কবি দীনেশচন্দ্র সেনের রচনা সম্ভার - পাতার উপরে . . .
তাঁর রচনাসম্ভার বিশাল। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” (১৮৯০) গ্রন্থের জন্য বাংলা সাহিত্যে
অমরত্ব লাভ করেছেন। তাঁর প্রথম রচনা মাত্র ১৯ বছর বয়সের কাব্য “কুমার ভূপেন্দ্রসিংহ” (১৮৯০)।
তাঁর অন্যান্য গবেষণামূলক রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে ২ খণ্ডে “বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়” (১৯১৪), “সরল বাঙ্গালা
সাহিত্য” (১৯২২), ২ খণ্ডে “বৃহৎবঙ্গ” (১৯৩৫), “প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান” (১৯৩৮),
মুসলমান নারী চিত্র (১৯৩৯) প্রভৃতি। রয়েছে বৈজ্ঞানিক এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন তালিকা ও চার্ট সহ
গৃহিণীদের জন্য ঘরকন্যার অমূল্য উপদেশমূলক গ্রন্থ “গৃহশ্রী” (১৯১৬)।
তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “ময়মনসিংহ গীতিকা” (১৯২৩), “পূর্ববঙ্গ গীতিকা” (১৯২৩-৩২),
“কৃষ্ণকমল গ্রন্থাবলী” (১৯২৮) প্রভৃতি।
তাঁর সহসম্পাদিত পত্রিকা ও গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কবি বিজয়চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে বঙ্গবাণী পত্রিকা (১৯২১-
২২), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য্য ও বসন্তরঞ্জন রায়ের সঙ্গে গৌপীচন্দ্রের গান (১৯২০),
বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ এর সঙ্গে “লালা জয়নারায়ণ সেন প্রণীত হরিলীলা” (১৯২৭), বিনোদবিহারী
কাব্যতীর্থের সঙ্গে “শ্রীকর নন্দী বিরচিত ছুটিখানের মহাভারত” (১৯০৫), হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সঙ্গে “মানিক
গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রীধর্মমঙ্গল” প্রভৃতি।
পৌরাণিক কথা ও কাহিনীর মধ্যে রয়েছে "রামায়ণী কথা" (১৯০৩), "বেহুলা" (১৯০৭), "সতী" (১৯০৭), "ফুল্লরা"
(১৯০৭), "জড়ভরত" (১৯০৮), "ধরাদ্রোণ ও কুশধ্বজ" (১৯১৩) যা ১৯৩৪ সালে “পৌরাণিকী” নামে একত্র
প্রকাশিত হয়।
তাঁর রচিত গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “দীনেশ সেনের ছোট গল্প” (১৯২৫), “নীলমাণিক” (১৯১৮), “সুকথা” (১৯১২),
“লতিকা” (১৯২২), “ভয়ভাঙ্গা” (১৯২৫), “দেশমঙ্গল” (১৯২৪) প্রভৃতি।
পদাবলী সাহিত্য নিয়ে তাঁর রচনা “পদাবলী-মাধুর্য্য” (১৯২৪)। ১৯২০ সালে তিনি পাঁচটি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক
কাহিনী রচনা করেছিলেন “সাঁঝের ভোগ”, “মুক্তাচুরি” (১৯১৯), “রাখালের রাজগি” (১৯২০), “রাগরঙ্গ” ও “গায়ে
হলুদ”। এছাড়া রয়েছে গদ্য “সুবল সখার কাণ্ড” (১৯২২)।
তাঁর রচিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে "তিনবন্ধু" (১৯০৪), "আলোকে আঁধারে" (১৯২৫), "চাকুরীর বিড়ম্বনা"
(১৯২৬), "মামুদের শিবমন্দির" (১৯২৮) প্রভৃতি।
তাঁর ইংরেজী রচনাসম্ভারে রয়েছে “History of Bengali Language and Literature” (১৯১১), “The Vaishnava
Literature of Medieval Bengal” (১৯১৫), “Chaitanya and his Companions” (১৯১৭), “Chaitanya and His Age”,
“The Bengali Ramayana” (১৯২০), “The Folk Literature of Bengal” (১৯২০), “Bengali Prose Style” (১৯২১),
Eastern Bengal Ballads (১৯৩২), “Glimpses of Bengal Life” (১৯২৫) প্রভৃতি।
অন্যান্য প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “ওপারের আলো” (১৯২৭) , "রেখা" (১৮৯৪), “শ্যামল ও কজ্জল”
(১৮৯৯), "বৈদিক ভারত", “The Royal Visit to India 1911-1912” এর অনুবাদ “সম্রাট ও সম্রাট মহিষীর ভারত
পরিদর্শন”, “আশুতোষ-স্মৃতিকথা” (১৯৩৬) প্রভৃতি। আত্মজীবনী “ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য” (১৯২২)। শেষ
রচনা “বাংলার পুরনারী” (১৯৩৯) যা তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়।
কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়াবাহাদুর -
জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলার
সুয়াপুর গ্রামে। পিতা ঈশ্বরচন্দ্র সেন। মাতা
রূপলতা দেবী। দীনেশচন্দ্ররা ১০ বোন ও এক
ভাই, যাঁদের মধ্যে ৬ বোন শৈশবেই মারা যান।
পিতা ঈশ্বরচন্দ্র সেন, মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর
বিয়ের পরে, শ্বশুরালয়ে বসবাস করা শুরু করেন।
কবি দীনেশচন্দ্র সেনের শিক্ষা-দীক্ষা - পাতার উপরে . . .
সুয়াপুরের গ্রামের পাঠশালায় পড়া শুরু করে মানিকগঞ্জ মাইনর স্কুলে (প্রাইমারি) ভর্তি হয়ে ১৮৭৯ সালে
পাশ করেন। এরপরে তাঁকে কুমিল্লায় পাঠানো হয়। কুমিল্লার গভর্নমেন্ট স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। তখন
সেই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন প্রায় দেড় হাজার, কেবল গৌরাঙ্গ বিষয়ক বৈষ্ণব-পদাবলীর সংকলন
“শ্রীগৌরপদ-তরঙ্গিণী”-র রচয়িতা এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তর “মেঘনাদ বধ” কাব্যের প্যারডী “ছুছুন্দরী বধ”
কাব্য-খ্যাত কবি জগদ্বন্ধু ভদ্র। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর আত্মজীবনী “ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্যে” জগবন্ধু
ভদ্রকে নিয়ে খুব সুন্দর ভাবে লিখেছেন। মিলনসাগরে তা পড়তে এবং ছুছুন্দরী বধ কাব্য সহ কবি জগবন্ধু
ভদ্রর অন্যান্য কবিতা ও পদাবলীর পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন . . .।
এর পরে দীনেশচন্দ্র ঢাকায় এসে প্রথমে কলেজিয়েট স্কুলে ও আর্থিক কারণে পরে জগন্নাথ স্কুলে ভর্তি হন
এবং তাঁদের এক আত্মীয়ের বাড়ীতে থেকে পড়াশুনা করেন। ১৮৮২ সালে তিনি জগন্নাথ স্কুল থেকেই এফ.এ.
পাশ করেন। ১৮৮৯ সালে তিনি ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাশ করেন।
সেই সময়েই তিনি ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। পরে তাঁর বন্ধুবর্গের মধ্যে ছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, কবি
হরিশচন্দ্র মিত্র, নিজের বিধবা কন্যার বিবাহ সম্পন্নে খ্যাত ব্রজসুন্দর মিত্র প্রমুখরা। পিতার রচনাবলীর মধ্যে
রয়েছে প্রাক-বঙ্কিম যুগের, ১৮৬৪ সাল নাগাদ রচিত নাটক “সত্যধর্ম্মোদ্দীপক”, গানের সংকলন
“ব্রহ্মসঙ্গীতরত্নাবলী” প্রভৃতি। এছাড়া তিনি দিনাজপুরের একটি মৌলিক ইতিহাস লিখেছিলেন যা ছাপানো
হয়নি। তিনি ধামরাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেই সূত্রে তাঁর ছাত্র ছিলেন কবি কামিনী রায়ের স্বামী
কেদারনাথ রায়।
পিতা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেও মাতা হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেননি। বাড়ীতে হিন্দুধর্মের সকল পালা-পার্বণ এমন কি
দুর্গোত্সবও পালন করতেন।
মাত্র ১২ বছর বয়সে কবি দীনেশচন্দ্র সেনের বিবাহ সম্পন্ন করা হয়। প্রথমা কন্যা মাখনবালা।
কবি দীনেশচন্দ্র সেনের কর্মজীবন - পাতার উপরে . . .
১৮৮২ সালে তিনি জগন্নাথ স্কুল থেকেই এফ.এ. পাশ করে হবিগঞ্জ স্কুলে ৩য় শিক্ষকের পদে যোগ দেন।
১৮৮৯ সালে তিনি ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাশ করেন। এরপরে তিনি কুমিল্লার শম্ভুনাথ স্কুলে
পড়াতে শুরু করেন। কিছুদিন সেখানে পড়ামোর পর তিনি ১৮৯১ সালে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া স্কুলের
হেডমাস্টারের পদে যোগ দেন।
এই সময়ে তিনি পায়ে হেঁটে হেঁটে, বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে, প্রাচীন অপ্রকাশিত পুথি সংগ্রহ করেন। ১৮৯৬
সালে প্রকাশিত হয়, ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের অর্থানুকূল্যে দীনেশচন্দ্র সেনের গবেষণা-প্রসূত
অমর কীর্তি “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” গ্রন্থ।
এরপরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডারের পদে কাজ করেন ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত এবং ১৯৩২ সালে
তিনি রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশিপ পদ অলঙ্কৃত করেন।
তাঁর সাহায্যেই স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সহ ভারতীয় ভাষা এম.এ.
পঠমপাঠন শুরু করেন। রিডারশিপ বক্তৃতামালার তিনিই প্রথম ভারতীয় বক্তৃতাদাতা।
কবি দীনেশচন্দ্র সেনের প্রাপ্ত সম্মাননা - পাতার উপরে . . .
সাহিত্য এবং গবেষণায় অবদানের জন্য দীনেশচন্দ্র সেন কে ১৯২১ সালে ভারত সরকার (ব্রিটিশ সরকার)
“রায়বাহাদুর” উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯২১ সালেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট. উপাধিতে
এবং ১৯৩১ সালে বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন। ১৯২৯ সালে
তিনি হাওড়ায় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের মূল-সভাপতি এবং ১৯৩৬ সালে রাঁচিতে অনুষ্ঠিত প্রবাসী
বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের মূল ও সাহিত্য শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। নবদ্বীপের বিদগ্ধজননীসভার মহা-
মহোপাধ্যায়গণ তাঁকে “কবিশেখর” উপাধি দিয়েছিলেন এবং ভারতীয় ধর্মমহামণ্ডল তাঁকে “প্রত্নতত্ত্বভূষণ”
উপাধিতে ভূষিত করেন।
কবি দীনেশচন্দ্র সেনের কবিতা - পাতার উপরে . . .
দীনেশচন্দ্র সেনে কে মূলত গদ্যের লেখক হিসেবেই আপামর বাঙালী একবাক্যে চেনেন। কোনও কাব্য-
সংকলনে আজ পর্যন্ত আমরা তাঁর নিজের নামে, কোনও কবিতা সংকলিত দেখি নি।
১৯২২ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী “ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য” গ্রন্থে তিনি জানিয়েছেন যে তাঁর
কৈশোরের শেষ থেকে কর্মজীবনের শুরু পর্যন্ত, তিনি শত শত কবিতা লিখেছিলেন। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া
স্কুলের চাকরি পাওয়ার পরে, ১৮৯০ সালে তিনি তাঁর ১৯ বছর বয়সে লেখা “কুমার ভূপেন্দ্রসিংহ” নামক
আখ্যান কাব্যটি প্রকাশিত করেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ছাপানোর পরে, কাব্যগ্রন্থ বাড়ীতে এনে রাখার রাতেই
আগুন লেগে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ছাড়া তাঁর শত শত কবিতার পাণ্ডলিপি যে সিন্দুকে রেখেছিলেন
কুমিল্লাতে, তাও হারিয়ে যায়। এর পরে আর কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি। তারই ফলস্বরূপ আমরা তাঁকে
বাংলা গদ্যসাহিত্যে এত বিশাল আকারে পেয়েছি।
দীনেশচন্দ্র সের মাত্র ৭ বছর বয়সে পয়ার ছন্দে সরস্বতীর একটি স্তব লিখেছিলেন। ১৮৭৬ সালে কবির
প্রথম প্রকাশিত কবিতা “জলদ”, তাঁর মাত্র ১০ বছর বয়সে, সুয়াপুর গ্রামের নিকটবর্তী নান্নার গ্রামের কৈবর্ত-
জমিদার অম্বিকাবাবুর সম্পাদিত “ভারত-সুহৃদ্” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবি লিখেছেন --- ১৫ বছর বয়সে,
১৮৮৩ সালে “নবজীবন” পত্রিকায় (আসলে পত্রিকার মাঘ ১২৯১ বঙ্গাব্দ সংখ্যায়, জানুয়ারী ১৮৮৫
খৃষ্টাব্দ) তাঁর “পূজার কুসুম” কবিতাটি ছাপা হয়। সৌভাগ্যক্রমে এই পত্রিকাটি আমাদের সংগ্রহে রয়েছে এবং
তাতে এই কবিতাটিও। আমরা মিলনসাগরে কবিতাটি প্রকাশিত করলাম।
এছাড়া মিলনসাগরে আমরা তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে পাওয়া ৩টি কবিতা তুলেছি। তাঁর লেখা ভূমিকা সহ কবি
চাঁদমল নামের এক রাজস্থানী কবির “মাদল” নামের একটি বাংলা কাব্যগ্রন্থ পেয়েছি, যা আমরা, নিচের
অনুচ্ছেদে উল্লিখিত কারণে মনে করছি যে তা আসলে দীনেশচন্দ্র সেনের নিজেরই লেখা কবিতা!
আমরা মনে করছি যে “চাঁদমল” নামটি দীনেশচন্দ্র সেনের ছদ্মনাম ছাড়া আর কিছুই নয়!
"মাদল কাব্যগ্রন্থ" ও কবি দীনেশচন্দ্র সেন - পাতার উপরে . . .
তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে তাঁর জীবনের প্রথম প্রকাশিত রচনা “কুমার ভূপেন্দ্রসিংহ” (১৮৯০), মাদল
(১৯৩১) প্রভৃতি।
আমরা ১৯৩১ সালে প্রকাশিত, “মাদল” নামের একটি কাব্যগ্রন্থ পেয়েছি, যেখানে গ্রন্থ ও লেখকের নামের
পাতায়, অর্থাৎ টাইটেল পেজ-এ, দীনেশচন্দ্র সেনের নাম রয়েছে, যেন তিনিই লেখক বা কবি! কাব্যগ্রন্থটিতে
লেখকের লেখা আত্মপরিচয় “আমার কথা” থাকলেও তাতে তাঁর নাম নেই! গ্রন্থে দীনেশচন্দ্র সেনের লেখা
একটি ভূমিকা রয়েছে। তাতে তিনি জানাচ্ছেন যে কবি রাজস্থানের মানুষ এবং যেভাবে বাংলা ভাষায়
কবিতা লিখেছেন তাতে কবির বাংলা ছন্দ ও শব্দের উপর যথেষ্ট অধিকার প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি সেই
ভূমিকার দু জায়গায় কবির নাম “চাঁদমল” বলে উল্লেখ করেছেন!
রাজস্থানী “চাঁদমল” নামটি সঙ্গে যেন বাঙালী দীনেশচন্দ্র” নামের বেশ মিলও লক্ষ্য করা যাচ্ছে! এমন হতে
পারে যে, পাঠককে বিভ্রান্ত করার জন্য লেখক তাঁর আত্মপরিচয় “আমার কথা”-য় বলেছেন যে কবি সুনির্মল
বসু তাঁর অগ্রজপ্রতিম! গ্রন্থে, কবি নজরুল ইসলাম গদ্যে এবং কবি সুনির্মল বসু পদ্যে, কবিকে লেখা
শুভেচ্ছা বার্তাও রয়েছে। এঁরা দুজনেই দীনেশচন্দ্রের অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং তাঁর অনুরোধে এমন
শুভেচ্ছা বার্তা লিখে দিয়ে ধন্য হতেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
কবির লেখা আত্মপরিচয় “আমার কথা”-য় আরও রয়েছে যে এই গ্রন্থের দু একটি কবিতা পূর্বেই
“রামধনু”, “পাপিয়া” ও “মাসপয়লা” নামের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পাপিয়া ও মাসপয়লা পত্রিকা দুটির
কোন সংসকলনই আমাদের হাতে না এসে থাকলেও, সৌভাগ্যবশত “রামধনু” পত্রিকার বেশ কিছু বছরের
সংকলন আমাদের সংগ্রহে রয়েছে। সেই পত্রিকায় আমরা “চাঁদমল” নামের এক কবির কবিতা প্রকাশিত
হয়েছে, দেখেছি। উপরন্তু সেই কবিতার পাদটীকায় লেখা রয়েছে যে এই কবি বাঙালী নন, ইত্যাদি! এখানে
উল্লেখযোগ্য এই যে সেই পত্রিকায় দীনেশচন্দ্র সেনের প্রবন্ধও আমরা দেখেছি। ১৯২৭ সাল নাগাদ,
সুপ্রতিষ্ঠিত ও সর্বজন বরেণ্য রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনের কোন অনুরোধ উল্লিখিত পত্র-পত্রিকার
সম্পাদকগণ ফেরাতে পারতেন কি না তাতে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
যে যে কারণে আমরা মনে করছি যে “মাদল” কাব্যগ্রন্থটি আসলে দীনেশচন্দ্র সেনেরই লেখা তা হলো . . .
১। “মাদল” কাব্যগ্রন্থের টাইটেল পেজে, কবি বা রচয়িতার স্থানে, যে ভাবে “শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন” নামটি ছাপা
হয়েছে, তাতে আমাদের বিশ্বাস এই যে তিনিই “মাদল” কাব্যগ্রন্থের কবিতার রচয়িতা।
২। কবি চাঁদমল-এর আত্মপরিচয় “আমার কথা” এবং দীনেশচন্দ্র সেনের লেখা ভূমিকার ভাষা একই
রকমের! পড়তে পড়তে মনে হয় যে কবির আত্মপরিচয় “আমার কথা” ও ভূমিকা একই ব্যক্তি লিখেছেন!
৩। ভূমিকার এক যায়গায়ে দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন . . .
“যে কবিতাগুলি পড়িয়াছি, তাহার মধ্যে একটিমাত্র শব্দ বাঙ্গালা অভিধানে নাই এবং উহা বাঙ্গালী পাঠকের
অনধিগম্য। তের পৃষ্ঠার শেষ দিকে “মুর্ঝেছে” শব্দের অর্থ ‘শুকাইয়া পড়িয়াছে’, কিন্তু এটি হিন্দী শব্দ---
বাঙ্গালায় ইহার প্রচলন নাই। কিন্তু বিদেশী শব্দের বিরুদ্ধে আমরা কখনই দ্বার বন্ধ করিয়া রাখি নাই, চলিত
ভাষা সর্ব্বত্রই বিদেশী উপকরণে পুষ্ট হইয়া থাকে---তবে সেইরূপ উপকরণের আমদানী করিতে হইলে
কতকটা নির্ব্বাচনী শক্তি প্রয়োগের দরকার।”
এই লেখাটি থেকে প্রথমত আমরা দীনেশচন্দ্রের মত মানুষের, বাংলা ভাষায়, অন্য ভাষার শব্দ আমদানী
করে ব্যবহারের উপরে একটা মতামত পাই। দ্বিতীয়ত বোঝা যায় যে তিনি এই কাব্যগ্রন্থের ৫০ পাতা জুড়ে
২১টি কবিতার প্রতিটি লাইন অত্যন্ত মনযোগের সঙ্গে পড়েছিলেন! যা থেকে তিনি একটি মাত্র বিদেশী শব্দ
“মুর্ঝেছে” ঠিক খুঁজে বের করেছিলেন। নাকি, এই কবিতাগুলি তাঁরই রচিত ছিল, যার ফলে এই গ্রন্থটি তাঁর
নখদর্পণের ছিল?!
৪। আরেকটি কথা যা আমাদের মনে হয়েছে তা হলো এই যে, দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর, বহুকাল পরে
আবার কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন, এবং সম্ভবত বাংলাভাষার একজন অগ্রণী গবেষক, বিশেষজ্ঞ,
শিক্ষক এবং সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষাব্যবস্থার একজন মান-নির্ধারক হিসেবে (তাঁকে আচার্য্য
বলেও সম্বোধন করা হতো), তাঁর মনে হয়ে থাকতে পারে যে, কবিতাগুলি তাঁর আদর্শ মানকে ছুঁতে পারেনি।
তেমন যদি হয়ে থাকে তা হলে, সে যুগে তাঁকে যে পরিমাণ সমালোচনার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা ছিল তা
ভেবে আমারাই শঙ্কিত হচ্ছি (রবীন্দ্রনাথও যেখানে বাদ যাননি)। সম্ভবত সেই সব কথা ভেবে কবিতাগুলি
কোনও এক সুদূর রাজস্থানী, অবাঙ্গালী কবির নামে প্রকাশ করেছিলেন, প্রথমে কয়েকটি পত্রিকায় এবং পরে
বইয়ের আকারে। তাতে একদিকে যেমন কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, অন্য দিকে স্বাভাবিকভাবে
সমালোচকগণের শাণিত লেখনীর থেকে রক্ষাও পেয়েছিলেন।
"মাদল" কাব্যগ্রন্থে কবির মাকে উত্সর্গ করা "অশ্র-অর্ঘ্য" শিরোনামের একটি সুন্দর আবেগপূর্ণ কবিতা আছে,
যা তাঁর নিজের মাকেই উদ্দেশ্য করে লেখা, তা তাঁর আত্ম-জীবনী পড়লেই আঁচ করা যায়।
এই সব কারণে আমরা মনে করছি যে কবি চাঁদমল এবং দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর এক ও
অভিন্ন ব্যক্তি। অর্থাৎ “চাঁদমল” ছিল কবি দীনেশচন্দ্র সেনের ছদ্মনাম!
“মাদল” কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা আমরা রামধনু পত্রিকায় প্রকাশিত পেয়েছি কবি চাঁদমল-এর নামে। সেই
কবিতাটিও এখানে তুলে দিয়েছি দীনেশচন্দ্র সেনের নামেই!
কেউ নিশ্চিতভাবে অন্যথা প্রমাণ করতে পারলে আমরা কবি চাঁদমলের কবিতার আলাদা পাতা তৈরী করে
দেবো।
আমরা মনে করছি যে “চাঁদমল” নামটি দীনেশচন্দ্র সেনের ছদ্মনাম ছাড়া আর কিছুই নয়!
নিজের কবিতা সম্বন্ধে দীনেশচন্দ্রের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
আমরা এখানে তাঁর নিজের আত্মজীবনী “ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য” গ্রন্থের বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁর নিজের
জীবনে কবিতা লেখা সম্বন্ধে উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। সেখানে তিনি লিখেছেন যে কেন তঁর কবিতা লেখা হয়ে
ওঠে নি এবং কাব্য থেকে কেমনভাবে তিনি গদ্য সাহিত্যে চলে এলেন এবং “বঙ্গ-ভাষা ও সাহিত্য”-এর মত
গ্রন্থ রচনার দিকে এগিয়ে গেলেন . . .
গ্রন্থের সাহিত্য-সেবা : কৌতুক ও উত্সব অধ্যায়ে, ৭৬-পৃষ্ঠায়, তাঁর ৭ বছর বয়সে সুয়াপুরে থাকার সময়ে
কবিতালেখার কথা লিখেছেন . . .
আমার সাহিত্য-জীবন অতি শৈশবেই আরব্ধ হইয়াছিল। যখন আমার ৭ বত্সর বয়স, তখন আমি পয়ার
ছন্দে সরস্বতীর স্তব লিখিয়াছিলাম। তত্পর কত যে কবিতা লিখিয়াছি, তাহার ইয়ত্তা ছিল না। ক্লাসে ভাল
ছাত্র না হইলেও পাঠ্যপুস্তক ছাড়া বাহিরের সাহিত্য-চর্চায় আমার সমকক্ষ কেহ ছিল না। আমাদের সুয়াপুর
গ্রামের নিকটবর্তী নন্নার গ্রাম হইতে কৈবর্ত-জমিদার অম্বিকাবাবু ভারত-সুহৃদ্ নামক একখানি মাসিক পত্রিকা
বাহির করেন। আমার ১০ বত্সর বয়স, তখন সেই সেই পত্রিকায় “জলদ” নামক এক কবিতা লিখিয়া পাঠাই।
. . . দশ বত্সর বয়সের পক্ষে এ লেখাটা নিতান্ত মন্দ হয় নাই। . . . ইহার পর বিস্তর কবিতা লিখিয়াছি . . .
গ্রন্থের হবিগঞ্জ অধ্যায়ে, ১০০-পৃষ্ঠায়, ১৬ বছর বয়সে মামার বাড়ীতে থাকার সময়ের কথা লিখেছেন . . .
“এইরূপ নানা ভাবের তরঙ্গে দিন কাটিয়া যাইত। রাত্রি হইলে কবিতা লিখিতাম, ইংরাজী বই পড়িতাম ;
রাত্রি যতই নিঝুম হইত, ততই মায়ের জন্য, বাবার জন্য প্রাণটা ছটফট করিয়া উঠিত, চক্ষে অবিরলধারে
জল পড়িত।”
কুমিল্লার চাকুরী অধ্যায়, ১০৮-পৃষ্ঠায়, ভিক্টোরিয়া স্কুলে হেডমাস্টারের পদে থাকার সময়ে লিখেছেন . . .
গৃহের অশান্তি, শোক, দুঃখ আমার উদ্যমকে দমাইয়া দিতে পারে নাই। আমি অসংখ্য কবিতা
লিখিয়াছিলাম। আমার একখানি কাব্য “কুমার ভূপেন্দ্র সিংহ” কুমিল্লার এক প্রেস হইতে বাহির হইল। যেদিন
স্তূপাকৃতি করিয়া মুদ্রিত পুস্তকগুলি আমাদের বাহিরের ঘরে রাখিলাম, সেই রাত্রিতে আগুন লাগিয়া প্রায়
সমস্ত বই পুড়িয়া গেল, দুই চারিখানি বহু কষ্টে বাহির করিতে পারিয়াছিলাম। বোধ হয় একখানি আমার
বাড়ী খুঁজিলে এখনও পাওয়া যাইতে পারে। . . .
১১১-পৃষ্ঠায়
. . . কুমার “কুমার ভূপেন্দ্র সিংহ” আমার ১৯ বত্সর বয়সের লেখা। ১৮৮৬ সনে পুস্তকখানি রচিত
হইয়াছিল। ইহার ২|৩ বত্সর পরে ছাপা হইয়া অগ্নিদাহে অধিকাংশ পুস্তক বিনষ্ট হইয়া যায়।
এইভাবে আমার গৃহভারতীর অগ্নি-পরীক্ষা হইয়া গেল। আরো এক কারণে দেবীর বেদী, কবিত্বের শতদল,
আমার বাড়ীতে প্রতিষ্ঠা পাইতে পারিল না। . . .
১১৩-পৃষ্ঠায়
. . . আমার শত শত কাব্যের পাণ্ডুলিপি, যাহা কুমিল্লা ছাড়িবার সময় আমি একটা বৃহৎ সিন্দুকে রাখিয়া
আসিয়াছিলাম, তাহা তথা হইতে হারাইয়া গিয়াছে। আমি আর কিছুতেই সে সকলের সন্ধান পাইলাম না।
তাহা ছাপা হইলে আধখানা ওয়েবস্টার-এর তুল্য আয়তনের হইত। শৈশব ও কৈশোরে যাহা কিছু
লিখিয়াছিলাম---সাহিত্য হিসাবে হয়ত তাহার কোন মূল্যই নাই---কিন্তু আমার বহু আরাধনার জিনিষগুলি
আমার প্রিয় ছিল। আমার নিত্যকার সুখ-দুঃখ বিজড়িত সেই খাতাগুলি দেখিবার জন্য বড়ই ইচ্ছা হয়।
বড়ই দুঃখের বিষয় যে কোথা হইতে কে আসিয়া আমার ভারতীর সেবার পথে এইরূপ বিঘ্ন উপস্থিত করিল।
১১৩-পৃষ্ঠায় তিনি জানাচ্ছেন তাঁর গদ্যসাহিতের দিকে চলে আসার কথা . . .
ইংরেজী সাহিত্যের একখানি ইতিহাস---ভারতীয় আদর্শের মাপকাঠিতে বিচার করিয়া বাংলা ভাষায়
লিখিতে শুরু করিব এই সংকল্প করিতেছিলাম। এমন সময় কলিকাতার পিস্ অ্যাসোসিয়েশন-এর নোটিশ
পড়িলাম, ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ সম্বন্ধে গবেষণামূলক সর্বোত্তম প্রবন্ধের জন্য পুরস্কার একটি রৌপ্যপদক
দেওয়া হইবে। প্রবন্ধের বিচারক হইবেন---চন্দ্রনাথ বসু ও রজনীকান্ত গুপ্ত।
আমি বঙ্গের প্রাচীন সাহিত্য লইয়া এতদিন ঘাঁটাঘাঁটি করিতেছিলাম---সুতরাং এ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখিতে
সহজেই প্রবৃত্ত হইলাম। . . . পিস্ অ্যাসোসিয়েশন ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ সম্বন্ধে আমার প্রবন্ধই
পুরস্কারযোগ্য মনে করিয়াছিলেন।
দীনেশচন্দ্র সেন সম্বন্ধে শিশিরকুমার দাশের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
শিশিরকুমার দাশ তাঁর সম্পদিত ২০০৩ সালে প্রকাশিত, “সংসদ বাংলা সাহিত্য সঙ্গী” গ্রন্থের ৯৮-পৃষ্ঠায়
দীনেশচন্দ্র সেনের কবি-প্রতিভার উল্লেখ করে লিখেছেন . . .
“দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষক এবং বাংলা সাহিত্যের রচয়িতা। দীনেশচন্দ্রের
প্রথম রচনা কুমার ভুপেন্দ্রসিংহ (১৮৯০) একটি আখ্যা কাব্য। তিনি কবি-খ্যাতি পাননি, কিন্তু তাঁর
কবিস্বভাব তাঁর ঐতিহাসিক রচনার মধ্যে দিয়ে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। তাঁর দেশের সংস্কৃতির প্রতি ছিল
গভীর মমতা। দেশপ্রেম, কবিবন্দনা এবং অতীতের প্রতি আগ্রহ তাঁর সমগ্র কর্মের তিনটি প্রেরণা। . . .
বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ও ভালবাসার একটি ফল বৃহৎবঙ্গ (১ম খণ্ড ১৯৩৫, ২য়
১৯৩৫)---বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস।”
দীনেশচন্দ্র সেনের বিরুদ্ধে আবদুল করিমকে নিয়ে অভিযোগের সারবত্তা - পাতার উপরে . . .
কিম্বদন্তী সম পুথি বিষারদ ও বৈষ্ণব সাহিত্যের অগ্রণী বিশেষজ্ঞ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এবং
দীনেশচন্দ্র সেনকে নিয়ে দুটি অভিযোগ প্রচলিত আছে। প্রথমটি তাঁর ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত “বঙ্গভাষা ও
সাহিত্য” গ্রন্থটিকে নিয়ে এবং দ্বিতীয়টি তাঁর সহ-সম্পাদনায় ১৯২২ সালে প্রকাশিত “গোপীচন্দ্রের গান”
গ্রন্থটিকে নিয়ে। আমরা তা একে একে নীচে তুলে দিয়ে দেখার চেষ্টা করবো যে এই অভিযোগের কোন
সারবত্তা ছিল কি না।
১। ব্রজসুন্দর সান্যাল তাঁর ১৯০৪ সালে ঘোড়ামারা, রাজশাহী থেকে প্রকাশিত, “মুসলমান বৈষ্ণব কবি” গ্রন্থের
বিজ্ঞাপনে (মুখবন্ধে) লিখেছেন . . .
“. . . শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে’ আলাওলের একটী পদ উদ্ধৃত হইয়াছে ; সে
পদটী শ্রীযুক্ত আবদুল করিম মহাশয় দীনেশ বাবুকে দিয়াছিলেন কিন্তু দীনেশ বাবুর পুস্তকে তাহার
উল্লেখ নাই ; উক্ত পদটীও ইহাতে প্রকাশিত হইল।”
উপরোক্ত আলাওলের রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদটি হল “ননদিনী রস-বিনোদিনী” ইত্যাদি। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত
“বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” ১ম খণ্ড ১ম সংস্করণে এই পদটি নেই তাই আবদুল করিম মহাশয়ের উল্লেখের প্রশ্নই
ওঠে না। কিন্তু ১৯০১ সালে প্রকাশিত “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” ১ম খণ্ড ২য় সংস্করণে ওই পদটি রয়েছে ৫৪৫-
পৃষ্ঠায়। এই সংস্করণে এবং এর পরবর্তী কোন সংস্করণের ভূমিকাতে আবদুল করিম মহাশয়ের প্রতি
কোনো কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়নি।
ফলে দেখা যাচ্ছে যে এই অভিযোগটির সারবত্তা রয়েছে।
২। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ একবার ভবানী দাস বিরচিত “গোপীচন্দ্রের গান” পুথির সম্পাদনার
খসড়াটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। এরপর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “গোপীচন্দ্রের গান”
গ্রন্থটি দীনেশচন্দ্র সেন, বসন্তরঞ্জন রায় ও বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য্যর নামে প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্যবিশারদের
নাম সেই গ্রন্থে ছিল না।
বণিকবার্তা.নেট ওয়েবসাইটে, ২৪.০৮.২০১৬ তারিখে প্রকাশিত, ফিরোজ আহমেদের “আবদুল করিম সাহিত্য-
বিশারদ” প্রবন্ধে তিনি এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। অভিযোগটি ছিল এই রকম . . .
দূর মফস্বলবাসী এবং সামাজিক প্রতিপত্তিহীন আবদুল করিম বহুবার আরো বেশি রকমের অশিষ্ট
আচরণের এবং ক্ষেত্রবিশেষে বড় রকমের অবিচারেরও শিকার হয়েছেন। অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্যই
‘গোপীচন্দ্রের গান’ নিয়ে যে শঠতার বর্ণনা করেছেন, তা মর্মান্তিক। আবদুল করিম ভবানী দাস বিরচিত
‘গোপীচন্দ্রের গান’-এর একটি খসড়া তৈরি করে পাঠিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু “কলিকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় সেই ‘খসড়া’খানি লইয়া কি করিয়াছিলেন, তাহা প্রকাশ করিয়া বলেন নাই ; দীনেশচন্দ্র সেন
কেবলমাত্র উল্লেখ করিয়াছিলেন যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত ‘গোপীচন্দ্রের গানে’র ‘সংস্করণে শ্রীযুক্ত
বসন্তরঞ্জন রায় মহাশয় মুনশী সাহেবের পাঠ হইতে বহুল পরিমাণে সাহায্য গ্রহণ করিয়াছেন... কলিকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় হইতে দীনেশচন্দ্র সেন, বসন্তরঞ্জন রায় এবং বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য এ তিনজনের নামে সম্পাদিত
হইয়া ‘গোপীচন্দ্রের গান’ নামক যে গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তাহার শেষাংশে মুনশী আবদুল করিম সাহিত্য-
বিশারদ কর্তৃক চারিখানি পুঁথি মিলাইয়া ভবানী দাসের যে পুঁথি সম্পাদিত হইয়াছিল, তাহা আনুপূর্বিক
প্রকাশিত হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তাহাতে মুনশী সাহেবের নাম উল্লিখিত হয় নাই।”
আমাদের কাছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত “গোপীচন্দ্রের গান” গ্রন্থের দুটি খণ্ডই রয়েছে।
প্রাপ্ত প্রথম খণ্ডটিতে কোনও ভূমিকা বা মুখবন্ধ নেই। যদি থেকেও থাকে আমাদের প্রাপ্ত বইটিতে সেই
পাতাগুলি নেই। সুতরাং আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব হচ্ছে না যে গোপীচন্দ্রের গান ১ম খণ্ডে, আবদুল করিম
সাহিত্যবিশারদ কে নিয়ে কিছু লেখা হয়েছিল কি না। তবে ২য় খণ্ডের ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র সেন যা
লিখেছেন তা থেকে বোঝা যায় যে ১৯২২ সালে প্রকাশিত ১ম খণ্ডে সাহিত্যবিশারদকে নিয়ে কিছু লেখা
হয়নি কারণ তাঁর পাঠানো ৪টি পুথির সাহায্যে পাঠ ১ম খণ্ডে নয়, ২য় খণ্ডেই প্রকাশিত হয়েছে।
১৯২৪ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য, বসন্তরঞ্জন রায় ও দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত “গোপীচন্দ্রের গান”
গ্রন্থের ২য় খণ্ডের মুখবন্ধে দীনেশচন্দ্র সেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে নিয়ে যা লিখেছেন তা আমরা
এখানে তুলে দিচ্ছি। মুখবন্ধে ৩-পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন . . .
“সম্পূর্ণ গাথা আবৃত্তি করিতে পারে এমন “যোগী” এখন দুর্ল্লভ। রংপুর জেলার ভিন্ন স্থানীয় দুইটি বৃদ্ধ যোগীর
আবৃত্তি অনুসারে দুইটি সুবিস্তৃত পাঠ এবং অপর এক যোগীর নিকট হইতে একটি আংশিক পাঠ প্রায়
১৬|১৭ বত্সর পূর্ব্বে সংগ্রহ করা হয়, এবং ১৩১৫ সালে সাহিত্য-পরিযৎ-পত্রিকায় উহার পরিচয় প্রকাশিত
হয়। তাহার পর বাঙ্গালা দেশের কোন কোন স্থান হইতে গোপীচন্দ্রের গানের হস্তলিখিত বা মুদ্রিত পুঁথি
আবিষ্কৃত হইয়াছে। তন্মধ্যে ত্রিপুরা চট্টগ্রাম জেলায় সংগৃহীত ভবানীদাস-বিরচিত, পুঁথি এবং উত্তর বঙ্গে
সংগৃহীত মুসলমান কবি সুকুর মামুদের লিখিত পুস্তক বিশেষ উল্লেখ যোগ্য। ভবানীদাসের পুঁথি গোপীচন্দ্রের
পাঁচালী নামে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে মুদ্রিত হইল। চট্টগ্রাম হইতে মুনসী আবদুল করিম চারিখানি পুঁথির
সাহায্যে এই পাঁচালীর একটি পাঠ স্থির করিয়া পাঠান। উহার সঙ্গে উল্লিখিত পুঁথির একখানিও ছিল ; ঐ
পুঁথিকে আদর্শ করিয়া এবং মুন্সী সাহেব কৃত পাঠের সহিত মিলাইয়া অন্যতম সম্পাদক শ্রীযুক্ত বসন্তরঞ্জন
মহাশয় বিশেষ যত্ন পূর্ব্বক বর্ত্তমান পাঠ প্রস্তুত করিয়াছেন। সম্পাদকগণ এই অবসরে মুন্সী সাহেবকে
তাঁহাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইতেছেন।
এরপরে মুখবন্ধের উপসংহারে দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন . . .
“উপসংহারে আমি অন্যতম সম্পাদকদ্বয় - বিশ্বেশ্বর বাবু ও বসন্ত বাবু সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলিব। মুন্সী
আবদুল করিমের টীকা টিপন্নী সহিত প্রদত্ত গানটি যে আমাদের বিশেষ উপকারে লাগিয়াছে, তাহা পূর্ব্বেই
বলা হইয়াছে। . . .”
বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য, বসন্তরঞ্জন রায় ও দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় ২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে গোপীচন্দ্রের
গান (১ম খণ্ড), গোপীচন্দ্রের পাঁচালী (২য় খণ্ড) এবং গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস (২য় খণ্ড)।
আগেই বলেছি যে ১ম খণ্ডের কোনও মুখবন্ধ বা ভূমিকা বা কৃতজ্ঞতা স্বীকারের কোন পাতা আমরা দেখতে
পাইনি। ২য় খণ্ডের মুখবন্ধে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মহাশয়কে খুব স্পষ্টভাবে কৃতজ্ঞতা
জানিয়েছেন। মুখবন্ধের দু জায়গায় সাহিত্যবিশারদের উপরোক্ত উল্লেখ রয়েছে। আমাদের মনে হয়
গৌপীচন্দ্রের গান গ্রন্থটি কে ঘিরে দীনেশচন্দ্র সেনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে, তা অমূলক।
অর্থাৎ যা কিছু তথ্য প্রমাণ রয়েছে তা থেকে দেখা যাচ্ছে যে এই অভিযোগটির সারবত্তা নেই।
তবে, সাহিত্যবিশারদ যদি তাঁর পাঠ এই জন্য পাঠিয়ে থাকেন যাতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি বা
অর্থানুকুল্যে তিনি নিজেই সম্পাদনার কাজ করবেন, তাহলে অবশ্য অবিচার হয়েছে তাঁর প্রতি, তা স্বীকার
করতেই হবে। সেই ক্ষেত্রে দীনেশচন্দ্র সেন অথবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ছিল সাহিত্যবিশারদকে
গ্রন্থ সম্পাদনা ও প্রকাশনার পূর্বেই জানানো যে, তাঁরা তাঁর পাঠানো পাঠ নিয়ে কি করতে চলেছেন। কিন্তু
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি ঠিক কি লিখেছিলেন তা না জানলে এর মিমাংসা সম্ভব নয়। সম্ভবত তা
জানার আর উপায় নেই। দীনেশচন্দ্র সেনের লেখা থেকে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না।
মিলনসাগরে কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুরের কবিতা তুলে এই পাতা তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুরের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
উত্স -
- দীনেশচন্দ্র সেন, “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য”, ১৮৯৬।
- দীনেশচন্দ্র সেন, “ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য”, ১৯২২।
- দীনেশচন্দ্র সেন, “মাদল”, ১৯৩১।
- বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য্য, বসন্তরঞ্জন রায় ও দীনেশচন্দ্র সেন, “গোপীচন্দ্রের গান” ১ম ও ২য় খণ্ড, ১৯২২-২৪।
- ব্রজসুন্দর সান্যাল, “মুসলমান বৈষ্ণব কবি”, ১৯০৪।
- সুকুমার সেন, “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস” ৪র্থ খণ্ড, ১৯৫৮।
- ডঃ শিশির কুমার দাশ, সংসদ সাহিত্য সঙ্গী ২০০৩।
- সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু, “সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান” ১ম খণ্ড, ১৯৭৬।
- ফিরোজ আহমেদ, "আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ", বণিকবার্তা.নেট ।
- http://dspace.wbpublibnet.gov.in:8080/jspui/
- https://archive.org/
- https://crossasia.org/
- বাংলাপিডিয়া
আমাদের যোগাযোগের ঠিকানা :-
srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ২৬.৮.২০১৯।
.