বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর "চিত্তনামা"
থেকে কয়েকটি কবিতা
*
চিত্তনামা , কাজী নজরুল ইসলাম

সান্ত্বনা


চিত্ত-কুঁড়ি-হাস্নাহানা মৃত্যু-সাজে ফুটল গো !
জীবন-বেড়ায় আড়াল ছাপি’ বুকের সুবাস টুট্ লো গো !
.            এই তো কারার প্রাকার টুটে’
.            বন্দী এল বাইরে ছুটে
তাই তো নিখিল আকুল-হৃদয় শ্মশান-মাঝে জুটল গো !
ভবন-ভাঙা আলোর শিখায় ভুবন রেঙে উঠলো গো !


স্ব-রাজ দলের চিত্ত-কমল লুট্ ল বিশ্বরাজের পায়,
দলের চিত্ত উঠলো ফুটে শতদলের শ্বেত আভায় !
.             রূপের কুমার আজ্ কে দোলে
.             অপরূপের শীশ্-মহলে,
মৃত্যু-বাসুদেবের কোলে কারার কেশব ঐ গো যায়,
অনাগত বৃন্দাবনে মা যশোদা শাঁখ-বাজায় !


আজ্ কে রাতে যে ঘুমুলো, কাল্ কে প্রাতে জাগবে সে
এই বিদায়ের অস্ত-আঁধার উদয়-ঊষায় রাঙ্ বে রে !
.             শোকের নিশির শিশির ঝরে
.             ফ’লবে ফসল ঘরে ঘরে,
আবার শীতের রিক্ত শাখায় লাগবে ফুলের রাগ এসে,
যে মা সাঁঝে ঘুম পাড়াল, চুম দিয়ে ঘুম ভাঙবে সে |



না ঝ’র্ লে তাঁর প্রাণ-সাগরে মৃত্যু-রাতের হিম কণা
জীবন শুক্তি ব্যর্থ হ’ত, মুক্তি মুক্তা ফ’লত না  |
.              নিখিল আঁখির ঝিনুক মাঝে
.              অশ্রু মাণিক ঝ’ল্ ত না যে !
রাতের উনুন না নিবিলে চাঁদের সুধা গ’লত না !
গগন-লোকে আকশ-বধূর সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্ব’লত না !



মরা বাঁশে বাজ্ বে বাঁশি কাটুক্ না আজ ঠাকুর তায়,
এই বেণুতেই ব্রজের বাঁশি হয়ত বাজবে এই হেথায় !
.             হয়ত  এবার মিলন-রাসে
.           বংশীধারী আসবে পাশে,
চিত্ত-চিতার ছাই মেখে শিব সৃষ্টি-বিষাণ ঐ বাজায় !
জন্ম নেবে মেহেদী ঈষা ধরার বিপুল এই ব্যথায় !


কর্মে যদি বিরাম না হয়, শান্তি তবে আস্ ত না !
ফ’লবে ফসল -----নইলে নিখিল-নয়ন নীরে ভাস্ ত না !
.                নেইক’ দেহের খোসার মায়া,
.             বীজ আনে তাই তরুর ছায়া,
আবার যদি না জন্মাত, মৃত্যুতে সে হাস্ ত না !
আস্ বে আবার ----নইলে ধরায় এমন ভালো বাস্ তো না !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
চিত্তনামা , কাজী নজরুল ইসলাম

ইন্দ্র-পতন

তখনো অস্ত যায়নি শূর্য, সহসা হইল শুরু
অম্বরে ঘন ডম্বরু-ধ্বনি গুরু-গুরু গুরু-গুরু !
আকাশে আকাশে বাজিছে এ কোন্ ইন্দ্রের আগমনী ?
শুনি, অম্বুদ-কম্বু--নিনাদে ঘন বৃংহতি-ধ্বনি |
বাজে চিক্কুর-হ্রেষা-হর্ষণ  মেঘ-মন্দুরা-মাঝে,
সাজিল প্রথম আষাঢ় আজিকে প্রলয়ঙ্কর সাজে !

ঘনায় অশ্রু-বাষ্প-কুহেলি ঈশান-দিগঙ্গনে,
স্তব্ধ-বেদনা দিগ্-বালিকারা কি যেন কাঁদুনী শোনে !
কাঁদিছে ধরার তরুলতা পাতা, কাঁদিতেছে পশু পাখী,
ধরার ইন্দ্র স্বর্গে চলেছে ধূলির মহিমা মাখি’ !
বাজে আনন্দ-মৃদং গগনে, তড়িৎ-কুমারী নাচে,
মর্ত্য-ইন্দ্র বসিবে গো আজ স্বর্গ-ইন্দ্র কাছে !
সপ্ত-আকাশ-সপ্তস্বরা হানে ঘন করতালি,
কাঁদিছে ধরায় তাহারি প্রতিধ্বনি----খালি, সব খালি !

হায় অসহায়-সর্বংসহা মৌনা ধরণী মাতা,
শুধু দেব-পূজা, তরে কি মা তোর পুষ্প হরিৎ-পাতা ?
তোর বুকে কি মা চির-অতৃপ্ত রবে সন্তান-ক্ষুধা ?
তোমার মাটির পাত্রে  কি গো মা ধরে না অমৃত-সুধা ?
জীবন-সিন্ধু মথিয়া যে-কেহ আনিবে অমৃত-বারি
অমৃত-অধিপ দেবতার রোষ পড়িবে কি শিরে তারি ?
হয়ত তাহাই’ হয়ত নহে তা, এটুকু জেনেছি খাঁটি,
তারে স্বর্গের আছে প্রয়োজন যারে ভালোবাসে মাটি !

কাঁটার মৃণালে উঠেছিল ফুটে যে চিত্ত-শতদল,
শোভেছিল যাহে বাণী কমলার রক্ত-চরণ-তল,
সম্ভ্রমে-নত পূজারী মৃত্যু ছিঁড়িল সে শতদলে----
শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য অর্পিবে বলি’ নারায়ণ-পদতলে !
জানি জানি মোরা, শঙ্খ-চক্র-গদা যাঁর হাতে শোভে----
পায়ের পদ্ম-হাতে উঠে তাঁর অমর হইয়া রবে !
কত সান্ত্বনা-আশা-মরীচিকা কত বিশ্বাস-দিশা
শোক-সাহারায় দেখা দেয় আসি, মেটেনা প্রাণের তৃষা !

দুলিছে বাসুকী মণি-হারা-ফণী, দুলে সাথে বসুমতী,
তাহার ফণার দিন-মণি আজ কোন্  গ্রহে দেবে জ্যোতি !
জাগিয়া প্রভাতে হেরিনু আজিকে জগতে সুপ্রভাত,
শয়তানও আজ দেবতার নামে করিছে নান্দী পাঠ !----
হে মহাপুরুষ মহাবিদ্রোহী হে ঋষি সোহম্ স্বামী
তব ইঙ্গিতে দেখেছি সহসা সৃষ্টি গিয়াছে থামি’ !
থমকি’ গিয়াছে গতির বিশ্ব চন্দ্র-সূর্য-তারা,
নিয়ম ভুলেছে কঠোর নিয়তি, দৈব দিয়াছে সাড়া !

যখনি স্রষ্টা করিয়াছে ভুল, করেছ সংস্কার,
তোমার অগ্রে স্রষ্টা তোমারে ক’রেছে নমস্কার !
ভৃগুর মতন যখনি দেখেছ অচেতন নারায়ণ,
পদাঘাতে তাঁর এনেছ চেতনা, কেঁপেছে জগজ্জন !
ভারত-ভাগ্য-বিধাতা বক্ষে তব পদ-চিন্ ধরি’
হাঁকিছেন, ‘আমি এমনি করিয়া সত্য স্বীকার করি !
জাগাতে সত্য এত ব্যাকুলতা এত অধিকার যার,
তাঁহার চেতন-সত্যে আমার নিযুত নমস্কার’ !
আজ শুধু জাগে তব অপরূপ সৃষ্টি-কাহিনী মনে,
তুমি দেখা দিলে অমিয়-কন্ঠ বাণীর কমল-বনে !
কখন্ তোমার বীণা ছেয়ে গেল সোনার পদ্ম-দলে,
হেরিনু সহসা ত্যাগের তপন তোমার ললাট-তলে !
লক্ষ্ণী দানিল সোনার পাপড়ি, বীণা দিল করে বাণী,
শিব মাখালেন ত্যাগের বিভূতি কন্ঠে গরল দানি’,
বিষ্ণু দিলেন ভাঙনের গদা, যশোদা-দুলাল বাঁশী,
দিলেন অমিত তেজ ভাস্কর, মৃগাঙ্ক দিল হাসি !

চীর গৈরিক দিয়া আশিসিল ভারত-জননী কাঁদি’,
প্রতাপ শিবাজী দানিল মন্ত্র, দিল উষ্ণীষ বাঁধি’ !
বুদ্ধ দিলেন ভিক্ষাভান্ড, নিমাই দিলেন ঝুলি,
দেবতারা দিল মন্দার-মালা, মানব মাখালো ধূলি !
নিখিল-চিত্ত-রঞ্জন  তুমি উদিলে নিখিল ছানি’----
মহাবীর, কবি, বিদ্রোহী, ত্যাগী, প্রেমিক, কর্মী, জ্ঞানী !
হিমালয় হ’তে বিপুল বিরাট্, উদার আকাশ হ’তে,
বাধা-কুঞ্জর তৃণ-সম ভেসে গেল তব প্রাণ-স্রোতে |

ছন্দ-গানের অতীত হে ঋষি, জীবনে পারিনি তাই
বন্দিতে তোমা’,  আজ আনিয়াছি চিত্ত-চিতার ছাই !
বিভূতি-তিলক ! কৈলাস হ’তে ফিরেছ গরল পিয়া,
এনেছি অর্ঘ্য শ্মশানের কবি ভষ্ম বিভূতি নিয়া !
নাও অঞ্জলি, অঞ্জলি নাও, আজ আনিয়াছি গীতি
সারা জীবনের না-কওয়া-কথার ক্রন্দন-নীরে তিতি’ !
এত ভালো মোরে বেসেছিলে তুমি দাওনিক’ অবসর
আমারেও ভালোবাসিবার, আজ তাই কাঁদে অন্তর !

আজিকে নিখিল-বেদনার কাছে মোর ব্যথা কতটুক্,
ভাবিয়া ভাবিয়া সান্ত্বনা খুঁজি, তবু হা হা করে বুক !
আজ ভারতের ইন্দ্র-পতন, বিশ্বের দুর্দিন,
পাষাণ বাঙ্ লা প’ড়ে এককোণে স্তব্ধ অশ্রুহীন !
তারি মাঝে হিয়া থাকিয়া থাকিয়া গুমরি’ গুমরি’ ওঠে,
বক্ষের বাণী চক্ষের জলে ধুয়ে যায়, নাহি ফোটে !
দীনের বন্ধু, দেশের-বন্ধু মানব-বন্ধু তুমি,
চেয়ে দেখ আজ লুটায় বিশ্ব তোমার চরণ চুমি’ !
গগনে তেমনি ঘনায়েছে মেঘ, তেমনি ঝরিছে বারি,
বাদলে ভিজিয়া শত স্মৃতি তব হ’য়ে আসে ঘন ভারি |

পয়গম্বর ও অবতার-যুগে জন্মিনি মোরা কেহ,
দেখিনিক’ মোরা তাঁদেরে, দেখিনি দেবের জ্যোতির্দেহ,
কিন্তু যখনি বসিতে পেরেছি তোমার চরণ-তলে
না জানিতে কিছু না বুঝিতে কিছু নয়ন ভরেছে জলে !
সারা প্রাণ যেন অঞ্জলি হ’য়ে ও-পায়ে পড়েছে লুটি’,
সকল গর্ব উঠেছে মধুর প্রণাম হইয়া ফুটি’ !
বুদ্ধের ত্যাগ শুনেছি মহান, দেখিনিক’ চোখে তাহে,
নাহি আফ্ সোস্ দেখছিআমরা ত্যাগের শাহান্ শাহে,
নিমাই লইল সন্ন্যাস প্রেমে, দিইনিক’ তাঁরে ভেট,
দেখিয়াছি মোরা ‘রাজা সন্ন্যাসী’,  প্রেমের জগৎ শেঠ !

শুনি পরার্থে প্রাণ দিয়া দিল অস্থি বনের ঋষি,
হিমালয় জানে, দেখেছি দধীচি গৃহে ব’সে দিবানিশি !
হে নবযুগের হরিশচন্দ্র ! সাড়া দাও, সাড়া দাও !
কাঁদিছে শ্মশানে সুত কোলে সতী, রাজর্ষি ফিরে চাও !
রাজকুলমান পুত্র পত্নী সকল বিসর্জিয়া
চন্ডাল-বেশে ভারত-শ্মশানে ছিলে একা আগুলিয়া,
এস সন্ন্যাসী, এস সম্রাট্ , আজি  সে শ্মশান-মাঝে
ঐ শোনো তব পুণ্যে জীবন-শিশুর কাঁদন বাজে !

দাতাকর্ণের সম নিজ সুতে কারাগার-যূপে ফেলে
ত্যাগের করাতে কাটিয়াছে বীর বারে বারে অবহেলে !
ইব্ রাহিমের মতো বাচ্চার গলে খঞ্জর দিয়া
কোরবাণী দিলে সত্যের নামে, হে মানব নবী-হিয়া !
ফেরেশ্ তা সব করিছে সালাম, দেবতা নোয়ায় মাথা,
ভগবান-বুকে মানবের তরে শ্রেষ্ঠ আসন পাতা !

প্রজা-রঞ্জন রাম-রাজা দিল সীতারে বিসর্জন,
তারও হয়েছিল যজ্ঞে স্বর্ণ-জানকীর প্রয়োজন,
তব ভান্ডার-লক্ষ্ণীরে রাজা নিজ-হাতে দিলে তুলি’
ক্ষুধা-তৃষাতুর মানবের মুখে, নিজ নিলে পথ-ধূলি !
হেম-লক্ষ্ণীর তোমারও জীবন-জাগে ছিল প্রয়োজন,
পুড়িলে যজ্ঞে, তবু নিলেনাক’ দিলে যা বিসর্জন !
তপোবলে তুমি অর্জিলে তেজ বিশ্বামিত্র-সম,
সারা বিশ্বের ব্রাহ্মণ তাই বন্দিছে নমো নমো !

হে যুগ-ভীষ্ম !  নিন্দার শর-শয্যায় তুমি শুয়ে
বিশ্বের তরে অমৃত-মন্ত্র বীর-বাণী গেলে থুয়ে !
তোমার জীবনে ব’লে গেলে-----ওগো কল্কি আসার আগে
অকল্যাণের কুরুক্ষেত্রে আজো মাঝে মাঝে জাগে
চির-সত্যের পঞ্চজন্য, কৃষ্ণের মহাগীতা,
যুগে যুগে কুরু-মেদ-ধূমে জ্বলে অত্যাচারের চিতা !
তুমি নব ব্যাস, গেলে নবযুগ-জীবন-ভারত রচি’,
তুমিই দেখালে ----ইন্দ্রেরই  ‘তরে পারিজাত-মালা, শচী !

আসিলে সহসা অত্যাচারীর প্রসাদ-স্তম্ভ টুটি’
নব-নৃসিংহ অবতার তুমি, পড়িল বক্ষে লুটি’
আর্ত-মানব-হৃদি-প্রহ্লাদ, পাগল-মুক্তি-প্রেমে !
তুমি এসেছিলে জীবন-গঙ্গা তৃষাতুর তরে নেমে !
দেবতারা তাই স্তম্ভিত হের দাঁড়ায়ে গগন-তলে
নিমাই তোমারে ধরিয়াছে বুকে, বুদ্ধ নিয়াছে কোলে !
তোমারে দেখিয়া কাহারও হৃদয়ে জাগেনিক’ সন্দেহ----
হিন্দু কিম্বা মুসলিম তুমি অথবা অন্য কেহ !
তুমি আর্তের, তুমি বেদনার, ছিলে সকলের তুমি,
সবারে যেমন আলো দেয় রবি, ফল দেয় সবে ভূমি !
হিন্দুর ছিলে আকবর তুমি, মুসলিমের আরংজিব,
যেখানে দেখেছ জীবের বেদনা, সেখানে দেখেছ শিব !
নিন্দাগ্লানির পঙ্ক মাখিয়া, পাগল, মিলন-হেতু
হিন্দু-মুসলমানের পরানে তুমিই বাঁধিলে সেতু |
জানি-না আজিকে কি অর্ঘ্য দেবে হিন্দু-মুসলমান,
ঈর্ষা পঙ্কে পঙ্কজ হ’য়ে ফুটুক এদের প্রাণ !
হে অরিন্দম মৃত্যুর তীরে করেছ শত্রু জয়,
প্রেমিক !  তোমার মৃত্যু-শ্মশান আজিকে মিত্রময় !
তাই দেখি, যারা জীবনে তোমায় দিলে কন্টক-হুল,
আজ তাহারাই এনেছে অর্ঘ্য নয়ন-পাতার ফুল !
কে যে ছিলে তুমি জানিনাক কেহ, দেবতা কি আওলিয়া,
শুধু এই জানি, হেরে আর কারে ভরেনি এমন হিয়া !

****                ****                ****                ****

আজি দিকে দিকে বিপ্লব-অহিদল খুঁজে ফেরে ডেরা,
তুমি ছিলে এই নাগ-শিশুদের ফণী-মনসার বেড়া !
তুমিই রাজার ঐরাবতের পদতল হ’তে তুলে
বিষ্ণু-শ্রীকর-অরবিন্দেরে আবার শ্রীকরে থুলে !
তুমি দেখেছিলে ফাঁসীর গোপীতে বাঁশীর গোপীমোহন,
রক্ত-যমুনাকূলে রচে’ গেলে প্রেমের বৃন্দাবন !
তোমার ভগ্ন চাকায় জড়ায়ে চালযেছে এরা রথ,
আপন মাথার মানিক জ্বালায়ে দেখায়েছে রাতে পথ,
আজ পথ-হারা আশ্রয়হীন তাহারা যে মরে ঘুরে,
গুহা-মুখে বসি’ ডাকিছে সাপুড়ে মারণ-মন্ত্র সুরে !

***                ***                ***                ***

যেদিকে তাকাই কূল নাহি পাই, অকূল হতাশ্বাস,
কোন্ শাপে ধরা স্বরাজ-রথের চক্র করিল  গ্রাস ?
যুধিষ্ঠিরের সন্মুখে রণে পড়িল সব্যসাচী,
ঐ হের’ দূরে কৌরব-সেনা উল্লাসে ওঠে নাচি !
হিমালয় চিরে আগ্নেয়-যান চীত্কার করি’ ছুটে,
শত ক্রন্দন-গঙ্গা যেন গো পড়িছে পিছনে টুটে !
স্তব্ধ-বেদনা গিরিরাজ ভয়ে জলদে লুকায়ে কায়
নিখিল-অশ্রু-সাগর বুঝি বা তাহারে ডুবাতে চায় !
টুটিয়াছে আজ গর্ব তাহার, লাজে নত উঁচু শির,
ছাপি’ হিমাদ্রি উঠিছে প্রণাম সমগ্র পৃথিবীর !
ধূর্জটি-জটা বাহিনী গঙ্গা কাঁদিয়া কাঁদিয়া চলে,
তারি নীচে চিতা---যেন গো শিবের ললাটে অগ্নি জ্বলে !

***                ***                ***                ***

মৃত্যু আজিকে হইল অমর পরশি’  তোমার প্রাণ,
কালো মুখ তার হ’ল আলোময়, শ্মশানে উঠিছে গান !
অগুরু-পুষ্প-চন্দন পুড়ে হ’ল  সুগন্ধতর,
হ’ল শুচিতর অগ্নি আজিকে, শব হ’ল সুন্দর !
ধন্য হউক ভাগীরথী-ধারা তব চিতা ছাই মাখি’,
সমিধ হইল পবিত্র আজি কোলে তব দেহ রাখি’ !

***                ***                ***                ***

অসুর-নাশিনী জগন্মাতার অকাল উদ্বোধনে
আঁখি উপাড়িতে গেছিলেন রাম, আজিকে পড়িছে মনে ;
রাজর্ষি  !  আজি জীবন উপাড়ি’ দিলে অঞ্জলি তুমি,
দনুজ-দলনী জাগে কিনা না----আছে চাহিয়া ভারত-ভূমি !

****                ****                ***                ****

                                            হুগলী, ১১ই আষাঢ়---১৩৩২

.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
চিত্তনামা , কাজী নজরুল ইসলাম

রাজ-ভিখারী


কোন্ ঘর-ছারা বিবাগীর বাঁশী শুনে উঠেছিলে জাগি’
.                                           ওগো চির-বৈরাগী !

দাঁড়ালে ধূলায় তব কাঞ্চন-কমল-কানন ত্যাগি’------
.                                           ওগো চির-বৈরাগী !

.        ছিলে ঘুম-ঘোরে রাজার দুলাল,
.        জানিতে না কে সে পথের কাঙাল
ফেরে পথে পথে ক্ষুধাতুর-সাথে ক্ষুধার অন্ন মাগি’,
তুমি সুধার দেবতা ‘ক্ষুধা ক্ষুধা’ ব’লে কাঁদিয়া উঠিলে জাগি
.                                            ওগো চির-বৈরাগী !
আঙিয়া তোমার নিলে বেদনার গৈরিক রঙে রেঙে’
মোহ ঘুমপরী উঠিল শিহরি’ চমকিয়া ঘুম ভেঙে’ !
.        জাগিয়া প্রভাতে হেরে পুরবাসী,
.        রাজা দ্বারে দ্বারে ফেরে উপবাসী,
সোনার অঙ্গ পথের ধূলায় বেদনার দাগে দাগী  !
কে গো নারায়ণ নবরূপে এলে নিখিল-বেদনা-ভাগী----
.                                      ওগো চির-বৈরাগী !
‘দেহি ভবতি ভিক্ ষাম্  বলি দাঁড়ালে রাজ-ভিখারী,
খুলিল না দ্বার পেলেনা ভিক্ষা, দ্বারে দ্বারে ভয় দ্বারী !
.        বলিলে, ‘দেবেনা ?  লহ তবে দান-----
.        ভিক্ষাপূর্ণ আমার এ প্রাণ !’-------
দিল না ভিক্ষা, নিলনাক’ দান, ফিরিয়া চলিলে যোগী !
যে জীবন কেহ লইল না তাহা মৃত্যু লইল মাগি’ !

**********                ********                *****  হুগলী, ১৭ই আষাঢ়---১৩৩২


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর