কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজের বৈষ্ণব পদাবলী |
পট্টবস্ত্র অলঙ্কারে সমর্পিয়া সখী করে ভণিতা কৃষ্ণদাস কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ১৮শ পরিচ্ছেদ, পৃ-২৭৮। যথা রাগঃ। পট্টবস্ত্র অলঙ্কারে সমর্পিয়া সখী করে সূক্ষ্ম শুক্ল বস্ত্র পরিধান। কৃষ্ণ লঞা কান্তাগণ কৈল জলবগাহন জলকেলি রচিল সুঠাম। সখি হে! দেখ কৃষ্ণের জলকেলি রঙ্গে। কৃষ্ণ মত্ত করীবর চঞ্চল কর পুষ্কর গোপীগণ করিণীর সঙ্গে॥ ধ্রু॥ আরম্ভিল জলকেলি অন্যান্যে জল ফেলাফেলি হুড়াহুড়ি বর্ষে জলাধার। সবে জয় পরাজয় নাহি কিছু নিশ্চয় জলযুদ্ধ বাড়িল অপার॥ বর্ষে স্থির তড়িদ্ঘন সিঞ্চে শ্যাম নবঘন ঘন বর্ষে তড়িত উপরে। সখীগণের নয়ন তৃষিত চাতকীগণ সে অমৃত সুখে পান করে॥ প্রথমে যুদ্ধ জলাজলি তবে যুদ্ধ করাকরি তার পাছে যুদ্ধ মুখামুখি। তবে যুদ্ধ হৃদাহৃদি তবে হৈল বাদাবাদি তবে হৈল যুদ্ধ নখানখি॥ সহস্র কর জল সেকে সহস্র নেত্রে গোপী দেখে সহস্র পদে নিকটে গমনে। সহস্র মুখ চুম্বনে সহস্র বপুঃ সঙ্গমে গোপী নর্ম্ম শুনে সহস্র কাণে॥ কৃষ্ণ রাধায় লঞা বলে গেলা কণ্ঠমগ্ন জলে ছাড়িল তাঁহা যাঁহা অগাধ পানী। তিঁহো কৃষ্ণকণ্ঠ ধরি ভাসে জলের উপরি গজোত্ঘাতে মৈছে কমলিনী॥ যত গোর সুন্দরী কৃষ্ণ তত রূপ ধরি সবার বস্ত্র করিল হরণ। যমুনাজল নির্ম্মল অঙ্গ করে ঝল মল সুখে কৃষ্ণ করে দরশন॥ পদ্মিনীলতা সখীচয় কৈল কারও সহায় তার হস্তে পত্র সমর্পিল। কেহ মুক্ত কেশ পাশ আগে কৈল অধোবাস হস্তে কেহ কঞ্চুলী ধরিল॥ কৃষ্ণের কলহ রাধা সনে গোপীগণ সেই ক্ষণে হেমাব্জ বনে গেলা লুকাইতে। আকণ্ঠ বপু জলে পৈশে মুখ মাত্র জলে ভাসে পদ্মে মুখে না পারি চিনিতে॥ এথা কৃষ্ণ রাধা সনে কৈল যে আছিল মনে গোপীগণ অন্বেষিতে গেলা। তবে রাধা সূক্ষ্মমতী জানিয়া সখীর স্থিতি সখীমধ্যে আসিয়া মিলিলা॥ যত হেমাব্জ জলে ভাসে নীলাব্জ তার পাশে আসি আসি করয়ে মিলন। নীলাব্জ হেমাব্জে ঠেকে যুদ্ধ হয় প্রত্যেকে কৌতুক দেখে তীরে গোপীগণ॥ চক্রবাক মণ্ডল পৃথক্ পৃথক্ যুগল জল হৈতে করিল উদ্গম। উঠিল পদ্ম মণ্ডল পৃথক্ পৃথক্ যুগল চক্রবাকে কৈল আচ্ছাদন॥ উঠিল বহু রক্তোত্পল পৃথক্ পৃথক্ যুগল পদ্মগণে কৈল নিবারণ। পদ্ম চাহে লুঠি নিতে উত্পল চাহে রাখিতে চক্রবাক লাগি দোঁহার রণ॥ পদ্মোত্পল অচেতন চক্রবাক সচেতন চক্রবাকে পদ্ম আস্বাদয়। ইঁহা দোঁহার উল্টা স্থিতি ধর্ম্ম হৈল বিরৃপরীতি কৃষ্ণের রাজ্যে ঐছে ন্যায় হয়॥ মিত্রের মিত্র সহবাসী চক্রবাকে পদ্ম লুঠে আসি কৃষ্ণের রাজ্যে ঐছে ব্যবহার। অপরিচিত শত্রুর মিত্র রাখে উত্পল এ বড় চিত্র এ বড় বিরোধ অলঙ্কার॥ অতিশয় উক্তি বিরোধাভাস দুই অলঙ্কার প্রকাশ করি কৃষ্ণে প্রকট দেখাইল। যাহা করি আস্বাদন আনন্দিত মোর মন নেত্র কর্ণযুগ জুড়াইল॥ ঐছে বিচিত্র ক্রীড়া করি তীরে আইলা শ্রীহরি সঙ্গে লঞা সব কান্তাগণ। গন্ধতৈল মর্দ্দন আমলকী ঊর্দ্ধত্তন সেবা করে তীরে সখীগণ॥ পুনরপি কৈল স্নান শুষ্ক বস্ত্র পরিধান রত্ন-মন্দিরে কৈল আগমন। বৃন্দাকৃত সম্ভার গন্ধ পুষ্প অলঙ্কার বন্যবেশ করিল রচন॥ বৃন্দাবনে তরুলতা অদ্ভুত তাহার কথা বারমাস ধরে ফুল ফল। বৃন্দাবনে দেবীগণ কুঞ্জদাসী যত জন ফল পাড়ি আনিয়া সকল॥ উত্তম সংস্কার করি বড় বড় থালি ভরি রত্ন মন্দিরে পিণ্ডার উপরে। ভক্ষণের ক্রম করি ধরিয়াছে সারি সারি আগে আসন বসিবার তরে॥ নারিকেল নানা জাতি এক আম্র নানা ভাতি কলাকোলি বিবিধ প্রকার। পনস খর্জ্জুর কমলা নারঙ্গ জাম সম তারা দ্রাক্ষা বাদাম মেওয়া যত আর॥ খরমুজা ক্ষীরিলি তাল কেশর পানিফল মৃণাল বিল্ল পীলু দাড়িম্বাদি যত। কোন দেশে কার খ্যাতি বৃন্দাবনে সবার স্থিতি সহস্র জাতি, লেখা যায় কত॥ গঙ্গাজল অমৃত কেলি পীযূষ গ্রন্থি কর্পূর কেলি সর পুপী অমৃত পদ্মচিনি। খণ্ড খিরিসা বৃক্ষ ঘরে করি নানা ভক্ষ্য রাধা যাহা কৃষ্ম লাগি আনি॥ ভক্ষ্যের পরিপাটি দেখি কৃষ্ণ হৈল মহাসুখী বসি কৈল বন্য ভোজন। সঙ্গে লঞা সখীগণ রাধা কৈল ভোজন দোঁহে কৈল মন্দিরে শয়ন॥ কেহ করে বীজন কেহ পাদ সম্বাহন কেহ করায় তাম্বূল ভক্ষণ। রাধাকৃষ্ণ নিদ্রা গেলা লখীগণ শয়ন কৈলা দেখি আমার সুখী হৈল মন॥ হেনকালে মোরে ধরি মহাকোলাহল করি তুমি সব ইঁহা লঞা আইলা। কাঁহা যমুনা বৃন্দাবন কাঁহা কৃষ্ণ গোপীগণ সে সুখ ভঙ্গ করাইলা॥ কহিতে কহিতে প্রভুর কেবল বাহ্য হৈল। স্বরূপ গোঁসাঞিকে দেখি তাঁহাকে পুছিল॥ ইঁহা কেন তোমরা আমারে লৈঞা আইলা। স্বরূপ গোঁসাঞি তবে কহিতে লাগিলা॥ যমুনার ভ্রমে তুমি সমুদ্রে পড়িলা। সমুদ্র তরঙ্গে ভাসি এতদূর আইলা॥ এই জালিয়া জালে করি তোমায় উঠাইলা। তোমার পাশে এই প্রেম মত্ত হৈলা॥ সব রাত্রি সবে বেড়াই তোমারে অন্বেষিয়া। জালিয়ার মুখে শুনি পাইল আসিয়া॥ তুমি মূর্চ্ছাছলে বৃন্দাবনে দেখ ক্রীড়া। তোমার মূর্চ্ছা দেখি সবে মনে পাই পীড়া॥ কৃষ্ণনাম লৈতে তোমার অর্দ্ধ বাহ্য হৈল। তাতে যে প্রলাপ কৈলে তাহা যে শুনিল॥ প্রভু কহে স্বপ্নে দেখি গেলাম বৃন্দাবনে। দেখি কৃষ্ণ রাস করেন গোপীগণ সনে॥ জলক্রীড়া করি কৈল বন্য ভোজনে। দেখি আমি প্রলাপ কৈল হেন লয় মনে॥ তবে স্বরূপ গোঁসাঞি তাঁরে স্নান করাইয়া। প্রভু লঞা ঘরে আইলা আনন্দিত হঞা॥ এইত কহিল প্রভুর সমুদ্রে পতন। ইহা যেই শুনে পায় চৈতন্য তরণ॥ শ্রীরূপ রঘুনাথ পদে যার আশ। চৈতন্যচরিতামৃত কহে কৃষ্ণদাস॥ . ************************* . কবি কৃষ্ণদাস-এর সূচীতে . . . . কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজের-এর সূচীতে . . . মিলনসাগর |
সনাতন! কৃষ্ণমাধুর্য্য অমৃতের সিন্ধু ভণিতা কৃষ্ণদাস কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ২১শ পরিচ্ছেদ, পৃ-৫৩২। যথা রাগঃ। সনাতন! কৃষ্ণমাধুর্য্য অমৃতের সিন্ধু। মোর মন সান্নিপাতি সব পিতে করে মতি দুর্দ্দৈব বৈদ্য না দেয় এক বিন্দু॥ ধ্রু॥ কৃষ্ণাঙ্গ লাবণ্য পূর মধুর হৈতে সুমধুর তাতে যেই সুখ সুধাকর। মধুর হৈতে সুমধুর তাহা হৈতে সুমধুর তার যেই স্মিত জ্যোত্স্না ভর॥ মধুর হৈতে সুমধুর তাহা হৈতে সুমধুর তাহা হৈতে অতি সুমধুর। আপনার এক কণে ব্যাপে সব ত্রিভুবনে দশ দিক ব্যাপে য়ার পুর॥ স্মিত কিরণ সুকর্পূরে পৈশে অধর মধুরে সেই মধু মাতায় ত্রিভুবনে। বংশী ছিদ্র আকাশে তার গুণ শব্দে পৈশে ধ্বনি রূপে পাঞা পরিণামে॥ সে ধ্বনি চৌদিকে ধায় অণ্ড ভেদ্ বৈকুণ্ঠে যায় জগতের বলে পৈশে কাণে। সবা মাতোয়াল করি বলাত্কারে আনে ধরি বিশেষতঃ যুবতীরগণে॥ ধ্বনি বড় উদ্ধত পতিব্রতা ভাঙ্গে ব্রত পতি কোল হৈতে টানি আনে। বৈকুণ্ঠের সখীগণে যেই করে আকর্ষণে তার আগে কেবা গোপীগণে॥ নীবী খসায় পতি আগে গৃহ ধর্ম্ম কয়ায় ত্যাগে বলে ধরি আনে কৃষ্ণ স্থানে। লোক ধর্ম্ম লজ্জা ভয় সব জ্ঞান লুপ্ত হয় ঐছে নাচায় সব নারীগণে॥ কাননের ভিতর বাসা করে আপনি তাহা স,দা স্ফূরে অন্য শব্দ না দেয় প্রবেশিতে। আন কথা না শুনে কাণ আন বলিতে বলে আন এই কৃষ্ণের বংশীর চরিতে॥ পুনঃ কহে বাহ্য জ্ঞানে আন কহিতে কহিল আনে কৃষ্ণ কৃপা তোমার উপরে। মোর চিত্ত ভ্রম করি নিজৈশ্বর্য্য মাধুরী মোর মুখে শোনায় তোমারে॥ আমি ত বাউল আন কহিতে আন কহি। কৃষ্ণের মাধুর্য্য স্রোতে আমি যাই বহি॥ তবে প্রভু ক্ষণ এক মৌন করি রহে। মনে ধৈর্য্য করি পুনঃ সনাতনে কহে॥ কৃষ্ণের মাধুরী আর মহাপ্রভুর মুখে। ইহা যেই শুনে সেই ভাসে প্রেমসুখে॥ শ্রীরূপ রঘুনাথ পদে যার আশ। চৈতন্যচরিতামৃত কহে কৃষ্ণদাস॥ . ************************* . কবি কৃষ্ণদাস-এর সূচীতে . . . . কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজের-এর সূচীতে . . . মিলনসাগর |
উপজিল প্রমাঙ্কুর ভাঙ্গিল যে দুঃখ পূর ভণিতা নেই কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃতের গীত। মধ্যলীলা, ২য় পরিচ্ছেদ, পৃ-৩২। অস্যার্থঃ যথা রাগ। উপজিল প্রমাঙ্কুর ভাঙ্গিল যে দুঃখ পূর কৃষ্ণ তাহা নাহি করে পান। বাহিরে নাগর রাজ ভিতরে শঠের কায পর নারী বধে সাবধান॥ ১॥ সখিহে না বুঝিয়া বিধির বিধান। সুখ লাগি কৈল প্রীত হৈল দুঃখ বিপরীত এবে যায় না রহে পরাণ॥ ধ্রু॥ কুটিল প্রেমা আগেয়ান নাহি জানে স্থানাস্থান ভাল মন্দ নারে বিচারিতে। ক্রূর শঠের গুণ ডোরে হাতে গলে বান্ধি মোরে রাখিয়াছে নারি উকাশিতে॥ ২॥ যে মদন তনু হীন পরদ্রোহে পরবীণ পাঁচ বাণ সন্ধে অনুক্ষণ। অবলার শরীরে বিন্ধি করে জরজরে দুঃখ দেয়, না লয় জীবন॥ ৩॥ অন্যের যে দুঃখ মনে অন্য তাহা নাহি জানে সত্য এই শাস্ত্রের বিচার। অন্যজন কাঁহা লিখি না জানয়ে প্রাণ সখি যাতে কহে ধৈর্য্য করিবার॥ ৪॥ কৃষ্ণ কৃপা পারাবার কভু করিবেন অঙ্গীকার সখি তার এ ব্যর্থ বচন। জীবের জীবন চঞ্চল যেন পদ্মপত্রের জল তত দিন জীবে কোন্ জন॥ ৫॥ শতবত্সর পর্য্যন্ত জীবের জীবন অন্ত এই বাক্য কহ না বিচারি। নারীর যৌবন ধন যারে কৃষ্ণ করে মন সে যৌবন দিন দুই চারি॥ ৬॥ অগ্নি যৈছে নিজধাম দেখাইয়া অভিরাম পতঙ্গীরে আকর্ষিয়া মারে। কৃষ্ণ ঐছে নিজ গুণ দেখাইয়া হরে মন পাছে দুঃখ সমুদ্রেতে ডারে॥ ৭॥ এতেক বিলাপ করি বিষাদে শ্রীগৌরহরি উঘাড়িয়া দুঃখের কপাট। ভাবের তরঙ্গ বলে নানারূপে মন চলে আর এক শ্লোক কৈল পাঠ॥ এই পদটি ১৯৬১ সালে প্রকাশিত, বিমান বিহারী মজুমদার সম্পাদিত “পাঁচশত বত্সরের পদাবলী”, পদসংখ্যা ২৩৪, ১৮৮-পৃষ্ঠায় এভাবে রয়েছে,। উপজিল প্রমাঙ্কুর ভাঙ্গিল যে দুঃখ পূর কৃষ্ণ তাহা নাহি করে পান। বাহিরে নাগর রাজ ভিতরে শঠের কায পর নারী বধে সাবধান॥ সখিহে না বুঝিয়া বিধির বিধান। সুখ লাগি কৈল প্রীত হৈল দুঃখ বিপরীত এবে যায় না রহে পরাণ॥ কুটিল প্রেম আগেয়ান নাহি জানে স্থানাস্থান ভাল মন্দ নারে বিচারিতে। ক্রূর শঠের গুণ ডোরে হাতে গলে বান্ধি মোরে রাখিয়াছে নারি উকাসিতে॥ অগ্নি যৈছে নিজধাম দেখাইয়া অভিরাম পতঙ্গীরে আকর্ষিয়া মারে। কৃষ্ণ ঐছে নিজ গুণ দেখাইয়া হরে মন পাছে দুঃখ সমুদ্রেতে ডারে॥ এতেক বিলাপ করি বিষাদে শ্রীগৌরহরি উঘাড়িঞা দুঃখের কবাট। ভাবের তরঙ্গ বলে নানারূপে মন ছলে আর এক শ্লোক কৈল পাঠ॥ . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
বংশীগানামৃত ধাম লাবণ্যামৃত জন্মস্থান ভণিতা নেই কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃতের গীত। মধ্যলীলা, ২য় পরিচ্ছেদ, পৃ-৩৪। তথাহি গোস্বামী পাদোক্তশ্লোকঃ শ্রীকৃষ্ণরূপাদি নিষেবণং বিনা ব্যর্থানি মেহ হান্যখিলেন্দ্রিয়াণ্যলং। পাষাণ শুষ্কেন্ধন ভারকান্যহো বিভর্ম্মি বা তানি কথং হতত্রপঃ॥ অর্থাৎ --- শ্রীকৃষ্ণের রূপাদি সেবন বিনা আমার এ জীবন ও সর্ব্বোন্দ্রিয় বৃথা ; নির্লজ্জভাবে পাষাণতুল্য নীরস সেইরূপ জীবনই বা কেমন করিয়া বহন করিব ? ---জগদীশ্বর গুপ্ত, সরল টীকা ও ব্যাখ্যা, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত॥ কৃষ্ণদাস কবিরাজের এই গীতটি রচিত হয় রঘুনাথ দাস গোস্বামীর উপরোক্ত শ্লোকের প্রেরণায় . . . যথা রাগ। বংশীগানামৃত ধাম লাবণ্যামৃত জন্মস্থান যে না দেখে সে চাঁদ বদন। সে নয়নে কিবা কায পড়ুক তার মুণ্ডে বাজ সে নয়ন রহে কি কারণ॥ ১॥ সখি হে শুন মোর হত বিধি বল। মোর বপু চিত্ত মন সকল ইন্দ্রিয়গণ কৃষ্ণ বিনা সকল বিফল॥ ধ্রু॥ কৃষ্ণের মধুর বাণী অমৃতের তরঙ্গিণী তার প্রবেশ নাহি যে শ্রবণে। কাণাকড়ি ছিদ্র সম জানিহ সে শ্রবণ তার জন্ম হৈল অকারণে॥ ২॥ কৃষ্ণের অধরামৃত কৃষ্ণগুণ তরিত সুধাসার স্বাদু বিনিন্দন। তার স্বাদু যে না জানে জন্মিয়া না মৈল কেনে সে রসনা ভেক জিহ্বা সম॥ ৩॥ মৃগমদ নীলোত্পল মিলনে যে পরিমল যেই হরে তার গর্ব্বমান। হেন কৃষ্ণ অঙ্গ গন্ধ যার নাহি সে সম্বন্ধ সেই নাসা ভস্ত্রার সমান॥ ৪॥ কৃষ্ণ কর পদতল কোটীচন্দ্র সুশীতল তার স্পর্শ যেন স্পর্শমণি। তার স্পর্শ নাহি যার সে যাউক ছারখার সেই বপু লৌহসম জানি॥ করি এত বিলাপন প্রভু শচীনন্দন উঘাড়িয়া হৃদয়ের শোক। দৈন্য নির্ব্বেদ বিষাদে হৃদয়ের অবসাদে পুনরপি পড়ে এক শ্লোক॥ এই পদটি, ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত, দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত বৈষ্ণব পদাবলী সংকলন “বৈষ্ণব পদসঙ্কলন”, ৩৪-পৃষ্ঠায় এই রূপে দেওয়া রয়েছে। যথা রাগ। বংশীগানামৃতধাম লাবণ্যামৃত-জন্মস্থান যে না দেখে সে চাঁদ-বদন। সে নয়নে কিবা কাজ পড়ু তার মুণ্ডে বাজ সে নয়ন রহে কি-কারণ॥ সখি হে শুন মোর হত বিধিবল। মোর বপু চিত্ত মন সকল ইন্দ্রিয়গণ কৃষ্ণ-বিনু সকল বিফল॥ কৃষ্ণের-মধুর-বাণী অমৃতের তরঙ্গিণী তার প্রবেশ নাহি যে শ্রবণে। কাণাকড়ি-ছিদ্র-সম জানিহ সেই শ্রবণ তার জন্ম হৈল অকারণে॥ মৃগমদ নীলোত্পল মিলনে যে পরিমল যেই হরে তার গর্ব মান। হেন কৃষ্ণ-অঙ্গ-গন্ধ যার নাহি সে সম্বন্ধ সেই নাসা ভস্ত্রার সমান॥ কৃষ্ণের অধরামৃত কৃষ্ণগুণ-চরিত সুধাসার-স্বাদ-বিনিন্দন। তার স্বাদ যে না জানে জন্মিয়া না মৈল কেনে সে-রসনা ভেকজিহ্বা সম॥ কৃষ্ণ কর পদতল কোটী-চন্দ্র-সুশীতল তার স্পর্শ যেন স্পর্শমণি। তার স্পর্শ নাহি যার সে যাউক ছারখার সেই বপু লৌহসম জানি॥ করি এত বিলাপন প্রভু শচীনন্দন উঘাড়িয়া হৃদয়ের শোক। দৈন্য-নির্ব্বেদ-বিষাদে হৃদয়ের অবসাদে পুনরপি পড়ে এক শ্লোক॥ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত মহাপ্রভুর বিলাপটি রঘুনাথ দাস গোস্বামীর নিম্নলিখিত শ্লোকের প্রেরণায় রচিত . . . শ্রীকৃষ্ণরূপাদি-নিষেবণং বিনা ব্যর্থানি মেহ হান্যখিলেন্দ্রিয়াণ্যলং। পাষাণ-শুষ্কেন্ধন-ভাবকান্যহো বিভর্ম্মি বা তানি কথং হতত্রপঃ॥ . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
যে কালে বা স্বপনে দেখিলুঁ বংশীবদনে ভণিতা নেই কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃতের গীত। মধ্যলীলা, ২য় পরিচ্ছেদ, পৃ-৩৬। অস্যার্থঃ যথা রাগ। যে কালে বা স্বপনে দেখিলুঁ বংশীবদনে সেই কালে আইলা দুই বৈরী। আনন্দ আর মদন হরি নিল মোর মন দেখিতে না পাইল নেত্র ভরি॥ ১॥ পুনঃ যদি কোন ক্ষণ করায় কৃষ্ণ দরশন তবে সেই ঘটী, ক্ষণ, পল। দিয়া মাল্য চন্দন নানা রত্ন আভরণ অলঙ্কৃত করিমু সকল॥ ২॥ ক্ষণে বাহ্য হৈল মন আগে দেখে দুই জন তারে পুছে আমি না চৈতন্য। স্বপ্ন প্রায় কি দেখিনু কিবা আমি প্রলাপিনু তোমরা কিছু শুনিয়াছ দৈন্য॥ ৩॥ শুন মোর প্রাণের বান্ধব। নাহি কৃষ্ণ প্রেমধন দরিদ্র মোর জীবন দেহেন্দ্রিয় বৃথা মোর সব॥ ধ্রু॥ পুনঃ কহে হায় হায়! শুন স্বরূপ রাম রায় এই মোর হৃদয় নিশ্চয়ঃ। শুনি কর বিচার হয় নয় কহ সার এত বলি শ্লোক উচ্চারয়॥ . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
অকৈতব কৃষ্ণপ্রেম যেন জাম্বুনদ হেম ভণিতা নেই কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃতের গীত। মধ্যলীলা, ২য় পরিচ্ছেদ, পৃ-৩৮। যথা রাগ। অকৈতব কৃষ্ণপ্রেম যেন জাম্বুনদ হেম সেই প্রেমা ভুলোকে না হয়। যদি হয় তার যোগ না হয় তবে বিয়োগ বিরহ হৈলে কেহ না জীয়য়॥ এত কহি শচীসূত স্লোক পড়ে অদ্ভূত শুনে দোঁহে এক মন হঞা। আপন হৃদয় কায কহিতে বাসিয়ে লাজ তবু কহি লাজ বীজ খাঞা॥ . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
দূরে শুদ্ধ প্রেমবন্ধ কপট প্রেমের গন্ধ ভণিতা নেই কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃতের গীত। মধ্যলীলা, ২য় পরিচ্ছেদ, পৃ-৩৮। যথা রাগ। দূরে শুদ্ধ প্রেমবন্ধ কপট প্রেমের গন্ধ সেহ মোর কৃষ্ণ নাহি পায়। তবে যে করি ক্রন্দন স্ব সৌভাগ্য প্রক্ষালন করি ইহা জানিহ নিশ্চয়॥ যাতে বংশীধ্বনি সুখ না দেখি সে চাঁদমুখ যদ্যপি সে নাহি আলম্বন। নিজ দেহে করি প্রীতি কেবল কামের রীতি প্রাণকীটের করিয়ে ধারণ॥ কৃষ্ণ প্রেম সুনির্ম্মল যেন শুদ্ধ গঙ্গাজল সেই প্রেম অমৃতের সিন্ধু। নির্ম্মল সে অনুরাগে না লুকায় অন্যদাগে শুক্লবস্ত্রে যৈছে মসী বিন্দু॥ শুদ্ধ প্রেম সুখসিন্ধু পাই তার এক বিন্দু সেই বিন্দু জগৎ ডুবায়। কহিবার যোগ্য নয় তথাপি বাউলে কয় রহিলে বা কেবা পাতি যায়॥ এই মত দিনে দিনে স্বরুপ রামানন্দ সনে নিজ ভাব করেন বিদিত। বাহিরে বিষ জ্বালা হয় ভিতরে আনন্দময় কৃষ্ণ প্রেমার অদ্ভুত চরিত॥ এই প্রেমার আস্বাদন তপ্ত ইক্ষু চর্ব্বণ মুখ জ্বলে না যায় ত্যজন। সেই প্রেমা যার মনে তার বিক্রম সেই যানে বিষামৃতে একত্র মিলন॥ . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
তোমার মাধুরী বল তাহাতে মোর চাপল ভণিতা নেই কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃতের গীত। মধ্যলীলা, ২য় পরিচ্ছেদ, পৃ-৪৩। যথা রাগ। তোমার মাধুরী বল তাহাতে মোর চাপল এই দুই তুমি আমি জানি। কাহাঁ করোঁ কাহাঁ যাঙ কাহাঁ গেলে তোমা পাঁঙ তাহা মোরে কহ ত আপনি॥ নানা ভাবের প্রাবল্য বিষাদ দৈন্য চাপল্য ভাবে ভাবে হৈল মহারণ। ঔত্সুক্য, চাপল্য, দৈন্য, রোন হর্ষ আদি সৈন্য প্রেমোন্মাদ সবার কারণ॥ মত্তগজ ভাবগণ প্রভুর দেহ ইক্ষুবন গজ যুদ্ধে বনের দলন। প্রভুর হৈল দিব্যোন্মাদ তনু মনের অবসাদ ভাবাবেশে করে সম্বোধন॥ . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
উন্মাদের লক্ষ্মণ করায় কৃষ্ণ স্ফুরণ ভণিতা নেই কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃতের গীত। মধ্যলীলা, ২য় পরিচ্ছেদ, পৃ-৪৫। যথা রাগ। উন্মাদের লক্ষ্মণ করায় কৃষ্ণ স্ফুরণ ভাবাবেশে উঠে প্রণয় মান। সোল্লুণ্ঠ বচন রীতি মান, গর্ব্ব, ব্যাজ স্তুতি কভু নিন্দা কভু বা সম্মান॥ তুমি দেব ক্রীড়ারত ভুবনের নারী যত তাহে কর অভীষ্ট ক্রীড়ন। তুমি মোর দয়িত মোতে বৈসে তোমার চিত্ত মোর ভাগ্যে কর আগমন॥ ভুবনের নারীগণ সবার কর আকর্ষণ তাহা কর সব সমাধান॥ তুমি কৃষ্ণ চিত্তহর ঐছে কোন্ পামর তোমারে বা কেবা করে মান॥ তোমার চপল মতি একত্রে না হয় স্থিতি তাতে তোমার নাহি কিছু দোষ। তুমি তো করুণাসিন্ধু আমার প্রাণের বন্ধু তোমায় নাহি মোর কভু রোষ॥ তুমি নাথ ব্রজপ্রাণ ব্রজের কর পরিত্রাণ বহু কার্য্যে নাহি অবকাশ। তুমি আমার রমণ সুখ দিতে আগমন এ তোমার বৈদগ্ধ বিলাস॥ মোর বাক্য নিন্দা মানি কৃষ্ম ছাড়ি গেলা জানি শুন মোর এ স্তুতি বচন। নয়নের অভিরাম তুমি মোর ধন প্রাণ হাহা পুনঃ দেহ দরশন॥ স্তম্ভ, কম্প, প্রস্বেদ, বৈবর্ণ, অশ্রু, স্বরভেদ, দেহ কৈল পুলকে ব্যাপিত। হাঁসে, কান্দে, নাচে, গায়, উঠি ইতি উতি ধায় ক্ষণে ভুমে পড়িয়া মূর্চ্ছিত॥ মূর্চ্ছায় হৈল সাক্ষাত্কার উঠি কবহে হুহুঙ্কার কহে এই আইলা মহাশয়! কৃষ্ণের মাধুরী গুণে নানা ভ্রম হয় মনে শ্লোক পড়ি করয়ে নিশ্চয়॥ . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
অন্যের হৃদয় মন আমার মন বৃন্দাবন ভণিতা নেই কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃতের গীত। মধ্যলীলা, ১৩শ পরিচ্ছেদ, পৃ-২৯৫। অস্বার্থঃ যথা রাগঃ। অন্যের হৃদয় মন আমার মন বৃন্দাবন মনে বনে এক করি জানি। তাঁহা তোমার পদদ্বয় করাও যদি উদয় তবে তোমার পূর্ণ কৃপা মানি॥ প্রাণনাথ শুন মোর সত্য নিবেদন। ব্রজ আমার সদন তাহে তোমার সঙ্গম না পাইলে না রব জীবন॥ ধ্রু॥ পূর্ব্বে উদ্ধব দ্বারে এবে সাক্ষাৎ আমারে যোগ জ্ঞানের কহিলে উপায়। তুমি বিদগ্ধ কৃপাময় জান আমার হৃদয় মোরে ঐছে কহিতে না যুয়ায়॥ চিত্ত কাড়ি তোমা হৈতে বিষয়ে চাহি লাগাইতে যত্ন করি নারি কাড়িবারে। তারে ধ্যান শিক্ষা কর লোক হাঁসাইয়া মার স্থানাস্থান না কর বিচারে॥ নহে গোপী যোগেশ্বর তোমার পদকমল ধ্যান করি পাইবে সন্তোষ। তোমার বাক্য পরিপাটী তার মধ্যে কুটিনাটী শুনি গোপীর আর বাড়ে রোষ॥ দেহ স্মৃতি নাহি যার সংসার কূপ কাঁহা তার তাহা হৈতে না চাহে উদ্ধার। বিরহ সমুদ্র জলে কাম তিমিঙ্গিল গিলে গোপীগণে লহ তার পার॥ বৃন্দাবন গোবর্দ্ধন যমুনা পুলিন বন সেই কুঞ্জে রাসাদিক লীলা। সে ব্রজের ব্রজজন মাতা পিতা বন্ধুগণ বড় চিত্র, কেমনে পাসরিলা॥ বিদগ্ধ মৃদু সদ্গুণ সুশীল স্নিগ্ধ করুণ তুমি, তোমায় নাহি দোষাভাস। তবে যে তোমার মন নাহি স্মরে ব্রজ জন সে আমার দুর্দ্দৈব বিলাস॥ না গণি আপন দুঃখ দেখি ব্রজেশ্বরী মুখ ব্রজ জনের হৃদয় বিদরে। কিবা মার ব্রজবাসী কিবা জিয়াও ব্রজে আসি কেন জীয়াও দুঃখ সহিবারে॥ তোমার যে অন্য বেশ অন্য সঙ্গ অন্য দেশ ব্রজজনে কভু নাহি ভায়। ব্রজভূমি ছাড়িতে নারে তোমা না দেখিলে মরে ব্রজজনের কি হবে উপায়॥ তুমি ব্রজের জীবন ব্রজরাজের প্রাণধন তুমি ব্রজের সকল সম্পদ। কৃপার্দ্র তোমার মন আসি জিয়াও ব্রজজন ব্রজে উদয় করাও নিজপদ। . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |