*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

বিজয়িনী


হে মোর রাণী !            তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে |
আমার                       বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে ||


আমার                     সমর-জয়ী অমর তরবারী
.        দিনে দিনে ক্লান্তি আনে , হ’য়ে উঠে ভারী,
এখন                      এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি
এই                      হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে ||


ওগো                      জীবন-দেবী !
.          আমায় দেখে কখন্ তুমি ফেল্ লে চোখের জল,
আজ                        বিশ্ব-জয়ীর  বিপুল দেউল তাইতে টলমল ||



আজ                       বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে,
বিজয়িনী !                 নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত                       তূণ আমার আজ তোমার মালায় পুরে,
আমি                       বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে ||


.                   **************



.                                                                              
পরে  

মিলনসাগর
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর "ছায়ানট"
থেকে কয়েকটি কবিতা
১।
২।
৩।
৪।
৫।
৬।
৭।
৮।
৯।
১০।
১১।
১২।
১৩।
বিজয়িনী     
কমল-কাঁটা     
চৈতী হাওয়া        
শায়ক-বেঁধা পাখী        
পলাতকা    
চিরশিশু      
বিদায়-বেলায়         
দূরের-বন্ধু    
সন্ধ্যাতারা           
ব্যথা নিশীথ    
আশা      
আপন পিয়াসী     
অ-কেজোর গান              
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

কমল-কাঁটা

আজকে দেখি হিংসা-মদের মত্ত বারণ-রণে
জাগ্ ছে শুধু মৃণাল-কাঁটা আমার কমল-বনে  ||

.        উঠ্ ল যখন ভীম কোলাহল,
.        আমার বুকের রক্ত-কমল
.        কে ছিঁড়িল ---বাঁধ-ভরা জল
.                        শুধায় ক্ষণে ক্ষণে |
ঢেউ-এর দোলায় মরাল-তরী নাচবে না আনমনে ||

কাঁটাও আমার যায় না কেন, কমল গেল যদি |
সিনান-বধূর শাপ শুধু আজ কুড়াই নিরবধি !

.        আস্ বে কি আর পথিক বালা ?
.        প’র্ বে আমার মৃণাল-মালা ?
.        আমার জলজ-কাঁটার জ্বালা
.                        জ্ব’লবে মোরই মনে ?
ফুল না পেয়েও  কমল-কাঁটা বাঁধ্ বে কে কঙ্কণে ?


.                   **************



.                                                                              
পরে  

মিলনসাগর
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

চৈতী হাওয়া

হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-----পাইনি খুঁজে আর,
আজকে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার !
.        আজ্ কে তোমার জন্মদিন----
.        স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন
হাত্ ড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল-অন্ধকার !
এই-সে-হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার !

শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল,
কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোত্পল ?
.        আঁধার দীঘির রাঙ্ লে মুখ,
.        নিটোল ঢেউ-এর ভাঙ্ লে বুক,----
কোন পূজারী নিল ছিঁড়ে ? ছিন্ন তোমার দল
ঢেকেছে আজ কোন দেবতার কোন্ সে পাষাণ-তল ?

অস্ত-খেয়ার হারামানিক-বোঝাই করা না’
আস্ ছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ |
.        ঘাটে আমি রই ব’সে
.        আমার মানিক কই গো সে ?
পারাপারের ঢেউ-দোলানী হান্ ছে বুকে ঘা !
আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা !

বইছে আবার চৈতী-হাওয়া, গুমরে ওঠে মন,
পেয়েছিলাম এম্ নি হাওয়ায় তোমার পরশন |
.        তেম্ নি আবার মহুয়া-মউ
.        মৌমাছিদের কৃষ্ণা-বউ
পান করে ওই ঢুল্ ছে নেশায়, দুল্ ছে মহুল বন !
ফুল-সৌখিন দখিন-হাওয়ায় কানন উচাটন !

প’ড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই
মধুপ দেখে যাদের শাখা আপনি যেত নুই |
.        হাস্ তে তুমি দুলিয়ে ডাল,
.        গোলাপ হ’য়ে ফুটত গাল !
থলকমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই !
বকুল-শাখা ব্যাকুল হ’ত টলমলাত’ ভুঁই !

চৈতী রাতির গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার বর,
দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর !
.        ভুঁই-তারকা সুন্দরী
.        সজনে ফুলের দল ঝরি’
থোঁপা থোঁপা লাজ ছড়াত’ দোলন্ -খোঁপার’ পর,
ঝাঁঝাল্ হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙ্গার স্বর !

পিয়াল-বনায় পলাশ ফুলের গেলাস্ ভরা মউ,
খেত বঁধূর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ !
.        লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই,
.        বল্ তে ‘আমি অম্ নি চাই !’
খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ !
হিজল্ শাখায় ডাকত পাখী, “বউ গো কথা কউ |”

ডাক্ ত ডাহুক জল-পায়রা, নাচত ভরা বিল,
জোড়া ভূরু ওড়া যেন আস্ মানে গাঙ্-চিল্ !
.        হঠাৎ জলে রাখতে পা,
.        কাজলা দীঘির শিউরে’ গা-------
কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল !
ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর-দীঘির নীল  !

উদাস দুপুর কখন্ গেছে এখন বিকাল যায়,
ঘুম জড়ালো ঘুম্ তী নদীর ঘুমুর-পরা পায় !
.        শঙ্খ বাজে মন্দিরে,
.        সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে,
ঝাউ-এর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায় !
মাঠের বাঁশী বন্-উদাসী ভাম্ পলাশী গায় !

বউল আজি বাউল হ’ল আমরা তফাতে !
আম-মুকুলের গুঁজি কাঠি দাও কি খোঁপাতে ?
.        ডাবের শীতল জল দিয়ে
.        মুখ মাজ’ কি আর প্রিয়ে ?
প্রজাপতির ডানাঝরা সোনার টোপাতে
ভাঙা ভুরু দাও কি জোড়া রাকুল শোভাতে ?

বউল ঝ’রে ফ’লেছে আজ থোলো থোলো আম,
রসের পীড়ায় টস্ টসে-বুক ঝুর্ ছে গোলাব জাম !
.        কামরাঙারা রাঙল ফের
.        পীড়ন পেতে ঐ মুখের,
স্মরণ করে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম----
জামরুলের রস ফেটে পড়ে, হায় কে দেবে দাম !

ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর,
ভেবেছিলুম গাঁথব মালা----পাইনে খুঁজে ডোর !
.        সেই চাহনি  নীল-কমল
.        ভ’র্ ল আমার মানস-জল,
কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্ম-মূলে মোর !
বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর!

তরী আমার কোন্ কিনারায় পাইনে খুঁজে কূল,
স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কম্ লা নেবুর ফুল |
.        পাহাড়তলির শাল বনায়
.        বিষের মত নীল ঘনায় !
সাঁঝ প’রেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদী-দুল !
হায় গো আমার ভিন্ গায়ে আজ পথ হয়েছে ভুল !

কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই,
কেঁদে ফিরে যায় যে চইত----তোমার দেখা নেই !
.        কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর-----
.        কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর ?
তেম্ নি ক’রে জাগছ কি রাত আমার আশাতেই ?
কুড়িয়ে-পাওয়া-বেলায় খুঁজি হারিয়ে-যাওয়া খেই !

পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’ ,
এই তরীতে হয়তো তোমার প’ড়বে রাঙা পা !
.        আবার তোমার সুখ-ছোওয়ায়
.        আকুল দোলা লাগবে নায়,
এক তরীতে যাব মোরা আর-না হারা গাঁ,
পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’ ||

.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

শায়ক-বেঁধা পাখী

.        রে নীড়-হারা, কচি-বুকে শায়ক-বেঁধা পাখী |
.        কেমন ক’রে কোথায় তোর আড়াল দিয়ে রাখি ?


.        কোথায় রে তোর কোথায় ব্যথা বাজে ?
.        চোখের জলে অন্ধ আঁখি, কিছুই দেখি না যে  !
.        ওরে মানিক ! এ অভিমান আমায় নাহি সাজে-----
তোর        জুড়াই ব্যথা আমার ভাঙা বক্ষপুটে ঢাকি’ !
.        ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী !
.        কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি ?

.        বক্ষে বিঁধে বিষ-মাখানো শর,
.        পথ-ভোলা রে ! লুটিয়ে প’লি এ’ কা’র বুকের’পর ?
.        কে চিনালে পথ তোরে হায় এই দুখিনীর ঘর ?
তোর        ব্যথার শান্তি লুকিয়ে আছে আমার ঘরে নাকি ?
.        ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী !
.        কেমন করে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি ?


.        হায়, এ কোথায় শান্তি খুঁজিস্ তোর ?
ডাক্ ছে দেয়া, হাঁক্ ছে হাওয়া, কাঁপছে কুটীর মোর !
.        ঝঞ্ঝাবাতে নিবেছে দীপ, ভেঙেছে সব দোর,
দুলে        দুঃখ-রাতের অসীম রোদন বক্ষে থাকি’  থাকি’ !
.        ওরে আমার কোমল-বুকে কাঁটা-বেঁধা পাখী  !
.        এমন দিনে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি ?



.        মরণ যে ঝাপ বরণ করে তোরে,
.        ‘মা’ ‘মা’ ডেকে যে দাঁড়ায়এই শক্তিহীনার দ্বারে !
.        মানিক আমি পেয়ে শুধু হারাই বারে বারে,
ওরে        তাই তো ভয়ে বক্ষ কাঁপে কখন দিবি ফাঁকি !
.        ওরে আমার হারামণি ! ওরে আমার পাখী
.        কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি ?


.        হারিয়ে-পাওয়া ওরে আমার মানিক !
.        দেখেই তোরে চিনেছি আয় বক্ষে ধরি খানিক !
.        বাণ-বেঁধা বুক দেখে তোরে কোলে কেহ না নিক,
ওরে        হারার ভয়ে ফেল্ তে পারে চির-কালের মা  কি ?
.        ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী  !
.        কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি ?


.        এ যে রে তোর চির-চেনা স্নেহ,
.        তুই তো আমার ন’স্ রে অতিথ অতীত কালের কেহ,
.        বারে বারে নাম হারায়ে এসেছি্ স এই গেহ
এই        মায়ের বুকে থাক যাদু তোর য’দিন আছে বাকী !
.        প্রাণের আড়াল করতে পারে সৃজন দিনের মা কি ?
.        হারিয়ে যাওয়া ? ওরে পাগল, সে তো চোখের ফাঁকি  ||


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

পলাতকা

কোন্ সুদূরের চেনা বাঁশীর ডাক শুনেছিস্ ওরে চখা ?
.                ওরে      আমার পলাতকা !
.        তোর        প’ড়লো মনে কোন হারা-ঘর,
.                স্বপন-পারের কোন্ অলকা ?
.                ওরে   আমার পলাতকা !


.        তোর    জল ভ’রেছে চপল চোখে,
.        বল্        কোন্ হারা-মা ডাকলো তোকে রে !
.        ঐ        গগন-সীমায় সাঁঝের ছায়ায়
.                হাতছানি দেয় নিবিড় মায়ায়-----
উতল পাগল !                  চিনিস্ কি তুই চিনিস্ ওকে রে ?
যে বুক-ভরা ও’ গভীর স্নেহে ডাক দিয়ে যায় ‘আয়,
.                ওরে   আয়  আয়  আয়,
.        কোলে আয় রে আমার দুষ্টু খোকা !
.                ওরে      আমার পলাতকা !’



.        দখিন্ হাওয়ায় বনের কাঁপনে------
দুলাল আমার ! হাত-ইশারায় মা কি রে তোর
.                                     ডাক দিয়েছে আজ ?
এত দিনে চিন্ লি কি রে পর ও আপনে !
নিশিভোরেই তাই কি আমার নাম্ লো ঘরে সাঁঝ !
.                ধানের শীষে, শ্যামার শিসে-----
.                যাদুমণি ! বল্ সে কিসে রে,
.        তুই        শিউরে চেয়ে ছিঁড়্ লি বাঁধন !
.                চোখ-ভরা তোর উছ্ লে কাঁদন রে !


তোরে         কে পিয়ালো সবুজ-স্নেহের কাচা বিষে রে !
যেন        আচম্ কা কোন্ শশক-শিশু চ’ম্ কে ডাকে হায়,
.                ‘ওরে         আয়  আয়  আয়-------
.                        আয়  রে খোকন আয়,
বনে                       আয় ফিরে আয় বনের সখা !
.                 ওরে    চপল পলাতকা ||’


.                   **************



.                                                                          
পরে  

মিলনসাগর
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

চিরশিশু        

নাম-হারা তুই পথিক-শিশু এলি অচিন্ দেশ পারায়ে !
কোন্ নামের আজ প’র্ লি কাঁকন, বাঁধন-হারার কোন্ কারা এ ||
.                আবার মনের মতন ক’রে
.                কোন্ নামে বল্ ডাকব তোরে !
.                পথ-ভোলা তুই এই সে ঘরে
.                    ছিলি ওরে এলি ওরে
.                    বারে বারে নাম হারায়ে ||

ওরে যাদু ওরে মাণিক, আঁধার ঘরের রতন-মণি !
ক্ষুধিত ঘর ভ’রলি এনে ছোট্ট হাতের একটু ননী !
.                আজ যে শুধু নিবিড় সুখে
.                কান্না-সায়র উথ্ লে বুকে,
.                নতুন নামে ডাক্ তে তোকে
.                         ওরে ও কন্ঠ রুখে’
.                         উঠ্ ছে কেন মন ভারায়ে !
অস্ত হ’তে এলে পথিক উদয় পানে পা বাড়ায়ে ||

.                   **************



.                                                                       
উপরে  

মিলনসাগর
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

বিদায়-বেলায়    


তুমি অমন ক’রে গো বারে-বারে জল-ছলছল-চোখে চেয়ো না,
.                        জল ছলছল-চোখে চেয়ো-না,
ঐ কাতর-কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না,
.                        শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না ||


হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,
আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না |
.         ঐ        ব্যথাতুর আঁখি কাঁদো-কাঁদো মুখ
.                দেখি,  আর শুধু হু-হু করে বুক !
.                চলার তোমার বাকী পথটুক্----
.                পথিক !  ওগো, সুদূর পথের পথিক----
হায়,      অমন ক’রে ও অকরুণ গীতে আঁখির সলিলে ছেয়ো না,
.                ওগো  আঁখির সলিলে ছেয়ো না ||


.                দূরের পথিক ! তুমি ভাবো বুঝি
.                      তব ব্যথা কেউ বোঝে না,
.                তোমার ব্যথার তুমিই দরদী একাকী,
.                পথে ফেরে যারা পথ-হারা,
.                     কোনো গৃহবাসী তারে খোঁজে না,----
বুকে ক্ষত হ’য়ে জাগে আজো সেই ব্যথা-লেখা কি ?


দূর   বাউলের গানে ব্যথা হানে বুঝি ধূ-ধূ মাঠে পথিকে ?
এ যে মিছে অভিমান পরবাসী ! দেখে ঘর-বাসীদের ক্ষতি কে ?
.                তবে জান’ কি তোমার বিদায়-কথায়
.                      কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায়
.                আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায়-----
.                পথিক !      ওগো অভিমানী দূর পথিক !
.        কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো
.                            মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না,
.        ওগো যাবে যাও,  তুমি বুকে ব্যথা নিয়ে যেয়ো না ||


.                   **************



.                                                                              
পরে     

মিলনসাগর
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

দূরের-বন্ধু                


বন্ধু আমার !    থেকে  থেকে  কোন্ সুদূরের নিজন পুরে
.                ডাক দিয়ে যাও ব্যথার সুরে ?
আমার          অনেক দুখের পথের বাসা বারে বারে ঝড়ে উড়ে
.                        ঘর-ছাড়া তাই বেড়াই ঘুরে ||



.                তোমার বাঁশীর উদাস কাঁদন
.                শিথিল করে সকল বাঁধন,
.                কাজ হ’ল তাই পথিক সাধন,
.                        খুঁজে  ফেরা পথ-বধূরে,
.                        ঘুরে ঘুরে দূরে দূরে  ||
হে মোর প্রিয় !   তোমার বুকে এইটুকুতেই হিংসা জাগে,
তাই তো পথে হয় না থামা-----  তোমার ব্যথা বক্ষে লাগে !



.                বাঁধতে বাসা পথের পাশে,
.                তোমার চোখে কান্না আসে,
.                উত্তরী বায় ভেজা ঘাসে
.                       শ্বাস ওঠে আর নয়ন ঝুরে,
.                     বন্ধু, তোমার সুরে সুরে ||


.                   **************



.                                                                              
পরে     

মিলনসাগর
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

সন্ধ্যাতারা        


ঘোমটা-পরা কাদের ঘরের বউ তুমি ভাই সন্ধ্যাতারা ?
তোমার চোখের দৃষ্টি জাগে হারানো কোন্ মুখের পারা ||



.                সাঁঝের প্রদীপ আঁচল ঝেঁপে
.                বঁধূর পথে চাইতে বেঁকে
.                চাউনিটি কার উঠছে কেঁপে
.                        রোজ সাঁঝে ভাই এম্ নি ধারা ||


কার হারানো বধূ তুমি অস্তপথে মৌন মুখে
ঘনাও সাঁঝে ঘরের মায়া গৃহহীনের শূন্য বুকে !


.                এই যে নিতুই আসা যাওয়া,
.                এমন করুণ মলিন চাওয়া,
.                কার তরে হায় আকাশ-বধূ
.                        তুমিও কি আজ প্রিয়-হারা ||


.                   **************



.                                                                              
পরে     

মিলনসাগর
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

ব্যথা নিশীথ


এই        নীরব নিশীথ রাতে
শুধু         জল আসে আঁখিপাতে ?


কেন        কি কথা স্মরণে রাজে ?
বুকে        কার হতদার বাজে
কোন্        ক্রন্দন হিয়া-মাঝে
ওঠে        গুমরি’ ব্যর্থতাতে,
আর        জল ভরে আঁখিপাতে ||



মম        ব্যর্থ জীবন-বেদনা
এই        নিশীথে লুকাতে নারি,
তাই        গোপনে একাকী শয়নে
শুধু        নয়নে উথলে বারি |
ছিল        সে-দিনো এমনি নিশা,
বুকে         জেগেছিলো শত তৃষা,
তারি        ব্যর্থ নিশাস মিশা
ওই        শিথিল শেফালিকাতে
আর        পূরবীর বেদনাতে ||


.                   **************



.                                                                              
পরে     

মিলনসাগর
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

আশা       

.              হয়তো তোমার পা’ব দেখা
যেখানে ঐ নত আকাশ চুম্ ছে বনের সবুজ রেখা ||


.               ঐ সুদূরের গাঁয়ের মাঠে
.             আ’লের পথে বিজন ঘাটে,
.             হয়তো এসে মুচকি হেসে
.                    ধ’র্ বে আমার হাতটি একা ||


ঐ নীলের ঐ গহন-পারে ঘোম্ টা-হারা তোমার চাওয়া
আন্ লে খবর গোপন দূতী দিক্ পারে ঐ দখিন হাওয়া ||
.              বনের ফাঁকে দুষ্টু তুমি
.            আস্তে যাবে নয়না চুমি’,
.            সেই সে কথা লিখছে হোথা
.                     দিগ্বলয়ের অরুণ লেখা !


.                   **************



.                                                                              
পরে     

মিলনসাগর
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

আপন পিয়াসী    

.        আমার আপনার চেয়ে আপন যে-জন
.                খুঁজি তারে আমি আপনায়,
.        আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
.                আমারি তিয়াষী বাসনায় !


.        আমারি মনের তৃষিত আকাশে
.        কাঁদে সে চাতক আকুল পিয়াসে,
.        কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে
.                নিশীথে স্বপনে জোছনায় ||



আমার মনের পিয়াল তমালে হেরি তারে স্নেহ-মেঘ শ্যাম,
অশনি-আলোক হেরি তারে থির-বিজুলি-উজল অভিরাম ||


.        আমারি রচিত কাননে বসিয়া
.        পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া
.        সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া,
.                     আপনারি গলে দোলে হায় ||


.                   **************



.                                                                              
পরে     

মিলনসাগর
*
ছায়ানট , কাজী নজরুল ইসলাম

অ-কেজোর গান   


ঐ        ঘাসের ফুলে মটর শুঁটীর ক্ষেতে
আমার এ-মন মৌমাছি ভাই উঠেছে আজ মেতে ||


এই         রোদ্-সোহাগী পউষ-প্রাতে
.        অথির প্রজাপতির সাথে
.        বেড়াই কুঁড়ির পাতে পাতে
.                পুষ্পল মৌ-খেতে |
আজ        আমন ধানের বিদায়-কাঁদন শুনি মাঠে রেতে ||


আজ         কাশ-বনে কে শ্বাস ফেলে যায় মরা নদীর কূলে,
ও তার হ’ল্ দে আঁচল চ’ল্ তে জড়ায় অড়হরের ফুলে !
ঐ        বাব্ লা-ফুলে নাক-ছাবি তার,
.        গা’য় সাড়ি নীল অপ্ রাজিতার,
.        চ’লেছি সেই অজানিতার,
.                উদাস পরশ পেতে |
আমায় ডেকেছে  সে চোখ-ইশারায় পথে যেতে যেতে ||



ঐ         ঘাসের ফুলে মটরশুঁটীর ক্ষেতে,
আমার এ-মন-মৌমাছি ভাই উঠেছে তাই মেতে ||


.                   **************



.                                                                              
পরে     

মিলনসাগর