বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর "দোলন-চাঁপা"
থেকে কয়েকটি কবিতা
*
দোলন-চাঁপা , কাজী নজরুল ইসলাম

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে    


.             আজ   সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে------
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগ্ বগিয়ে খুন হাসে
.             আজ   সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !

.                আজকে  আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে
বান ডেকে ঐ জাগ্ ল জোয়ার দুয়ার-ভাঙা কল্লোলে !
.                আস্ ল হাসি,  আস্ ল কাঁদন,
.              মুক্তি এলো, আস্ ল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুঃখের-সুখ আসে !
.                   ঐ     রিক্ত বুকের দুখ আসে----
.               আজ  সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !

.                    আস্ ল উদাস, শ্বস্ ল হুতাশ,
.                সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
.        ফুল্ লো সাগর দুল্ লো আকাশ ছুট্ লো বাতাস,
.        গগন  ফেটে চক্র ছোটে, পিনাক পাণির শূল আসে !
.                       ঐ        ধূমকেতু আর উল্কাতে
.                  চায়     সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,
.     আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
.                  আজ    সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে |


.                  আজ হাস্ ল আগুন, শ্বস্ ল ফাগুন,
.                  মদন মারে খুন-মাখা তূণ
.                  পলাশ অশোক শিমূল ঘায়েল
.                  ফাগ লাগে  ঐ দিক্-বাসে
.        গো        দিগ্ বালিকার পীতবাসে ;
.     আজ রঙ্গন এলো রক্ত প্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
.                  আজ  সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !
.                    আজ কপোট কোপের তূণ ধরি
.                   ঐ           আস্ ল যত সুন্দরী,
.      কারুর গায়ে  বুক-ডলা খুন,  কেউ বা আগুন,
.                    কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে !
.         তাদের প্রাণের ‘ বুক-ফাটে তাও মুখ-ফোটে-না’  বাণীর
.                                                বীণা মোর পাশে,
.                    ঐ        তাদের কথা শোনাই তাদের
.                             আমার চোখে জল আসে
.                               আজ  সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !


.                      আজ   আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
.                               আস্ ল নিকটআস্ ল সুদূর,
.                              আস্ ল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
.                             পাগ্ লা-গাজন-উচ্ছাসে !
.                    ঐ         আস্ ল আশিন শিউলি শিথিল
.                             হাস্ ল শিশির দুব্ ঘাসে
.                             আজ  সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !


.                    আজ    জাগ্ ল সাগর,  হাস্ ল মরু,
.                                কাঁপ্ ল ভূধর, কানন-তরু,
.                             বিশ্ব-ডুবান আস্ ল তুফান, উছ্ লে উজান
.                             ভৈরবীদের গান ভাসে,
.      মোর ডাইনে শিশু সদ্যজাত জরায়-মরা বাম পাশে !
.         মন ছুট্ ছে গো আজ বল্গা-হারা অশ্ব যেন পাগ্ লা সে !
.                        আজ    সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !
.                         আজ    সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
দোলন-চাঁপা , কাজী নজরুল ইসলাম

পূজারিণী



.                        এত দিনে অ-বেলায়---
.                              প্রিয়তম !
.                        ধূলি-অন্ধ  ঘূর্ণী সম
.                              দিবা যামী
.                              যবে আমি
.                নেচে ফিরি রুধিরাক্ত মরণ-খেলায়----
.                               এত দিনে অ-বেলায়
.                জানিলাম, আমি তোমা জন্মে জন্মে চিনি !
.                                পূজারিণী !
.                ঐ কন্ঠ, ও-কপোত-কাঁদানো রাগিণী,
.                                ঐ আঁখি, ঐ মুখ,
.                ঐ ভুরু, ললাট, চিবুক,
.                                ঐ তব অপরূপ রূপ,
.      ঐ তব দোলো-দোলো গতি-নৃত্য দুষ্ট দুল রাজহংসী জিনি-----
.                                চিনি, সব চিনি |


.                        তাই আমি এতদিনে
.                জীবনের আশাহত ক্লান্ত শুষ্ক বিদগ্ধ পুলিনে
.                        মূর্চ্ছাতুর সারা প্রাণ ভ’রে
.                        ডাকি শুধু ডাকি তোমা’,
.                        প্রিয়তমা !
.                ইষ্ট মম জপ-মালা ঐ তব সব চেয়ে মিষ্ট নাম ধ’রে!
.                        তারি সাথে কাঁদি আমি----
.      ছিন্ন-কন্ঠে কাঁদি আমি, চিনি তোমা’ , চিনি  চিনি  চিনি,
.                        বিজয়িনী নহ তুমি----নহ ভিখারিণী,
.   তুমি দেবী চির-শুদ্ধা তাপস-কুমারী,  তুমি মম চির-পূজারিণী !
.                যুগে যুগে এ পাষাণে বাসিয়াছ ভালো,
.    আপনারে দাহ করি’ মোর বুকে জ্বালায়েছ আলো,
.                           বারে বারে করিয়াছ তব পূজা ঋণী |
.     চিনি প্রিয়া চিনি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি চিনি চিনি !
.        চিনি তোমা’ বারে বারে জীবনের অস্ত-ঘাটে, মরণ-বেলায়,
.                          তারপর চেনা শেষে
.                          তুমি-হারা পরদেশে
.                           ফেলে যাও একা শূন্য বিদায়-ভেলায় !---------

***                ***                ***                ***                ***


.        আজ দিনান্তের প্রান্তে বসি’ আঁখি-নীরে তিতি’
.        আপনার মনে আনি তারি দূর দূরান্তের স্মৃতি------
মনে পড়ে ----বসন্তের-শেষে-আসা ম্লান মৌন মোর
.                                        আগমনী সেই নিশি,
যেদিন আমার আঁখি ধন্য হ’ল তব আঁখি-চাওয়া সনে মিশি,
তখনো সরল সুখী আমি---ফোটে নি যৌবন মম,
উন্মুক্ত বেদনা-মুখী আসি- আসি ঊষা-সম
.        আধ-ঘুমে আধ-জেগে তখনো কৈশোর,
.        জীবনের ফোটো  ফোটো রাঙা নিশি -ভোর |
.                        বাধা বন্ধ-হারা
.        অহেতুক নেচে-চলা ঘূর্ণীবায়ু পারা
.        দুরন্ত গানের বেগ অফুরন্ত হাসি
.        নিয়ে এনু পথ-ভোলা আমি অতিদূর পরবাসী |
.                        সাথে তারি
.        এনেছিনু গৃহ-হারা বেদনার আঁখি-ভরা বারি |
এসে রাতে----- ভোরে জেগে গেয়েছিনু জাগরণী সুর,------  
ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিলে তুমি, কাছে এসেছিলে,-----
মুখ-পানে চেয়ে মোর সকরুণ হাসি হেসেছিলে,-----
হাসি হেরে কেঁদেছিনু----‘তুমি কার পোষা-পাখি কান্তার-বিধূর ?’
.        চোখে তব সে কী চাওয়া ! মনে হ’ল যেন
.                তুমি মোর ঐ কন্ঠ ঐ সুর
.                বিরহের কান্না-ভারাতুর
.                            বনানী-দুলানো,
দখিনা-সমীরে ডাকা কুসুম-ফোটানো বন-হরিণী-ভুলানো
.                আদি জন্মদিন হতে চেন তুমি চেন !
.        তারপর আনাদরে বিদায়ের অভিমান-রাঙা
.                             অশ্রু-ভাঙা-ভাঙা
.        ব্যথা-গীত গেয়েছিনু সেই আধ-রাতে ;
.        বুঝি নাই আমি সেই গান-গাওয়া ছলে
.        কারে পেতে চেয়েছিনু চিরশূন্য মম হিয়া-তলে----
শুধু জানি, কাঁচা-ঘুমে-জাগা তব রাগ-অরুণ-আঁখি-ছায়া
.                লেগেছিল মম আঁখি-পাতে !
.                আরো দেখেছিনু, ঐ আঁখির পলকে
.                বিস্ময়-পুলক-দীপ্তি ঝলকে ঝলকে
.        ঝ’লেছিল গলেছিল গাঢ় ঘন বেদনার মায়া,-----
করুণায় কেঁপে কেঁপে উঠেছিল বিরহিণী অন্ধকার-নিশীথিনী-কায়া !


.        তৃষাতুর চোখে মোর বড় যেন লেগেছিল ভালো
পূজারিণী ! আঁখি-দীপে-জ্বালা তব সেই স্নিগ্ধ সকরুণ আলো |-----
.                        তারপর------গান গাওয়া শেষে
.                        নাম ধ’রে কাছে বুঝি ডেকেছিনু হেসে |
.                        অমনি কি গর্জে ওঠা রুদ্ধ অভিমানে
.                           ( কেন কে সে জানে )
.        দুলি’ উঠেছিল তব ভুরু-বাঁধা স্থির আঁখি-তরী,
ফুলে উঠেছিল জল, ব্যথা-উষ্ণ-উত্স-মুখে তাহা ঝরঝর পড়েছিল ঝরি’
.        একটু আদরে এত অভিমান ফুলে-ওঠা, এত আঁখি-জল,
.        কোথা পেলি ওরে কা’র অনাদৃতা ওরে মোর ভিখারিণী
.                                                  বল্ মোরে বল্ !


.                        এই ভাঙা বুকে,
.            ঐ কান্না-রাঙা মুখ থুয়ে লাজ-সুখে        
.                        বল্ মোরে বল্
.           মোরে হেরি কেন এত অভিমান
.           মোর ডাকে কেন এত উথলায় চোখে তব জল ?
.            অ-চেনা অ-জানা আমি পথের পথিক
মোরে হেরে জলে পুরে ওঠে কেন তব ঐ বালিকার আঁখি অনিমিখ ?
.             মোর পানে চেয়ে সবে হাসে,
.        বাঁধা-নীড় পু’ড়ে যায় অভিশপ্ত তপ্ত মোর শ্বাসে ;
.            মণি ভেবে কত জন তুলে’ পরে গলে,
.            মণি যবেফণী হয়ে বিষ-দগ্ধ-মুখে
.            দংশে তার বুকে,
.            অমনি সে দলে পদতলে !
.             বিশ্ব যারে করে ভয় ঘৃণা অবহেলা,
.        ভিখারিণী ! তারে নিয়ে এ কি তব অকরুণ খেলা ?
.        তারে নিয়ে এ কি গূঢ় অভিমান্ ?  কোন্ অধিকারে
.        নাম ধ’রে ডাকাটুকু তা’ও হানে বেদনা তোমারে ?
.        কেউ ভালোবাসে নাই ? কেউ তোমা’ করেনি আদর?
জন্ম-ভিখারিণী তুমি ? তাই এত চোখে জল,অভিমানী করুণা-কাতর !



.                নহে তা ও নহে
.        বুক থেকে তিক্ত কন্ঠে কোন্ রিক্ত অভিমানী কহে----
.                        ‘নহে ত’ও নহে !’
.        দেখিয়াছি শতজন আসে এই ঘরে,
.        কতজন না চাহিতে এসে বুকে করে,
তবু তব চোখে মুখে এত অতৃপ্তি,  এ কী স্নেহ-ক্ষুধা |   
মোরে হেরে উলছায় কেন তব বুক-ছাপা এত প্রীতি-সুধা ?
.                সে রহস্য, রাণী !
.                কেহ নাহি জানে-----
.                তুমি নাহি জান----
.                        আমি নাহি জানি !
.                চেনে তাহা প্রেম, জানে শুধু প্রাণ----
কোথা হ’তে আসে এত অকারণে প্রাণে প্রাণে বেদনার টান !----
নাহি বুঝিয়াও আমি সেদিন বুঝিনু তাই, হে অপরিচিতা !
চির-পরিচিতা তুমি, জন্ম জন্ম ধ’রে মোর অনাদৃতা সীতা |
.        কানন-কাঁদানো তুমি তাপস-বালিকা
.        অনন্ত কুমারী সতী ; তব দেব-পূজার থালিকা
.        ভাঙিয়াছি যুগে যুগে, ছিঁড়িয়াছি মালা
খেলা-ছলে ; চির মৌনা শাপ-ভ্রষ্টা ওগো দেব-বালা !
.                      নীরবে সয়েছ সবি------
সহজিয়া ! সহজে জেনেছ তুমি, তুমি মোর জয়লক্ষ্মী, আমি তব কবি |

***`                ***                ***                ***                ***


তারপর ----নিশি-শেষে পাশে বসে শুনেছিনু তব গীত-সুর
.        লাজে-আধ-বাধবাধ শঙ্কিত বিধুর ;
সুর শুনে হ’ল মনে -----ক্ষণে ক্ষণে -----
মনে-পড়ে-পড়ে-না এ হারা -কন্ঠ যেন
কেঁদে কেঁদে সাথে, ‘ওগো চেন মোরে জন্মে জন্মে চেন !’----
.        মথুরায় গিয়া শ্যাম রাধিকায় ভুলেছিল যবে,
মনে লাগে----এই সুরে এই গীত-রবে কেঁদেছিল রাধা ;
অবহেলা-বেঁধা বুক নিয়ে এ যেন রে অতি-অন্তরালে ললিতার কাঁদা !
.        বন-মাঝে একাকিনী দময়ন্তী ঘু’রে ঘু’রে ঝুরে
ফেলে-যাওয়া নাথে তার ডেকেছিল ক্লান্ত-কন্ঠে এই গীত-সুরে |
.                কান্তে প’ড়ে মনে
.                বন-লতা সনে
.        বিযাদিনী শকুন্তলা কেঁদেছিল এই সুরে বনে সঙ্গোপনে !
.                হেম-গিরি-শিরে
.                হারা-সতী উমা হয়ে ফিরে
.        ডেকেছিল ভোলানাথে এমনি সে চেনা-কন্ঠে হায়,
কেঁদেছিল চির-সতী পতি-প্রিয়া প্রিয়ে তার পেতে পুনরায়-----
.                চিনিলাম, বুঝিলাম সবি----
যৌবন সে জাগিল না, লাগিল না মর্মে তাই গাঢ় হ’য়ে তব মুখ-ছবি |
.        তবু তব চেনা-কন্ঠে মম কন্ঠ সুর
.     রেখে আমি চ’লে গেনু কবে কোন্ পল্লী-পথে দূর |-----
.        দু’দিন না যেতে এ কি সেই পুণ্য গোমতীর কূলে
.        প্রথম উঠিল কাঁদি’ অপরূপ ব্যথা-গন্ধ নাভি-পদ্মমূলে !
.     খুঁজে ফিরি, কোথা হ’তে এই-ব্যথা-ভারাতুর মদ-গন্ধ আসে----
আকাশ বাতাস ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে শুধু মোর তপ্ত ঘন দীর্ঘশ্বাসে !


.                কেঁদে ওঠে লতা-পাতা,
.                ফুল পাখি নদী জল
.                মেঘ বায়ু কাঁদে সবি অবিরল,
কাঁদে বুকে উগ্রসুখে যৌবন-জ্বালায়-জাগা অতৃপ্ত বিধাতা !
.                পোড়া প্রাণ জানিল না কারে চাই,
.        চীত্কারিয়া ফেরে তাই----‘ কোথা যাই,
.                কোথা গেলে ভালোবাসাবাসি পাই ?’
.        হু-হু ক’রে ওঠে প্রাণ , মন করে উদাস-উদাস,
মনে হয়---এ নিখিল যৌবন-আতুর কোনো প্রেমিকের ব্যথিত হুতাশ !
.        চোখ পু’রে লাল নীল কত রাঙা, আবছায়া ভাসে,
.                আসে ---আসে
.                কার বক্ষ টুটে
.                মন প্রাণ-পুটে
.        কোথা হ’তে কেন এই মৃগ-মদ-গন্ধ-ব্যথা আসে ?
মন-মৃগ ছুটে ফেরে, দিগন্তর দুলি’ ওঠে মোর ক্ষিপ্ত হাহাকার-ত্রাসে !
.                কস্তুরী হরিণ-সম
.     আমারি নাভির গন্ধ খুঁজে ফেরে গন্ধ-অন্ধ মন-মৃগ মম !
.                আপনারই ভালবাসা
.     আপনি পিইয়া চাহে মিটাইতে আপনার আশা !
.        অনন্ত অগস্ত্য-তৃষাকুল বিশ্ব-মাগা যৌবন আমার
.        এক-সিন্ধু শুষি বিন্দুসম, মাগে সিন্ধু আর !
.        ভগবান ! ভগবান ! একি তৃষ্ণা অনন্ত অপার !
.     কোথা তৃপ্তি ? তৃপ্তি কোথা ? কোথা মোর তৃষ্ণা-হরা প্রেম-সিন্ধু
.                                                অনাদি পাথার ?
.                মোর চেয়ে স্বেচ্ছাচারী দুরন্ত দুর্বার !
.                        কোথা গেলে তারে পাই,
.                যার লাগি এত বড় বিশ্বে মোর, শান্তি নাই !
.                ভাবি আর চলি শুধু, শুধু পথ চলি
.                        পথে কত পথ-বালা যায়,
.                তারি পাছে হায় অন্ধ বেগে ধায়
.                ভালোবাসা ক্ষুধাতুর মন,
.      পিছু ফিরে কেহ যদি যায় ----অভিমানে জলে ভেসে যায় দু’নয়ন |
.                        দেখে তা’রা হাসে,
না চাহিয়া কেহ চ’লে যায়, ‘ভিক্ষা লহ’ ব’লে কেহ আসে দ্বার-পাশে !
.                প্রাণ আরো কেঁদে ওঠে তাতে
.     গুমরিয়া ওঠে বুক কাঙালের লজ্জাহীন গুরু বেদনাতে !
.        প্রলয়-পয়োধি-নীরে গর্জ্জে-ওঠা হুহঙ্কার সম
বেদনা ও অভিমানে ফু’লে ফু’লে দু’লে দু’লে ওঠে  ধূধূ
.                        ক্ষোভ-ক্ষিপ্ত-প্রাণ-শিখা মম !
পথ-বালা আসে ভিক্ষা-হাতে
লাথি মেরে চূর্ণ করি, গর্ব তার ভিক্ষা-পাত্র সাথে !
কেঁদে তারা ফিরে যায়, ভয়ে কেহ নাহি আসে কাছে,
.                ‘অনাথ-পিন্ডদ’ সম
.                মহাভিক্ষু প্রাণ মম
প্রেম-বুদ্ধ লাগি’ হায় দ্বারে দ্বারে মহাভিক্ষা যাচে,
.                “ভিক্ষা দাও, পুরবাসি |
বুদ্ধ লাগি’ ভিক্ষা মাগি, দ্বার হ’তে প্রভু ফিরে যায় উপবাসী !”
.                কত এল কত গেল ফিরে
.                কেহ ভয়ে কেহ বা বিস্ময়ে
.                ভাঙা-বুকে কেহ,
.                        কেহ অশ্রু-নীরে
.                কত এল কত গেল ফিরে |
.                        আমি যাচি পূর্ণ সমর্পণ,
.      বুঝিতে পারে না তাহা গৃহ-সুখী পুরনারীগণ |
.        তারা আসে হেসে,
.        শেষে হাসি-শেষে
.                কেঁদে তারা ফিরে যায়
.                আপনার গৃহ-স্নেহচ্ছায়------
বলে তারা, “হে পথিক ! বল বল তব প্রাণ কোন্ ধন-মাগে ?
সুরে তব এত কান্না, বুকে তব কা’র লাগি এত ক্ষুধা জাগে ?”
.        কি যে চাই বুঝে না কো কেহ,
.        কেহ আনে প্রাণ মন       কেহ বা যৌবন ধন,
.                        কেহ রূপ দেহ !
গর্বিতা ধনিকা আসে মদমত্তা আপনার ধনে,
আমারে  বাঁধিতে চাহে রূপ-ফাঁদে যৌবনের বনে |------
.         সব ব্যর্থ, ফিরে চলে নিরাশায় প্রাণ
.         পথে পথে গেয়ে গেয়ে গান---------
.         “কোথা মোর ভিখারিণী পূজারিণী কই ?
.          যে বলিবে ----‘ভালোবেসে সন্ন্যাসিনী আমি
.                        ওগো মোর স্বামী !
রিক্তা আমি, আমি তব গরবিনী , বিজয়নী নই !”
.          মরু মাঝে ছুটে ফিরি বৃথা,
.                হুহু ক’রে জ্বলে ওঠে তৃষা----
.          তারি মাঝে তৃষ্ণা-দগ্ধ প্রাণ
.                ক্ষণেকের তরে কবে হারাইল দিশা
.          দূরে কার দেখা গেল হাতছানি যেন-------
.                ডেকে ডেকে সে-ও কাঁদে-----
.                ‘আমি নাথ তব ভিখারিনী,
.                আমি তোমা’  চিনি,
.                তুমি মোরে চেন |’
.          বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে,
.                এ যে মিথ্যা মায়া,
জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা-ছায়া |
.          ‘ভিক্ষা দাও’ বলে আমি এনু তার দ্বারে,
কোথা ভিখারিনী ? ওগো এ যে মিথ্যা মায়াবিনী
.            এ যে ক্রুর নিষাদের ফাঁদ,
এ যে ছলে জিনে নিতে চাহে ভিখারীর ঝুলির প্রসাদ
.            হ’ল না সে জয়ী,
আপনার জালে প’ড়ে আপনি মরিল মিথ্যাময়ী |
কাঁটা-বেঁধা রক্ত-মাখা প্রাণ নিয়া এনু তব পুরে,
.           জানি নাই ব্যথাহত আমার ব্যথায়
.           তখনো তোমার প্রাণ পুড়ে |
.           তবু কেন কতবার মনে যেন হ’ত,
তব স্নিগ্ধ মদির পরশ মুছে নিতে পারে মোর
.                সব জ্বালা সব দগ্ধ ক্ষত
মনে হ’ত প্রাণ তব প্রাণে যেন কাঁদে অহরহ----
‘হে পথিক ! ঐ কাঁটা মোরে দাও, কোথা তব ব্যথা বাজে
.                        কহ মোরে কহ !”
নীরব গোপন তুমি মৌনা তাপসিনী,
.                তাই তব চির-মৌন ভাষা
শুনিয়াও শুনি নাই, বুঝিয়াও বুঝি নাই ঐ ক্ষুদ্র চাপা-বুকে
.                কাঁদে কত ভালোবাসা আশা !

***                ****                ***                ***        ***

এরি মাঝে কোথা হ’তে ভেসে এল মুক্ত-ধারা মা আমার
.                        সে ঝড়ের রাতে,
কোলে তুলে নিল মোরে, শত শত চুমা দিল সিক্ত আঁখি-পাতে |
.                        কোথা গেল পথ----
.                        কোথা গেল রথ----
.                        ডুবে গেল সব শোক-জ্বালা,
জননীর ভালোবাসা এ ভাঙা দেউল যেন দোলাইল দেয়ালীর আলা |
.                        গত-কথা গত-জন্ম হেন |
.                        হারা-মায়ে পেয়ে আমি ভুলে গেনু যেন |
.                        গৃহহারা গৃহ পেনু, অতি শান্ত-সুখে
কত জন্ম পরে আমি প্রাণ ভ’রে ঘুমাইনু মুখ থুয়ে জননীর বুকে |
.                        শেষ হল পথ-গান গাওয়া,
ডেকে ডেকে ফিরে গেল  হা-হা স্বরে পথ-সাথী তুফানের হাওয়া |

***                ***                ***                ***                ***


.                আবার আবার বুঝি ভুলিলাম পথ
বুঝি কোন্ বিজয়িনী-দ্বার-প্রান্তে আসি’ বাধা পেল পার্থ-পথ-রথ !
.                ভুলে গেনু কারে মোর পথে পথে খোঁজা,
.                ভলে গেনু প্রাণ মোর নিত্যকাল ধ’রে অভিসারী
.                                মাগে কোন্ পূজা,
.                ভুলে গেনু যত ব্যথা শোক,
নব  সুখ-অশ্রুধারে গলে গেল হিয়া,   ভিজে গেল অশ্রুহীন চোখ !
.        যে কোন্ রূপ-কমলেতে মোর ডুবে গেল আঁখি,
.                    সুরভিতে মেতে উঠে প্রাণে
.        উলসিয়া বিলসিয়া উথলিল প্রাণে
.                    এ কী ব্যগ্র উগ্র ব্যথা-সুখ !
.        বাঁচিয়া নতুন করে মরিল আবার
.                সীধু-লোভী বাণ-বেঁধা পাখি !---
.                       ---ভেসে গেল রক্তে মোর মন্দিরের বেদী
.                জাগিল না পাষাণ-প্রতিমা,
.                অপমানে দাবানল সম তেজে
.        রুখিয়া উঠিল এইবার যত মোর ব্যথা-অরুণিমা
.        হুঙ্কারিয়া ছুটিলাম বিদ্রোহের রক্ত-অশ্বে চড়ি,
.        বেদনার আদি-হেতু স্রষ্টা পানে মেঘ অভ্রভেদী,
.                ধূমধ্বজ প্রলয়ের ধূমকেতু-ধূমে
.        হিংসা হোমশিখা জ্বালি’ সৃজিলাম বিভীষিকা
.                স্নেহ-মরা শুষ্ক মরুভূমে !


.               ----        এ কি মায়া !   তার মাঝে মাঝে
.     মনে হ’ত কতদূর হতে, প্রিয়, মোর নাম ধ’রে যেন
.                        তব বীণা বাজে !
.              সে সুন্দর গোপন পথের পানে চেয়ে,
হিংসা-রক্ত-আঁখি মোর অশ্রু-রাঙা বেদনার রস যেত ছেয়ে !
.                      সেই সুর ডাক স্মরি ‘স্মরি’
.                       ভুলিলাম অতীতের জ্বালা,
.                     বুঝিলাম তুমি সত্য---তুমি আছ,
অনাদৃতা তুমি মোর, তুমি মোরে মনে প্রাণে যাচ,
.                      একা তুমি বন-বালা
.                মোর তরে গাঁথিতেছ মালা
.                        আপনার মনে
.                        লাজে সঙ্গোপনে |
.        জন্ম জন্ম ধ’রে চাওয়া তুমি মোর সেই ভিখারিনী |----
অন্তরের অগ্নি-সিন্ধু ফুল হ’য়ে হেসে উঠে কহে----‘চিনি,  চিনি |
.        বেঁচে ওঠ্ মরা প্রাণ !    ডাকে তোরে দূর হতে সেই-----
.        যার তরে এত বড় বিশ্বে তোর সুখ শান্তি নেই !’
.                                তারি মাঝে
.                        কাহার ক্রন্দন-ধ্বনি বাজে !




.                        কে যেন রে পিছু ডেকে চীত্কারিয়া কয়-----
‘বন্ধু  এ যে অবেলায় !  হতভাগ্য,  এ যে অসময় !’
.                        শুনিনু না মানা, মানিনু না বাধা,
প্রাণে শুধু ভেসে আসে জন্মান্তর হ’তে যেন বিরহিণী ললিতার কাঁদা
.                        ছুটে এনু তব পাশে
.                              ঊর্ধ্বশ্বাসে ;
মৃত্যু-পথ অগ্নি-রথ কোথা প’ড়ে কাঁদে,  রক্ত-কেতু গেল উড়ে,  পুড়ে,
তোমার গোপন পূজা বিশ্বের আরাম নিয়া এলো বুক জুড়ে !

***                ***                ***                ***                ***



.        তারপর যা বলিব হারায়েছি আজ তার ভাষা,
.        আজ মোর প্রাণ নাই, অশ্রু নাই, নাই শক্তি আশা !
যা বলিব আজ ইহা গান নহে, ইহা শুধু রক্ত-ঝরা প্রাণ-রাঙা
.                                অশ্রু-ভাঙা ভাষা !
.          ভাবিতেছ, লজ্জাহীন ভিখারীর প্রাণ----
.                সে--ও চাহে দেওয়ার সন্মান !
.          সত্য প্রিয়া, সত্য ইহা ; আমিও তা স্মরি’ ,
.                আজ শুধু হেসে মরি !
তবু শুধু এইটুকু জেনে রাখো প্রিয়তমা, দ্বার হ’তে দ্বারান্তরে
.                 ব্যর্থ হয়ে  ফিরে
এসেছিনু তব পাশে, জীবনের শেষ চাওয়া চেয়েছিনু তোমা’ |
.       প্রাণের সকল আশা সব প্রেম ভালোবাসা দিয়া
তোমারে পূজিয়াছিনু, ওগো মোর বে-দরদী পূজারিণী প্রিয়া !
ভেবেছিনু, বিশ্ব যারে পারে নাই তুমি নেবে তার ভার হেসে,
.        বিশ্ব-বিদ্রোহীরে তুমি করিবে শাসন
.                অবহেলে শুধু ভালোবেসে |
.        ভেবেছিনু , দুর্বিনীত দুর্জয়ীরে জয়ের গরবে
তব প্রাণে উদ্ভাসিবে অপরূপ জ্যোতি, তারপর একদিন
.        তুমিই মোর এ বাহুতে মহাশক্তি সঞ্চারিয়া
.                                  বিদ্রোহীর জয়লক্ষ্ণী হবে !



.        ছিল আশা, ছিল শক্তি, বিশ্বটারে টেনে
ছিঁড়ে তব রাঙা পদতলে ছিন্ন রাঙা পদ্মসম পূজা দেবো এনে !
.        কিন্তু হায় ! কোথা সেই তুমি ? কোথা সেই প্রাণ ?
.                কোথা সেই নাড়ী -ছেঁড়া প্রাণে টান ?



.                       এ-তুমি আজ সে-তুমি তো নহ ;
.                       আজ হেরি ---তুমিও ছলনাময়ী
.                        তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী !
.        কিছু মোরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,----
দুর্ভাগিনী ! দেখে হেসে মরি ! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি ?


.        মোর বুকে জাগিছেন অহরহ সত্য ভগবান,
.        তাঁর দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ণ,  এ দৃষ্টি যাহারে দেখে,
.        তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে দেখে তার প্রাণ !
.        লোভে আজ তব পূজা কলুষিত প্রিয়া ,
.                আজ তারে ভুলাইতে চাহ,
.        যারে, তুমি পূজেছিলে পূর্ণ মন প্রাণ সমর্পিয়া !


.                তাই আমি ভাবি কার দোষে------
.                        অকলঙ্ক তব হৃদি-পুরে
.                জ্বলিল এ মরণের আলো কবে প’শে ?
.        তবু ভাবি, একি সত্য ? তুমিও ছলনাময়ী ?



.                যদি তাই হয়, তবে মায়াবিনী অয়ি,
.                        ওরে দুষ্ট, তাই সত্য হোক !
.            জ্বালো তবে ভালো ক’রে জ্বালো মিথ্যালোক !
.                আমি তুমি সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারা
.                        সব মিথ্যা হোক,
জ্বালো ওরে মিথ্যাময়ী, জ্বালো তবে ভালো ক’রে
.                        জ্বালো মিথ্যালোক !

***                ***                ***                ***                ***



.                তব মুখ পানে চেয়ে আজ
.                বাজ-সম বাজে মর্মে লাজ
.                তবে অনাদর অবহেলা স্মরি’ স্মরি’
.                  তারি সাথে স্মরি’ মোর নির্লজ্জতা,
.                আমি আজ প্রাণে প্রাণে মরি |
মনে হয় -----ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি, ‘মা বসুধা দ্বিধা হও !
.                ঘৃণাহত মাটি-মাখা ছেলেরে তোমার
এ নির্লজ্জ মুখ-দেখা আলো হ’তে অন্ধকারে টেনে লও !’
.                তবু বারে বারে আসি আশা-পথ বাহি’
.                কিন্তু হায় যখনই ও-মুখ পানে চাহি’----
.        মনে হয়,------  হায়, হায়, কোথা  সেই পূজারিণী,
.                কোথা সেই রিক্তা সন্ন্যাসিনী ?
.        এ  যে  সেই চির--পরিচিত অবহেলা,
.                এ যে সেই ভাবহীন মুখ !
.        পূর্ণা নয়,  এ যে সেই প্রাণ নিয়ে ফাঁকি-ফাঁকি ----
.                অপমানে ফেটে যায় বুক !
.      প্রাণ নিয়া এ কি নিদারুণ খেলা খেলে এরা হায়,
.      রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দ’লে অলক্তক পরে এরা পায় !
.         এরা দেবী,  এরা লোভী,  এরা চাহে সর্বজন-প্রীতি !
ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্পণ,
পূজা হেরি’ ইহাদের ভীরু-বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি !
.                নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো !
.                 ইহাদের অতিলোভ মন,
.                 একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়,
.                     যাচে বহু জন !-----
.                যে-পূজা পূজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে,
যারে দিনু সেই পূজা সে--ই আজি প্রতারণা হানে !

***                ***                ***                ***


বুঝিয়াছি, শেষবার ঘিরে আসে সাথী মোর মৃত্যু-ঘন আঁখি,
.        রিক্ত প্রাণ তিক্ত সুখে হুঙ্কারিয়া উঠে তাই,
.        কার তরে ওরে মন, আর কেন পথে পথে কাঁদি ?
জ্বলে ওঠ্ এইবার মহাকাল-ভৈরবের নেত্রজ্বালাসম ধক্--ধক্,
হাহাকার-করতালি বাজা ! জ্বালা তোর বিদ্রোহের রক্তশিখা
.                                         অনন্তের পাবক !
.        আন্  তোর বহ্নি-রথ, বাজা তোর সর্বনাশা তূরী !
.        হান্ তোর পরশু-ত্রিশূল !  ধ্বংস কর্ এই মিথ্যাপুরী !
.        রক্ত-সুধা বিষ আন্ মরণের ধর্ টিপে টুঁটি !
এ মিথ্যা জগৎ তোর অভিশপ্ত জগদ্দল চাপে হোক্ কুটি--কুটি !

***                ***                ***                ***                ***



.                কন্ঠে আজ এত বিষ এত জ্বালা,
.                         তবু, বালা !
.                       থেকে থেকে মনে পড়ে-----
.                যতদিন বাসিনি তোমারে আমি ভালো,
.        যতদিন দেখিনি তোমার বুক-ঢাকা রাগ-রাঙা আলো,
.                        তুমি ততদিন
.        যেচেছিলে প্রেম মোর, ততদিনই ছিলে ভিখারিণী |
.        ততদিনই এতটুকু অনাদরে বিদ্রোহের তিক্ত অভিমানে
.        তব চোখে উছলাতো জল,  ব্যথা দিত তব কাঁচা প্রাণে !
.                        একটু আদর-কণা একটুকু সোহাগের লাগি,
.        কত নিশি-দিন তুমি,  মনে কর,  মোর পাশে রহিয়াছ জাগি,
.                        আমি চেয়ে দেখি নাই |  তারই প্রতিশোধ’
.                        নিলে বুঝি এতদিনে ! মিথ্যা দিয়ে মোরে জিনে
.                        অপমান ফাঁকি দিয়ে করিতেছ মোর শ্বাস-রোধ !
.                                   আজ আমি মরণের বুক থেকে কাঁদি-----
.        অকরুণা !    প্রাণ নিয়ে এ কি মিথ্যা অকরুণ খেলা !
.                        এত ভালোবেসে শেষে এত অবহেলা
.                        কেমনে হানিতে পার নারী !
.                        এ আঘাত পুরুষের,
.        হানিতে এ নির্মম আঘাত, জানিতাম, মোরা শুধু পুরুষেরা পারি |
.                           ভাবিতাম, দাগহীন অকলঙ্ক কুমারীর দান
.        একটি নিমেষ মাঝে চিরতরে আপনারে রিক্ত করি’ দিয়া মন প্রাণ
.                                                    লভে অবসান |


.                        ভুল, তাহা ভুল !
.        বায়ু শুধু ফোটায় কলিকা, অলি এসে হরে নেয় ফুল !
.                          বায়ু বলী, তার তরে প্রেম নহে প্রিয়া !
.        অলি শুধু জানে ভালো কেমনে দলিতে হয় ফুল-কলি-হিয়া !

***                ***                ***                ***                ***


.                পথিক দক্ষিণা বায়ু আমি চলিলাম বসন্তের শেষে
.                        মৃত্যুহীন চিররাত্রি নাহি-জানা দেশে !
.                বিদায়ের বেলা মোর ক্ষণে ক্ষণে ওঠে বুকে আনন্দাশ্রু ভরি’
.                        কত সুখী আমি আজ সেই কথা স্মরি’ !
.        আমি না বাসিতে ভালো তুমি আগে বেসেছিলে ভালো,
.                        কুমারীর-বুকের তব সব স্নিগ্ধ রাগ-রাঙা আলো
.                        প্রথম পড়িয়াছিল মোর বুকে মুখে----
.        ভুখারীর ভাঙা বুকে পুলকের রাঙা বান ডেকে যায় আজ সেই সুখে !
.                        সেই প্রীতি, সেই রাঙা সুখ-স্মৃতি-স্মরি’
.        মনে হয় এ জীবন এ জনম ধন্য হ’ল ----  আমি আজ তৃপ্ত হয়ে মরি !
.                না-চাহিতে বেসেছিলে ভালো মোরে তুমি-----শুধু তুমি,
.                        সেই  সুখে মৃত্যু-কৃষ্ণ অধর ভরিয়া
.                আজ আমি শতবার ক’রে তব প্রিয় নাম চুমি !


****                        ****                ****                ****


.                মোরে মনে প’ড়ে
.                একদা নিশীথে যদি প্রিয়
.        ঘুমায়ে কাহারও বুকে অকারণ বুক ব্যথা করে-----
.                মনে ক’রো মরিয়াছে, গিয়াছে আপদ !
.                আর কভু আসিবে না
.        উগ্রসুখে কেহ তব চুমিতে ও  পদ-কোকনদ !
.        মরিযাছে---- অশান্ত অতৃপ্ত চির-স্বার্থপর লোভী----
.                অমর  হইয়া আছে----রবে চিরদিন,
.                        তব প্রেমে মৃতুঞ্জয়ী
.                                ব্যথা-বিষে নীলকন্ঠ কবি !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
দোলন-চাঁপা , কাজী নজরুল ইসলাম

পথহারা     



বেলা-শেষে  উদাস পথিক ভাবে
সে যেন কোন অনেক দূরে যাবে-----
.              উদাস পথিক ভাবে |


‘ঘরে এস’ সন্ধ্যা সবার ডাকে,
‘নয় তোরে নয়’ বলে একা তাকে ;
পথের পথিক পথেই ব’সে থাকে,
জানেনা সে ----কে তাহারে চাবে |
.              উদাস পথিক ভাবে |


বনের ছায়া গভীর ভালোবেসে
আঁধার মাথায় দিগ্ বধূদের কেশে,
ডাক্ তে বুঝি শ্যামল মেঘের দেশে
শৈলমূলে শৈলবালা নাবে----
.                  উদাস পথিক ভাবে |


বাতি আনে রাতি আনার প্রীতি,
বধূর বুকে গোপন সুখের ভীতি,
বিজন ঘরে এখন সে গায় গীতি,
একলা থাকার গানখানি সে গাবে-----
.             উদাস পথিক ভাবে |


হঠাৎ তাহার পথের রেখা হারায়
গহন ধাঁধার আঁধার বাঁধা কারায়,
পথ-চাওয়া তার কাঁদে তারায় তারায়,
আর কি পূবের পথের দেখা পাবে------
.                  উদাস পথিক ভাবে |

.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
দোলন-চাঁপা , কাজী নজরুল ইসলাম

অবেলার ডাক      


অনেক ক’রে বাস্ তে ভালো পারি নি মা তখন যারে,
আজ অবেলায় তারেই মনে প’ড়ছে কেন বারে বারে ||


আজ মনে হয় রোজ রাতে সে ঘুম পাড়াত নয়ন চু’মে,
চুমুর পর চুম দিয়ে ফের হানত আঘাত ভোরের ঘুমে |
.              ভাব্ তুম্ তখন এ কোন বালাই !
.              ক’র্ ত এ প্রাণ পালাই পালাই !
আজ সে কথা মনে হ’য়ে ভাসি অঝোর নয়ন-ঝারে !
অভাগিনীর সে গরব আজ ধূলায় লুটায় বাথার ভারে||


তরুণ তাহার ভরাট বুকের উপ্ চে’--পড়া আদর সোহাগ
হেলায় দু’পায়ে দ’লেছি মা, আজ কেন হায় তায় অনুরাগ ?
.             এই চরণ সে বক্ষে চেপে
.             চুমেছে, আর দুচোখ ছেপে
জল ঝ’রেছে, তখনো মা কই নি কথা অহঙ্কারে,
এম্ নি দারুণ হতাদরে ক’রেছি মা বিদায় তারে||
দেখেও ছিলাম বুক-ভরা তার অনাদরের আঘাত-কাঁটা
দ্বার হ’তে সে গেছে দ্বারে খেয়ে সবার লাথি-ঝাঁটা |
.             ভেবেছিল আমার কাছে,
.             তার দরদের শান্তি আছে,
আমিও গো মা ফিরিয়ে দিলাম চিনতে নেরে দেবতারে |
ভিক্ষুবেশে এসেছিল রাজাধিরাজ দাসীর দ্বারে ||
পথ ভুলে সে এসেছিল সে মোর সাধের রাজ-ভিখারী,
মাগো আমি ভিখারিণী, আমি কি তায় চিন্ তে পারি ?
.               তাই মাগো তাঁর পূজার ডালা
.             নিই নি, নিই নি মণির মালা,
দেব্ তা-আমার নিজে আমায় পূজ্ ল ষোড়শ-উপচারে !
পূজারীকে চিনলাম না মা পূজা-ধূমের অন্ধকারে ||


আমার চাওয়াই শেষ-চাওয়া তাঁর মাগো আমি তা কি জানি !
ধরায় শুধু রইল ধরা রাজ-অতিথির বিদায়-বাণী !
.                 ওরে আমার ভালোবাসা !
.              কোথায় বেঁধেছিলি বাসা
যখন আমার রাজা এসে দাঁড়িয়েছিল এই দুয়ারে ?
নিঃশ্বসিয়া উঠ্ ছে ধরা, ‘নেই রে সে নেই, খুঁজিস কারে !’



সে যে পথের চির-পথিক, তার কি সহে ঘরের মায়া ?
দূর হ’তে মা দূরান্তরে ডাকে তাকে পথের ছায়া |
.              মাঠের পারে বনের মাঝে
.              চপল তাহার নুপূর বাজে,
ফুলের সাথে ফুটে বেড়ায়, মেঘের সাথে যায় পাহাড়ে,
ধরা দিয়েও দেয় না ধরা জানি না সে চায় কাহারে |


মাগো আমার শক্তি কোথায় পথ-পাগলে ধ’রে রাখার ?
তার তরে নয় ভালোবাসা, সন্ধ্যা-প্রদীপ ঘরে ডাকার |
.              তাই মা আমার বুকের কবাট
.              খুল্ তে নারল তার করাঘাত,
এ মন তখন কেমন যেন বাস্ তে ভালো আর কাহারে,
আমিই দূরে ঠেলে দিলাম অভিমানী ঘর-হারারে |


সোহাগে সে ধর্ তে যেত নিবিড় ক’রে বক্ষে চেপে,
হতভাগী পালিয়ে যেতাম ভয়ে এ বুক উঠ্ ত কেঁপে |
.              রাজ-ভিখারীর আঁখির কালো,
.              দূরে থেকেই লাগ্ ত ভালো,
আস্ লে কাছে ক্ষুদিত তার দীঘল চাওয়ার অশ্রু-ভারে |
ব্যথায়  কেমন মুস্ ড়ে যেতাম, সুর হারাতাম মনের তারে ||


আজ কেন মা তারই মতন আমারো এই বুকের ক্ষুধা
চায় শুধু সেই হেলায় হারা আদর-সোহাগ-পরশ-সুধা,
.              আজ মনে হয় তাঁর সে বুকে
.              এ মুখ চেপে নিবিড় সুখে
গভীর দুখের কাঁদন কেঁদে শেষ ক’রে দিই এই আমারে !
যায় না কি মা আমার কাঁদন তাঁহার দেশের কানন-পারে ?


আজ বুঝেছি এ জনমের আমার নিখিল শান্তি আরাম
চুরি ক’রে পালিয়ে গেছে চোরের রাজা সেই প্রাণারাম !
.                  হে বসন্তের রাজা আমার !
.                নাও এসে মোর হার-মানা-হার !
আজ যে আমার বুক ফেটে যায় আর্তনাদের হাহাকারে,
দেখে যাও আজ সেই পাষাণী কেমন ক’রে কাঁদ্ তে পারে |



তোমার কথাই সত্য হ’ল পাষাণ ফেটেও রক্ত বহে,
দাবানলের দারুণ দাহ তুষার-গিরি আজ্ কে দহে |
.               জাগ্ ল বুকে ভীষণ জোয়ার,
.               ভাঙ্ ল আগল ভাঙ্ ল দুয়ার,
মূকের বুকে দেবতা এলেন মুখর মুখে ভীম পাথারে |
বুক ফেটেছে মুখ ফুটেছে ----মাগো মানা ক’রছ কারে ?


স্বর্গ আমার গেছে পুড়ে তাঁরই চলে যাওয়ার সাথে,
এখন আমার একার বাসর দোসরহীন এই দুঃখ-রাতে !
.               ঘুম ভাঙাতে আস্ বে না সে
.                ভোর না হ’তেই শিয়র-পাশে,
আস্ বে না ফিরে গভীর রাতে চুমু-চুরির অভিসারে,
কাঁদ্ বে ফিরে তাঁহার সাথী ঝড়ের রাতি বনের পারে |
আজ পেলে তাঁয় হুমড়ি খেয়ে পড়তুম মা গো যুগল পদে
বুকে ধ’রে পদ-কোকনদ স্নান করাতাম আঁখির হ্রদে |
.               ব’স্ তে দিতাম আধেক আঁচল,
.               সজল চোখের চোখ-ভরা জল
ভেজা কাজল মুছতাম তার চোখে মুখে অধর-ধারে,
আকুল কেশে পা মুছাতাম বেঁধে বাহুর কারাগারে |


দেখ্ তে মাগো তখন তোমার রাক্ষুসী এই সর্বনাশী,
মুখ থুয়ে তাঁর উদার বুকে ব’লত, ‘আমি ভালোবাসি !’
.               ব’ল্ তে গিয়ে সুখ-শরমে
.               লাল হ’য়ে গাল উঠ্ ত ঘেমে,
বুক হ’তে মুখ আস্ ত নেমে লুটিয়ে কখন্ কোল্--কিনারে,
দেখ্ তুম মা গো তখন কেমন মান ক’রে সে থাক্ তে পারে |



এম্ নি এখন কতই আশা ভালোবাসার তৃষ্ণা জাগে
তাঁর ওপর মা অভিমানে, ব্যথায়, রাগে, অনুরাগে !
.              চোখের জলের ঋণী ক’রে
.              সে গেছে কোন্ দ্বীপান্তরে ?
সে বুঝি মা সাত সমুদ্দুর তের নদীর  সুদূর পারে ?
ঝড়ের হাওয়া সেও বুঝি মা সে দূর-দেশে যেতে নারে ?



তারে আমি ভালোবাসি সে যদি তা পায় মা খবর,
চৌচির হয়ে পড়্ বে ফেটে আনন্দে মা তাহার কবর |
.              চীত্কারে তার উঠ্ বে কেঁপে
.              ধরার সাগর--অশ্রু ছেপে,
উঠ্ বে ক্ষেপে অগ্নি-গিরি সেই পাগলের হুহুঙ্কারে,
ভূধর সাগর আকাশ বাতাস ঘূর্ণী নেচে ঘিরবে তারে |



ছি, মা ! তুমি ডুক্ রে কেন উঠ্ ছ কেঁদে অমন ক’রে ?
তার চেয়ে মা তাঁরই কোনো শোনা-কথা শুনাও মোরে !
.              শুন্ তে শুন্ তে তোমার কোলে
.              ঘুমিয়ে পড়ি |  ও  কে খোলে
দুয়ার ও মা ? ঝড় বুঝি মা তাঁরই মতো ধাক্কা মারে ?
ঝোড়ো হাওয়া !  ঝোড়ো হাওয়া !  বন্ধু তোমার সাগর-পারে !


সে কি হেথায় আস্ তে পারে আমি যেথায় আছি বেঁচে,
যে দেশে নাই আমার ছায়া এবার সে সেই দেশে গেছে !
.               তবু কেন থাকি থাকি
.               ইচ্ছা করে তারেই ডাকি !
যে কথা মোর রইল বাকি হায় সে কথা শুনাই কারে !
মা গো আমার প্রাণের কাঁদন্ আছ্ ড়ে মরে বুকের দ্বারে !



যাই তবে মা !  দেখা হ’লে আমার কথা ব’লো তারে
রাজার পূজা -----সে কি কভু ভিখারিণী ঠেল্ তে পারে ?
.                মা গো আমি জানি জানি
.                আসবে আমার আভিমানী
খুঁজ্ তে আমার গভীর রাতে এই আমাদের কুটীর-দ্বারে,
ব’লো তখন, খুঁজতে তারেই হারিয়ে গেছি অন্ধকারে !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
দোলন-চাঁপা , কাজী নজরুল ইসলাম

অভিশাপ       


যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে |
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-----
.                    বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে !
.                ছবি আমার বুকে বেঁধে
.                পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে
.                ফির্ বে মরু কানন গিরি
.                সাগর আকাশ বাতাস চিরি’
.                      যেদিন আমায় খুঁজ্ বে-----
.                           বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে !


স্বপন ভেঙে নিশুত’ রাতে জাগ্ বে হঠাৎ চম্ কে’,-----
কাহার যেন চেনা-ছোঁয়ায় উঠ্ বে ও- বুক ছম্ কে’,----
.                     জাগ্ বে হঠাৎ চম্ কে’ !
.                ভাব্ বে বুঝি আমিই এসে
.                বস্ নু বুকের কোল্ টি ঘেঁষে,
.                ধরতে গিয়ে দেখবে যখন ------
.                শূন্য শয্যা !     মিথ্যা স্বপন !
.                      বেদ্ নাতে চোক বুজ্ বে-----
.                            বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে !


গাইতে ব’সে কন্ঠ ছিঁড়ে আস্ বে যখন কান্না,
বল্ বে সবাই-----“ সেই যে পথিক, তার শেখানো গান না ?”
.                    আস্ বে ভেঙে কান্না !
.                পড়্ বে মনে আমার সোহাগ,
.                কন্ঠে তোমার কাঁদ্ বে বেহাগ !
.                প’ড়বে মনে অনেক ফাঁকি,
.                অশ্রু-হারা -কঠিন আঁখি,
.                      ঘন ঘন  মুছ্ বে
.                        বুঝ্ বে সেদিন বুঝবে !


আবার যেদিন শিউলি ফু’টে ভর্ বে তোমার অঙ্গন,
তুল্ তে সে-ফুল গাঁথ্ তে মালা কাঁপ্ বে তোমার কঙ্কণ----
.                    কাঁদ্ তে কুটীর-অঙ্গন !
.                শিউলি-ঢাকা মোর সমাধি
.                পড়্ বে মনে উঠ্ বে কাঁদি’ |
.                বুকের মালা করবে জ্বালা
.                চোখের জলে সেদিন বালা
.                        মুখের হাসি ঘুচ্ বে
.                            বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে !


আস্ বে আবার আশিন-হাওয়া, শিশির ছেঁচা রাত্রি,
থাক্ বে সবাই----থাকবে না এই মরণ-পথের যাত্রীই !
.                   আস্ বে শিশির-রাত্রি !
.                থাক্ বে পাশে বন্ধু স্বজন,
.                থাক্ বে রাতে বাহুর বাঁধন,
.                বঁধুর বুকের পরশনে
.                আমার পরশ আনবে মনে----
.                      বিষিয়ে ও-বুক উঠ্ বে----
.                        বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে !



আস্ বে আবার শীতের রাতি, আস্ বে নাক’ আর সে-----
তোমার সুখে  পড়্ ত বাধা থাক্ লে যে-জন পার্শ্বে,
                  আস্ বে নাক’  আর সে !
.                প’ড়্ বে মনে, মোর বাহুতে
.                মাথা থুয়ে যেদিন শুতে,
.                মুখ ফিরিয়ে থাক্ তে ঘৃণায় !
.                সেই স্মৃতি নিত্ ঐ বিছানায়
.                       কাঁটা হ’য়ে ফুট্ বে----
.                          বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে !



আবার গাঙে আস্ বে জোয়ার, দুলবে তরী রঙ্গে,
সেই তরীতে হয়তো কেহ থাক্ বে তোমার সঙ্গে----
.                     দুল্ বে তরী রঙ্গে !
.                প’ড়্ বে মনে, সে কোন্ রাতে
.                এক তরীতে ছিলে সাথে,
.                এম্ নি গাঙে ছিল জোয়ার,
.                নদীর দু’ধার এম্ নি আঁধার,
.                       তেমনি তরী ছুট্ বে------
.                           বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে !



তোমার সখার আস্ বে যেদিন এম্ নি কারা-বন্ধ,
আমার মতন কেঁদে কেঁদে হয়তো হবে অন্ধ-----
.                        সখার কারা-বন্ধ !
.                বন্ধু তোমার হান্ বে হেলা,
.                ভাঙ্ বে তোমার সুখের মেলা ;
.                দীর্ঘ বেলা কাট্ বে না আর,
.                বইতে প্রাণের শ্রান্ত এ ভার
.                       মরণ-সনে যুঝ্ বে------
.                           বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে !


ফুট্ বে আবার দোলন-চাঁপা চৈতি-রাতের চাঁদ্ নী,
আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় বাজ্ বে আমার কাঁদনী----
.                    চৈতি-রাতের চাঁদ্ নী !
.                ঋতুর পরে ফিরবে ঋতু,
.                সেদিন ----হে মোর সোহাগ-ভীতু !
.                চাইবে কেঁদে নীল নভো গা’য়,
.                আমার মতন চোখ ভ’রে চায়
.                        যে তারা তা’য় খুঁজ্ বে----
.                            বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে !



আস্ বে ঝড়ি, নাচবে তুফান, টুট্ বে সকল বন্ধন,
কাঁপ্ বে কুটীর সেদিন ত্রাসে, জাগ্ বে বুকে ক্রন্দন----
.                   টুট্ বে যবে বন্ধন !
.                পড়বে মনে, নেই সে সাথে
.                বাঁধ্’তে বুকে দুঃখ-রাতে ----
.                আপ্ নি গালে যাচ্ বে চুমা,
.                চাইবে আদর, মাগ্ বে ছোঁওয়া,
.                       আপ্ নি যেচে চুম্ বে-----
.                          বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে !



আমার বুকের যে কাঁটা-ঘা তোমার ব্যথা হান্ ত,
সেই আঘাতই যাচ্ বে আবার হয়তো হ’য়ে শ্রান্ত------
.                     আস্ ব তখন পান্থ !
.                হয়তো তখন আমার কোলে,
.                সোহাগ-লোভে পড়বে ঢ’লে
.                আপনি সেদিন সেধে কেঁদে
.                চাপবে বুকে বাহু বেঁধে,
.                      চরণ চু’মে পূজবে-----
.                           বুঝ্ বে সেদিন বুঝ্ বে !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
দোলন-চাঁপা , কাজী নজরুল ইসলাম

পিছু--ডাক



সখি !        নতুন ঘরে গিয়ে আমায় প’ড়বে কি আর মনে ?
.        সেথায় তোমার নতুন পূজা নতুন আয়োজনে ||
            প্রথম দেখা তোমায় আমার
.                যে গৃহ-ছায় যে আঙিনায়,
.                যেথায় প্রতি ধূলি কণায়
.                        লতাপাতার সনে,
.        নিত্য চেনার বিত্ত রাজে চিত্ত-আরাধনে,
.        পুণ্য সে ঘর শূন্য এখন কাঁদ্ ছে নিরজনে ||



সেথা        তুমি যখন ভুলতে আমায়, আস্ ত  অনেক কেহ,
তখন        আমার হ’য়ে অভিমানে কাঁদ্ ত যে ঐ গেহ !
.                যেদিক পানে চাইতে সেথা
.                বাজত আমার স্মৃতির ব্যথা,
.                সে গ্লানি আজ ভুল্ বে হেথা
.                        নতুন আলাপনে !
            আমিই শুধু হারিয়ে গেলেম হারিয়ে-যাওয়ার বনে ||


আমার        এতদিনের দূর ছিল না সত্যিকারের দূর,
ওগো        আমার সুদূর ক’রত নিকট ঐ পুরাতন পুর !
.                এখন তেমার নতুন বাঁধন,
.                নতুন হাসি, নতুন কাঁদন,
.                নতুন সাধন,  গানের মাতন
.                        নতুন আবাহনে !
.        আমারই সুর হারিয়ে গেল সুদূর পুরাতনে ||


সখি !        আমার আশাই দুরাশা আজ, তোমার বিধির বর,
আজ!          মোর সমাধির বুকে তোমার উঠবে বাসর ঘর |
.                শূন্য ভ’রে শুন্ তে পেনু
.                ধেনু-চরা বনের বেণু------
.                হারিয়ে গেনু হারিয়ে গেনু
.                        অস্ত-দিগঙ্গনে !
.        বিদায় সখি, খেলা-শেষ এই বেলা-শেষের খনে |
.        এখন তুমি নতুন মানুষ নতুন গৃহ-কোণে ||


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
দোলন-চাঁপা , কাজী নজরুল ইসলাম

কবি-রাণী       


তুমি আমায়  ভালোবাস তাই তো আমি কবি |
আমার এ রূপ,---সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি ||
.        আপন জেনে হাত বাড়ালো
.        আকাশ বাতাস প্রভাত-আলো,
.        বিদায়-বেলার সন্ধ্যা-তারা
.                পূবের অরুণ রবি-----
তুমি ভালোবাস ব’লে  ভালোবাসে সবি ||


আমার আমি লুকিয়ে ছিল থোমার ভালোবাসায়,
আমার আশা বাইরে এলো তোমার হঠাৎ আসায় ||
.        তিমিই আমার মাঝে আসি
.        অসিতে মোর বাজাও বাঁশি
.        আমার পূজার যা আয়োজন
.                  তোমার প্রাণের হবি |
আমার বাণী জয়মাল্য, রাণি !  তোমার সবি ||


তুমি আমার ভালোবাস তাই তো আমি কবি |
আমার এ রূপ-----সে যে তোমার ভালবাসার ছবি ||


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
দোলন-চাঁপা , কাজী নজরুল ইসলাম

পউষ      


পউষ এলো গো !
.        পউষ এলো অশ্রু-পাথার হিম-পারাবার পারায়ে |
ঐ যে এলো গো-----
.        কুঙ্ঝটিকার ঘোম্ টা-পরা দিগন্তরে দাঁড়ায়ে ||
.        সে এলো আর পাতায় পাতায় হায়
.        বিদায়-ব্যথা যায় গো কেঁদে যায়,
.        অস্ত-বধূ ( আ---হা ) মলিন চোখে চায়
.        পথ-চাওয়া দীপ সন্ধ্যা-তারায় হারায়ে ||



পউষ এলো গো----
.        এক বছরের শ্রান্তি পথের, কালের আয়ু-ক্ষয়,
.        পাকা ধানের বিদায়-ঋতু, নতুন আসার ভয়
পউষ এলো গো !                          পউষ এলো-------
.        শুক্ নো নিশাস্, কাঁদন-ভারাতুর
.        বিদায়-ক্ষণের  ( আ-----হা ) ভাঙা গলার সুর------
.        ‘ওঠ পথিক !           যাবে অনেক দূর
.        কালো চোখের করুণ চাওয়া ছড়ায়ে || ‘


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর