁতি ভিড়ও কম ছিল না | আমি বশংবদ ছাত্রের মতো পিছনের দিকে মুখ ঘুরিয়েছিলুম, বিশ্বাস করেছিলুম, খুব সন্তর্পনে চালিয়েছিলুন গাড়ি, বার-বার ফিরে তাকাতে-তাকাতে | পিছনে ফিরে তাকাবার বিষয়টায় আমি খুব সড়গড় হয়ে উঠেছিলুম |
. আমার বয়স তখন খুব বেশি পেকে ওঠে নি, ব্যাগি পরতে ভালোবাসতুম | সেই ঢোলা ঢলঢলে জামার ভিতরে থেকে কেউ এক জন, সেই সব একনিষ্ঠ মুহূর্তে তখন, আমার বুকের উপরের লাজুক চামড়ায় খুব জোর চিমটি কেটেছিল, বা তার আঙুলের সুঁচলো নখে আঁচড়ে দিয়েছিল ; আমি গ্রাহ্য করি নি |
. তারপর মাস্টারমশাই সদয় হেসে বলেছিলেন, এবার স্পিডের মাথায় থামো তো দেখি, এমন ভাবে ব্রেক কষবে যেন গাড়ির সামনে বিপদ প’ড়ে গেছে একটা, যা তুমি পছন্দ করছ না |
. আমার মেয়েটি তখন থুবই ছোট, ডলপুতুলের মতো গোলগাল লাল, পুতুল খেলতেও ভালোবাসে খুব | সে আমার পাশে-পাশে থাকত | তাতে কী, বা ঠিক তা জন্যই হয়তো, আমি আমার ডান পায়ের পাতা আদ্যন্ত ডুবিয়ে দিলুম ব্রেকের পাদানি উপরে জোরে, হঠাৎ-ঝাঁকুনিতে মেয়েটি গিয়ে ছিটকে পড়ল ড্যাশবোর্ডের উপরে, ব্যথা পেল, বেশ ব্যথা পেল, কপাল কেটেও গেল হয়তো। আমি সে সব নিয়ে খুব একটা ভবাতে গেলুম না ; নিজের কৃতিত্বে আমি অত্যন্তই সুখী হয়েছিলুম, প্রয়োজনে গাড়িটা আমি নিখুঁত থামিয়ে দিতে পেরেছিলুম তাই। থামতে পারা ব্যাপারটা আমি তাহলে রপ্ত করতে পেরেছি বেশ!
. এরপর মাস্টারমশাই আর গাড়ি থামাতে বলেনি আমাকে, তিনি খুশি হয়ে বলেছিলেন, ভালো। আমি থেমে-চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলুম। যে-আমি অভিনিব্ষ্টে গাড়ি চালাচ্ছিলুম, এবং যে আমার অনভিজ্ঞ ছোটো মেয়েটি পাশে ব’সে ছিল আমার, আমি তাদের কথা যে একেবারেই মনে আমি নি, তা নয়। কিন্তু জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখেছিলুম যে, শীত- শীত হাওয়া এসে পড়েছে কখন, কৃষ্ণচূড়ার ও শিরিষের বড়ো গাছগুলি থেকে চিলু-চিলু পাতা ঝ’রে যাচ্ছে অঝোর,ফুটপাথ প্রায় আকণ্ঠ ডুবে আছে বিন্দু-বিন্দু হলুদে ; মেয়েটি কি তখনও ব্যথা পাচ্ছিল ভিতরে-ভিতরে?
. মেয়েটি এখন বড়ো হয়ে উঠেছে আমি যেমন এককালে হয়ে উঠেছিলুম। আমারও এখন অনেকটাই বয়স বেড়ে গেছে। তবু গাড়িটা এখ পর্যন্ত আমারই। এখন যেন আর আমার ওটাকে দিয়ে চলতে চায় না। . **************** . সূচিতে . . .