বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর "সর্বহারা"
থেকে কয়েকটি কবিতা
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

কান্ডারী হুশিয়ার    


কোরাস :----
.         দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
.         লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার !


দুলিতেছে তরী ফুলিতেছে জল,  ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ ?
কে আছ জোয়ান  হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ |
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার ||


তিমির রাত্রি মাতৃমন্ত্রী  সান্ত্রীরা সাবধান !
যুগযুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান |
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে দিতে হবে অধিকার ||


অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ,
কান্ডারী ! আজি দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি-পণ !
“হিন্দু না ওরা মুসলিম ?”  ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন ?
কান্ডারী ! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র !


গিরি-সঙ্কট, ভীরু যাত্রীরা,  গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাত-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ !
কান্ডারী !  তুমি ভুলিবে কি পথ ? ত্যজিবে কি পথ মাঝ ?
করে হানাহানি, তবু চল টানি’ নিয়াছ যে মহাভার !


কান্ডারী ! তব সন্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর !
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর !
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার !




ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান ?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

.                ছাত্রদলের গান    

.                আমরা শক্তি আমরা বল
.                        আমরা ছাত্রদল |
মোদের         পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান
.                        ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল |
.                                আমরা ছাত্রদল ||


মোদের         আঁধার রাতে বাধার পথে
.                        যাত্রা নাঙ্গা পায়,
আমরা                শক্ত মাটী রক্তে রাঙাই
.                        বিষম চলার ঘাস |
.                যুগে যুগে রক্তে মোদের
.                        সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল |
.                                 আমরা ছাত্রদল ||


মোদের         কক্ষচ্যুত-ধূমকেতু-- প্রায়
.                         লক্ষ্যহারা প্রাণ
আমরা                ভাগ্যদেবীর  যজ্ঞবেদীর
.                        নিত্য বলিদান |
যখন                লক্ষ্মীদেবী  স্বর্গে উঠেন
.                        আমরা পশি নীল অতল !
.                                   আমরা ছাত্রদল ||


আমরা                 ধরি মৃত্যু রাজার
.                        যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ,
মোদের         মৃত্যু লেখে মোদের
.                        জীবন--ইতিহাস !
            হাসির দেশে আমরা আনি
.                        সর্বনাশী চোখের জল
.                               আমরা ছাত্রদল ||


.                সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়
.                        আমরা করি ভুল !
.                সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব,
.                        আমরা ভাঙি কূল |
.                দারুণ-রাতে আমরা তরুণ
.                        রক্তে করি পথ পিছল !
.                                   আমরা ছাত্রদল ||        


মোদের                চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল,
.                        বক্ষে ভরা বাক্,
.                কন্ঠে মোদের কুন্ঠাবিহীন
.                        নিত্য কালের ডাক |
আমরা                তাজা খুনে লাল ক’রেছি
.                        সরস্বতীর শ্বেত কমল |
.                                    আমরা ছাত্রদল ||        


ঐ                দারুণ উপপ্লবের দিনে
.                        আমরা দানি শির,
.                মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে
.                        বিংশ শতাব্দীর !
মোরা                গৌরবেরি কান্না দিয়ে
.                        ভ’রেছি মা’র শ্যাম-আঁচল |
.                                আমরা ছাত্রদল ||


.                আমরা রচি ভালোবাসার
.                        আশার ভবিষ্যৎ,
মোদের                স্বর্গ-পথের অভাস দেখায়
.                        আকাশ-ছায়াপথ !
.                মোদের চোখে বিশ্ববাসীর
.                        স্বপ্ন দেখা হোক সফল |
.                                আমরা ছাত্রদল ||


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

মা ( বিরজাসুন্দরী দেবী )--র
                    শ্রীচরণাবিন্দে-----


সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার !
তুমি কোনোদিন কারো করনি বিচার,
কারেও দাওনি দোষ ! ব্যথা--বারিধির
কূলে ব’সে কাঁদ মৌনা কন্যা ধরণীর
একাকিনী ! যেন কোন্ পথ-ভু’লে আসা
ভিন্-গা’র ভীরু মেয়ে ! কেবলি জিজ্ঞাসা
করিতেছ আপনারে, ‘এ আমি কোথায় ?’---
দূর হ’তে তারকারা ডাকে, ‘আয় আয়’ !
তুমি যেন তাহাদের পলাতকা মেয়ে
ভুলিয়া এসেছ হেথা ছায়া-পথ বেয়ে !
বিধি ও অবিধি মিলে মেরেছে তোমায়
---মা আমার---কত যেন ! চোখে মুখে হায়
তবু যেন শুধু এক ব্যথিত জিজ্ঞাসা,----
‘কেন মারে! এরা কা’রা ? কোথা হ’তে আসা
এই দুঃখ ব্যথা শোক ?’----এরা তো তোমার
নহে পরিচিত মাগো, কন্যা অলকার !
তাই সব স’য়ে যাও নির্বাক নিশ্চুপ,
ধূপেরে পোড়ায় অগ্নি -----জানেনা তা ধূপ !-----

দূর-দূরান্ত হ’তে আসে ছেলে মেয়ে,
ভু’লে যায় খেলা তারা তব মুখে  চেয়ে !
বলে, ‘তুমি  মা হবে আমার ?’ ভেবে কী যে !
তুমি বুকে চেপে ধর, চক্ষু,  ওঠে ভিজে
জননীর করুণায় ! মনে হয় যেন
সকলের চেনা তুমি সকলেরে চেন !
তোমারি দেশের যেন ওরা ঘর-ছাড়া
বেড়াতে এসেছে এই ধরণীর পাড়া
প্রবাসী শিশুর দল ! যাবে ওরা চ’লে
গলা ধ’রে দুটি কথা ‘মা আমার’ ব’লে !---

হয়ত ভুলেছ মাগো, কোনো একদিন
এমনি চলিতে পথে মরু-বেদুইন-
শিশু এক এসেছিল | শ্রান্ত কন্ঠে তার
ব’লেছিল গলা ধ’রে ----‘মা হবে আমার?’
হয়ত আসিয়াছিল, যদি পড়ে মনে,
অথবা সে আসে নাই----না এলে স্মরণে
যে-দুরন্ত গেছে চ’লে আসিবেনা আর,
হয়ত তোমার বুকে গোরস্থান তার
জাগিতেছে আজো মৌন, অথবা সে নাই !
এমন ত কত পাই----- কত সে হারাই !---

সর্বসহা কন্যা মোর !  সর্বহারা মাতা !
শূন্য নাহি রহে কভু মাতা ও বিধাতা !

হারা-বুকে আজ তব ফিরিয়াছে যারা-----
হয়ত তাদেরি স্মৃতি এই ‘সর্বহারা’ !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

.        সর্বহারা

ব্যথার সাঁতার-পানি-ঘেরা
.        চোরাবালির চর,
ওরে পাগল ! কে বেঁধেছিস্
.        সেই চরে তোর ঘর ?
শূন্যে তড়িৎ দেয় ইসারা
হাট তুলে দে সর্বহারা
মেঘ জননীর অশ্রুধারা
.        ঝর্ ছে মাথার’ পর,
দাঁড়িয়ে দূরে ডাক্ ছে মাটী
.        দুলিয়ে তরু-কর  |

কন্যারা তোর বন্যাধারায়
.        কাঁদ্ ছে উতরোল,
ডাক দিয়েছে তাদের আজি
.        সাগর-মায়ের কোল !
নায়ের মাঝি !  নায়ের মাঝি !
পাল তু’লে তুই দে রে আজি |
তুরঙ্গ ঐ তুফান-তাজী
.        তরঙ্গে খায় দোল |
নায়ের মাঝি ! আর কেন ভাই ?
.        মায়ার নোঙর তোল !

ভাঙন-ভরা আঙনে তোর
.        যায় রে বেলা যায় |
মাঝি রে ! দেখ্ কুরুঙ্গী তোর
.        কূলের পানে চায় |
যায় চ’লে ঐ সাথের সাথী,
ঘনায় গহন শাঙন-রাতি,
মাদুর-ভরা কাঁদন পাতি
.        ঘুমুস্ নে আর হায় !
ঐ কাঁদনের বাঁধন ছেঁড়া
.        এতই কি রে দায় ?

হীরা মাণিক চাস্ নিক’ তুই,
.        চাস্ নি ত সাত ক্রোর,
একটি ক্ষুদ্র মৃত্পাত্র-----
.        ভরা অভাব তোর,
চাইলি রে ঘুম শ্রান্তিহরা
একটি ছিন্ন মাদুর ভরা,
একটি প্রদীপ-আলো-করা
.        একটু কুটীর-দোর !
আস্ ল মৃত্যু আস্ ল জরা,
.        আসল সিঁদেল-চোর !

মাঝিরে তোর নাও ভাসিয়ে
.         মাটীর বুকে চল্
শক্ত মাটীর ঘায়ে হউক
.         রক্ত পদতল |
প্রলয়-পথিক চল্ বি ফিরি
দ’ল্ বি পাহাড় কানন গিরি !
হাঁক্ ছে বাদল,  ঘিরি ঘিরি,
.          নাচ্ ছে সিন্ধুজল |
চল্ রে জলের যাত্রী এবার
.           মাটীর বুকে চল্ ||


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

.                সাম্যবাদী

.                                গাহি সাম্যের গান----
যেখানে আসিয়া এক হ’য়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান |
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ মুসলিম-ক্রীশ্চান |
.                                গাহি সাম্যের গান !
কে তুমি ? পার্সী ? জৈন ? ইহুদী ?  সাঁওতাল, ভীল গারো ?
কন্ ফুসিয়াস্ ? চার্বাক-চেলা ?  ব’লে যাও, বল আরো !
.                                বন্ধু, যা খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরাণ-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও যত সখ,----
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল ?
দোকানে কেন এ দর-কশাকশি ? ---পথে ফুটে তাজা ফুল |
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে’ দেখ নিজ প্রাণ !
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকলের দেবতার |
কেন খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি-কঙ্কালে ?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে |
.                                বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইকানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট |
এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈশা মুসা পেল সত্যের পরিচয় !
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা |
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’ |
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান !
.                              মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

.                        ঈশ্বর

কে তুমি খুঁজিছ জগদীশে ভাই আকাশ পাতাল জু’ড়ে
কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে,  কে তুমি পাহাড়-চূড়ে ?
.                                হায় ঋষি দরবেশ,
বুকের মানিকে বুকে ধ’রে তুমি খোঁজ তাঁরে দেশ-দেশ |
সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজো-----আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে !
ইচ্ছা-অন্ধ ! আঁখি খোলো, দেখ দর্পণে নিজ কায়া,
দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে প’ড়েছে তাঁহার ছায়া |
শিহরি উঠোনা, শাস্ত্রবিদেরে ক’রোনাক বীর, ভয়,----
তাহারা খোদার খোদ্ “প্রাইভেট সেক্রেটারী” ত নয় !
সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি,
আমারে দেখিয়া আমার অ-দেখা জন্মদাতারে চিনি !
রত্ন লইয়া বেচা-কেনা করে বণিক সিন্ধু-কূলে------
রত্নাকরের খবর তা ব’লে পুছোনা ওদের ভু’লে |
.                                      উহারা রত্ন বেনে,
রত্ন চিনিয়া মনে করে ওরা রত্নাকরেও চেনে !
ডুবে নাই তারা অতল গভীর রত্ন-সিন্ধুতলে,
শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও সখা সত্য সিন্ধু জলে |


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

.                মানুষ


.                        গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্ !
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি, !
.                                  ‘পূজারী, দুয়ার খোলো,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে,  পূজার সময় হ’ল |’
স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়,
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ’য়ে যাবে নিশ্চয় !----
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ----
ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোলো বাবা, খাইনিক’ সাত দিন !’
সহসা বন্ধ হ’ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি , পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে !
.                            ভুখারী ফুকারী কয়,
‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয় !’
মস্ জিদে কাল শিরণী আছিল, ---- অঢেল গোস্ত রুটি,
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি |
এমন সময় এলো মুসাফির,  গায়ে আজারির চিন্
বলে, ‘বাবা, আমি ভুখা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন !’
তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা ---‘ভ্যালা হ’ল দেখি লেঠা,
ভুখা আছ, মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে !  নামাজ পড়িস্ বেটা ?’
ভুখারী কহিল, ‘না বাবা |’  মোল্লা হাঁকিল ‘তা হলে শালা,
সোজা পথ দেখ !’ গোস্ত্-রুটি নিয়া মস্ জিদে দিল তালা !
.                                ভুখারী ফিরিয়া চলে,
.                                চলিতে চলিতে বলে----
‘আশীটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা’ বলে বন্ধ করনি প্রভু !
তব মস্ জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী !
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী !’
কোথা চেঙ্গিস্, গজনী মামুদ, কোথায় কালাপাহাড় ?
ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া দ্বার !
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা,
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা !
.                            হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয় !

.                        মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরাণ, বেদ, বাইবেল, চুম্বিছে মরি মরি !
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল ! ------মূর্খরা সব শোনো,
মানু, এনেছে গ্রন্থ ; -------গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো !

আদম দাউদ ঈশা মুশা ইব্রাহিম মোহম্মদ
কষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,----বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে !
আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি তাঁদেরি মতন দেহ,
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ !
হেসো না বন্ধু ! আমার আমি সে কত অতল অসীম,
আমিই কি জানি, কে জানে, কে আছে আমাতে মহামহিম !
হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈশা,
কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার দিশা ?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কহারে মারিছ লাথি ?
হয়ত উহারি বুকে ভগবান জাগিছেন দিবা-রাতি !
অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান্ উচ্চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ দহে,
তবু জগতের যত পবিত্র  গ্রন্থ ভজনালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয় !
হয়ত উহারি ঔরসে ভাই উহারই কুটীর-বাসে
জন্মিছে কেহ---জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে !
যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে
আজিও বিশ্ব দেখেনি,---হয়তো আসিছে সে এরই ঘরে !

ও কে ? চন্ডাল ? চম্ কাও কেন ? নহে ও ঘৃণ্যজীব !
ওই হ’তে পারে হরিশ্চন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব |
আজ চন্ডাল, কাল হ’তে পারে মহাযোগী-সম্রাট,
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী-পাঠ !
রাখাল বলিয়া কারে করো হেলা, ও হেলা কাহারে বাজে
হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে !
.                        চাষা ব’লে করো ঘৃণা !
দে’খো চাষারূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কিনা |
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল
তারাই আনিল অমর বাণী----যা আছে, রবে চিরকাল |
দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিণী,
তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি !
তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে,
দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে ?
.                           সে মার রহিল জমা-----
কে জানে তোমার লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা !
বন্ধু , তোমার বুক-ভরা লোভ, দু’-চোখে স্বার্থ-ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হ’য়েছে কুলি |
মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা-মথিত সুধা,
তাই লুটে তুমি খাবে পশু ? তুমি তা দিয়ে মেটাবে ক্ষুধা ?
তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে
তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোন খানে !
.                               তোমারি কামনা-রাণী,
যুগে যুগে পশু, ফেলেছে তোমার মৃত্যু-বিবরে টানি |


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

.                পাপ   


.                        সাম্যের গান গাই !-----
যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই !
এ পাপ-মুলুকে পাপ করে নি ক’ কে আছে পুরুষ-নারী ?
আমরা ত ছার ; পাপে পঙ্কিল পাপীদের কান্ডারী  !
তেত্রিশ কোটি দেবতার পাপে স্বর্গ সে টলমল,
দেবতার পাপ-পথ দিয়া পশে স্বর্গে অসুর দল !
আদম হইতে শুরু ক’রে এই নজ্ রুল তক্ সবে
কম বেশী ক’রে পাপের ছুরীতে পুণ্যে করেছ জবেহ !
.                         বিশ্ব পাপস্থান-----
অর্ধেক এর ভগবান্, আর অর্ধেক শয়তান !
.                         ধর্মান্ধরা শোনো,
অন্যের পাপ গণিবার আগে নিজেদের পাপ গোণো !
পাপের পঙ্কে পুণ্য-পদ্ম, ফুলে ফুলে হেথা পাপ !
সুন্দর এই ধরা-ভরা শুধু বঞ্চনা অভিশাপ |
এদের এড়াতে না পারিয়া যত অবতার আদি কেহ
পুণ্যে দিলেন আত্মা ও প্রাণ, পাপেরে দিলেন দেহ !
.                             বন্ধু কহিনি মিছে,
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব হ’তে ধ’রে ক্রমে নেমে এস নীচে-----
মানুষের কথা ছেড়ে দাও. যত ধ্যানী মুনি ঋষি যোগী----
আত্মা তাঁদের ত্যাগী তপস্বী, দেহ তাঁহাদের ভোগী !
.                              এ-দুনিয়া পাপশালা,
ধর্ম-গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূন্য পুণ্য-ছালা |
.                              হেথা সবে-সম-পাপী,
আপন পাপের বাট্ খারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি !
জবাবদিহির কেন এত ঘটা যদি দেবতাই হও,
টুপি প’রে টিকি রেখে সদা বল যে তুমি পাপী নও !
পাপী নও যদি কেন এ ভড়ং ট্রেড্ মার্কার ধূম ?
পুলিশী পোষাক পরিয়া হয়েছ পাপের আসামী গুম্ |

.                               বন্ধু, একটা মজার গল্প শোনো,
একদা অপাপ ফেরেশ্ তা সব স্বর্গ-সভায় কোনো
এই আলোচনা করিতে আছিল বিধির নিয়মে দুষি’------
দিন রাত নাই এত পূজা করি, এত করে তাঁরে তুষি’
তবু তিনি যেন খুশী নন্---তাঁর যত স্নেহ দয়া ঝরে
পাপ-আসক্ত কাদা ও মাটির মানুষ জাতিরই’ পরে !
শুনিলেন সব অন্তর্যামী, হাসিয়া সবারে ক’ন,----
‘মলিন ধূলার সন্তান ওরা, বড় দুর্বল মন,
ফুলে ফুলে সেথা ভুলের বেদনা----নয়নে, অধরে শাপ,
চন্দনে সেথা কামনার জ্বালা, চাঁদে চুম্বন-তাপ !
সেথা কামিনীর নয়নে কাজল, শ্রোণীতে চন্দ্রহার,
চরণে লাক্ষা ঠোটে তাম্বুল, দে’খে ম’রে আছে মার !
প্রহরী সেখানে চোখা চোখ নিয়ে সুন্দর শয়তান,
বুকে বুকে সেথা বাঁকা ফুল-ধনু, চোখে চোখে ফুল-বাণ !’
দেবদূত সব বলে. ‘প্রভু মোরা দেখিব কেমন ধরা,
কেমনে সেখানে ফুল ফোটে যার শিয়রে মৃত্যু জরা !’
কহিলেন বিভু----‘তোমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ যে দুইজন
যাক্ পৃথিবীতে, দেখুক কি ঘোর ধরণীর প্রলোভন!’
‘হারুত’ ‘মারুত’ ফেরশ্ তাদের গৌরব রবি-শশী
ধরার ধূলার অংশী হইল মানবের গৃহে পশি’ |-----
কায়ায় কায়ায় মায়া বুলে হেথা ছায়ায় ছায়ায় ফাঁদ,
কমল দীঘিতে সাতশ’ হয়েছে এক আকাশের চাঁদ !
শব্দ গন্ধ বর্ণ হেথায় পেতেছে অরূপ ফাঁসী,
ঘাটে ঘাটে হেথা ঘট ভরা হাসি, মাঠে মাঠে কাঁদে বাঁশী !
দুদিনে আতশী ফেরশ্ তা প্রাণ ভিজিল মাটির রসে,
শফরী চোখের চটুল চাতুরী বুকে দাগ কেটে বসে |
ঘাঘরী ঝলকি’ গাগরী ছলকি’ নাগরী ‘জোহরা’ যায়------
স্বর্গের দূত মজিল সে রূপে, বিকাইল রাঙা পায় !
অধর আনার রসে ডুবে গেল দোজখের মার ভীতি
মাটির সোরাহী মস্তানা হ’ল আঙ্গুরি খুনে তিতি’ !
কোথা ভেসে গেল সংযম বাঁধ, বারণের বেড়া টুটে,
প্রাণ ভ’রে পিয়ে মাটির মদিরা ওষ্ঠ পুষ্প পুটে !
বেহেশ্ তে সব ফেরশ্ তাদের বিধাতা কহেন হাসি----
‘হারুতে মারুতে কি ক’রেছে দেখ ধরণী সর্বনাশী  !’
নয়না এখানে যাদু জানে সখা, এক আঁখি-ইসারায়
লক্ষ যুগের মহা-তপস্যা কোথায় উবিয়া যায় !
.                            সুন্দর বসুমতী
চির যৌবনা দেবতা ইহার শিব নয়----কাম রতি !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

.                বারাঙ্গনা


কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা,  কে দেয় থুতু ও-গায়ে ?
হয়ত তোমার স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে !
নাই হ’লে সতী তবু ত তোমরা মাতা-ভগিণীরই জাতি,
তোমাদেরই ছেলে আমাদেরই মত, তারা আমাদের জ্ঞাতি ;
আমাদেরই কোনো বন্ধু স্বজন আত্মীয় বাবা কাকা
উহাদের পিতা,  উহাদের মুখে মোদেরই চিহ্ন আঁকা !
আমাদেরই মত খ্যাতি যশ-মান তারাও লভিতে পারে,
তাদেরও সাধনা হানা দিতে পারে স্বর্গ-দ্বারে !----
স্বর্গবেশ্যা  ঘৃতাচী-পুত্র হ’ল মহাবীর দ্রোণ,
কুমারীর ছেলে বিশ্ব-পূজ্য কৃষ্ম-দ্বৈপায়ন,
কানীন-পুত্র কর্ণ হইল দানবীর মহারথী,
স্বর্গ হইতে পতিতা গঙ্গা শিবেরে পেলেন পতি,
শান্তনু রাজা নিবেদিল প্রেম পুনঃ সেই গঙ্গায়-----
তাঁদেরি পুত্র অমর ভীষ্ম, কৃষ্ণ প্রণমে যাঁয় !
মুনি হ’ল শুনি সত্যকাম সে জারজ জবালা-শিশু,
বিস্ময়কর জন্ম যাঁহার ---মহাপ্রেমিক সে যীশু !------
কেহ নহে হেথা পাপ-পঙ্কিল, কেহ সে ঘৃণ্য নহে,
ফুটিছে অযুত বিমল কমল কামনা-কালিয় দহে !
.                             শোনো মানুষের বাণী,
জন্মের পর মানব জাতির থাকে না ক’ কোন গ্লানি !
পাপ করিয়াছে বলিয়া কি নাই পুণ্যের অধিকার ?
শত পাপ করি হয়নি ক্ষুণ্ণ দেবত্ব দেবতার !
অহল্যা যদি মুক্তি লভে মা,  মেরী হ’তে পারে দেবী,
তোমারাও কেন হবে না পূজ্যা বিমল সত্য সেবি ?
তব সন্তানে জারজ বলিয়া কোন গোঁড়া পাড়ে গালি ?
তাহাদের আমি এই দুটো কথা জিজ্ঞাসা করি খালি------
.                                দেবতা গো জিজ্ঞাসি------
দেড়শত কোটি সন্তান এই বিশ্বের অধিবাসী-----
কয়জন পিতা-মাতা ইহাদের হ’য়ে নিষ্কাম ব্রতী
পুত্রকন্যা কামনা করিল ? কয়জন সৎ-সতী ?
ক’জন করিল তপস্যা ভাই সন্তান-লাভ তরে ?
কার পাপে কোটি দুধের বাচ্ছা আঁতুড়ে জন্মে মরে ?
সেরেফ্ পশুর ক্ষুধা নিয়ে হেথা মিলে নরনারী যত,
সেই কামনার সন্তান মোরা ! তবুও গর্ব কত !
.                              শুন ধর্মের চাঁই-----
জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই !
অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ পুত্র হয়,
অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়  !

.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

.                নারী


.                                সাম্যের গান গাই-------
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই !
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণ-কর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর |
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী !
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা, করে নারী হেয়-জ্ঞান ?
তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর শয়তান |
অথবা পাপ যে--- -শয়তান যে--- নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে !
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে  রূপ- -রস- -গন্ধ-- সুনির্মল |
তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ ?
অন্তরে তার মোম্ তাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান !
জ্ঞানের লক্ষ্ণী, গানের লক্ষ্ণী, শস্য-লক্ষ্ণী নারী,
সুষমা-লক্ষ্ণী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি |
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ !
দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হয়েছে বধূ,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা ল’য়ে ----নারী যোগায়েছে মধু !
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল পুরুষ চালাল হাল ;
নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল |
নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে |

.                                  স্বর্ণ-রৌপ্যভার
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হ’য়েছে অলঙ্কার !
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার, হইল কবিতা, শব্দ হইল গান |
নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে !
জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান্ |
কোন্ রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে !
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি’, কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা ?
কোনো কালে একা হয় নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়-লক্ষ্ণী নারী !
রাজা করিয়াছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিল রাণী,
রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি !
.                                পুরুষ হৃদয়-হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ |
ধরায় যাঁদের যশ ধরে না ক’ অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উত্সব,
খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা------
লব কুশে বনে ত্যজিয়াছে রাম, পালন করেছে সীতা !
নারী সে শিখাল শিশু-পুরুষের স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,
দীপ্ত নয়নে পরাল কাজল বেদনার ঘন ছায়া |
অদ্ভুত রূপে পরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে ক’রে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ !
.                                তিনি নর-অবতার----
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার !
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর,
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর !
.                               সে যুগ হ’য়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী !
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও উঠিছে ডঙ্কা বাজি,
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে !

.                                যুগের ধর্ম এই-----
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই !

.                             শোনো মর্তের জীব,
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন,  নিজে হবে তত ক্লীব !
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী,
করিল তোমায় বন্দিনী, বলো কোন্ সে অত্যাচারী ?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা !
চোখে চোখে আজি চাহিতে পার না ; হাতে রুলি, পায়ে মল,
মাথার ঘোম্ টা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও শিকল !
যে ঘোম্ টা তোমা’ করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আবরণ !
দুর ক’রে দাও দাসীর চিহ্ন আছে যত আভরণ !
.                             ধরার দুলালী মেয়ে,
ফির’না ত আর গিরিদরীবনে শাখী-সনে গান গেয়ে !
কখন্ আসিল ‘প্লুটো’ যমরাজা নিশীথ পাখায় উ’ড়ে,
ধরিয়া তোমার পূরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে !
সেই সে আদিম বন্ধন তব,  সেই হ’তে আছ মরি’
মরণের পুরে ; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী |
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মত আয় মা পাতাল ফুঁড়ি !
আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি !
পুরুষ যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও-পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে !
এতদিন শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে !
.                         সে-দিন সুদূর নয়----
যে-দিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয় !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

.                কুলি-মজুর


.                            দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবুসা’ব  তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে !
.                            চোখ ফেটে এল জল,
এম্ নি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল ?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-সকট চলে,
বাবুসা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে !
বেতন দিয়াছ ? -----চুপ্ রও  যত মিথ্যাবাদীর দল ;
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল !
রাজ-পথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল’ত এ সব কাহাদের দান ! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা ? ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইঁটে আছে লিখা !
তুমি জান না ক’ কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে !


.                             আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ |
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদের ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উথ্বান !
তুমি শুয়ে রবে তেতালার’ পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে !
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটীর মমতা-রসে,
এই ধরণীর তরণীর হা’ল রবে তাহাদেরি বশে !
তারি পদরজে অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি,
সকলের সাথে পথে চলি যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি !
আজ নিখিলের বেদনা-আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ !
আজ হৃদয়ের জাম-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও !
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল !
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়ুক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়ুক ঝ’রে
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি,
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশী |
.                          একজনে দিলে ব্যথা
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা !
.                         একের অসন্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা ---সকলের অপমান !
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উথ্বান,
ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান !
কুলি-মজুর


.                            দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবুসা’ব  তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে !
.                            চোখ ফেটে এল জল,
এম্ নি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল ?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-সকট চলে,
বাবুসা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে !
বেতন দিয়াছ ? -----চুপ্ রও  যত মিথ্যাবাদীর দল ;
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল !
রাজ-পথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল’ত এ সব কাহাদের দান ! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা ? ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইঁটে আছে লিখা !
তুমি জান না ক’ কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে !


.                             আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ |
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদের ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উথ্বান !
তুমি শুয়ে রবে তেতালার’ পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে !
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটীর মমতা-রসে,
এই ধরণীর তরণীর হা’ল রবে তাহাদেরি বশে !
তারি পদরজে অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি,
সকলের সাথে পথে চলি যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি !
আজ নিখিলের বেদনা-আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ !
আজ হৃদয়ের জাম-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও !
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল !
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়ুক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়ুক ঝ’রে
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি,
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশী |
.                          একজনে দিলে ব্যথা
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা !
.                         একের অসন্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা ---সকলের অপমান !
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উথ্বান,
ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

ফরিয়াদ

এই ধরণীর ধূলি-মাখা তব অসহায় সন্তান
মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও, আদি-পিতা ভগবান !
.        আমার আঁখির দুখ-দীপ নিয়া
.        বেড়াই তোমার সৃষ্টি ব্যাপিয়া,
যতটুকু হেরি বিস্ময়ে মরি ভ’রে ওঠে সারা প্রাণ !
এত ভালো তুমি ? এত ভালোবাসো ?  এত তুমি মহীয়ান্  ?
.                        ভগবান !  ভগবান !




তোমার সৃষ্টি কত সুন্দর, কত সে মহৎ পিতা !
সৃষ্টি-শিয়রে ব’সে কাঁদ তুমি জননীর মত ভীতা !
.            নাহি সোয়াস্তি, নাহি যেন সুখ,
.            ভেঙে গড়ো, গ’ড়ে ভাঙো, উত্সুক-----
আকাশ মুড়েছে মরকতে----পাছে আঁখি হয় রোদে ম্লান !
তোমার পবন করিছে বীজন জুড়াতে দগ্ধ প্রাণ !
.                           ভগবান !  ভগবান !


রবি শশী তারা প্রভাত সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে----
‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে !
.            এই ধরণীর যাহা সম্বল,------
.            বাসে-ভরা ফুল, রসে-ভরা ফল,
সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধা সম জল, পাখীর কন্ঠে গান,----
সকলের এতে সম অধিকার, এই তাঁর ফর্ মান্-----
.                           ভগবান ! ভগবান !


শ্বেত, পীত, কালো করিয়া সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ !
আমরা যে কালো, তুমি ভালো জান, নহে তাহা অপরাধ !
.            তুমি বল নাই,  শুধু শ্বেতদ্বীপে
.            জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে,
সাদা রবে সবাকার টুঁটি টিপে, এ নহে তব বিধান |
সন্তান তব করিতেছে আজ তোমার অসন্মান !
.                           ভগবান ! ভগবান !



তব কনিষ্ঠা মেয়ে ধরণীরে দিলে দান ধূলা-মাটি,
তাই দিয়ে তার ছেলেদের মুখে ধরে সে দুধের বাটি !
.             ময়ুরের মত কলাপ মেলিয়া
.             তার আনন্দ বেড়ায় খেলিয়া !
সন্তান তার সুখী নয়,  তারা লোভী,  তারা শয়তান !
ঈর্ষায় মাতি, করে কাটাকাটি, রচে নিতি ব্যবধান !
.                           ভগবান ! ভগবান !



তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী,
রসনা তাহার শ্যামল ধরায় করিছে সাহারা গোবী !
.                 মাটির ঢিবিতে দু’দিন বসিয়া
.              রাজা সেজে করে পেষণ কসিয়া !
সে পেষণে তারি আসন ধসিয়া রচিছে গোরস্থান !
ভাই-এর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে বীরের আখ্যা পান !
.                         ভগবান ! ভগবান !


জনগণে যারা  জোঁক-সম শোষে তারে মহাজন কয়,
সন্তান-সম পালে যারা জমি তারা জমি-দার নয় |
.               মাটিতে যাদের ঠেকেনা চরণ,
.               মাটির মালিক তাঁহারাই হন !
যে যত ভন্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান্  !
নিতি নব ছোরা গড়িয়া কশাই বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান !
.                          ভগবান্ ! ভগবান্ !


অন্যায় রণে যারা যত দড় তারা তত বড় জাতি,
সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া ফুলায় বেহায়া ছাতি |
.                তোমার চক্র রুধিয়াছে আজ
.                বেনের রৌপ্য-চাকায়, কি লাজ !
এত অনাচার স’য়ে যাও তুমি, তুমি মহা মহীয়ান !
পীড়িত মানব পারেনাক’ আর, সবেনা এ অপমান !
.                            ভগবান ! ভগবান !


ঐ দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা, শঙ্কা নাহিক’ আর !
‘মরিয়া’র মুখে মারণের বাণী উঠিতেছে মার মার !
.                রক্ত যা ছিল ক’রেছে শোষণ,
.                নীরক্ত দেহে হাড় দিয়ে রণ !
শত শতাব্দী ভাঙেনি যে হাড়, সেই হাড়ে ওঠে গান-----
‘জয় নিপীড়িত জনগণ জয় !  জয় নব উথ্বান !
.                          জয় জয় ভগবান !’
তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বি সকলে করিব ভোগ,
এই পৃথিবীর নাড়ী সাথে আছে সৃজন দিনের যোগ !
.                 তাজা ফুলে ফলে অঞ্জলি পু’রে
.                 বেড়ায় ধরণী প্রতি ঘরে ঘু’রে,
কে আছে এমন ডাকু যে হরিবে আমার গোলার ধান ?
আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের ঘ্রাণ------
.                            এত দিনে ভগবান !



যে-আকাশ হ’তে ঝরে তব দান আলো ও বৃষ্টি-ধারা,
সে-আকাশ হ’তে বেলুন উড়ায়ে গোলা-গুলি হানে কা’রা ?
.                  উদার আকাশ বাতাস কাহারা
.                  করিয়া তুলিছে ভীতির সাহারা ?
তোমার অসীম ঘিরিয়া পাহারা দিতেছে কা’র কামান ?
হবেনা সত্য দৈত্য-মুক্ত ? হবেনা প্রতিবিধান ?
.                           ভগবান ! ভগবান !


তোমার দত্ত হস্তেরে বাঁধে কার-নিপীড়ন-চেড়ী  ?
আমার স্বাধীন বিচরণ রোধে কার আইনের বেড়ী ?
.                 ক্ষুধা তৃষা আছে আছে মোর প্রাণ,
.                 আমিও মানুষ, আমিও মহান !
আমার অধীন এ মোর রসনা,  এই খাড়া গর্দান
মনের শিকল ছিঁড়েছে, পড়েছে হাতের শিকলে টান----
.                            এতদিনে ভগবান্ !


চির-অবনত তুলিয়াছে আজ গগনে উচ্চ শির |
বান্দা আজিকে বন্ধন ছেদি’ ভেঙেছে কারা-প্রাচীর !
.                এতদিনে তার লাগিয়াছে ভালো----
.                  আকাশ বাতাস বাহিরেতে আলো,
এবার বন্দী বুঝেছে, মধুর প্রাণের চাইতে ত্রাণ !
মুক্ত-কন্ঠে স্বাধীন বিশ্বে উঠিতেছে একতান----
.                জয় নিপীড়িত প্রাণ !
.                জয় নব অভিযান !
.                জয় নব উথ্বান !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম


আমার কৈফিয়ৎ


বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’ !
কবি ও অকবি যাহা বল মোরে মুখ বুজে তাই সই সবি !
.                কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
.                ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে !
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি ?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী !


কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে !
বলে, ‘কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাঁশ ঠেলে !
.                পড়েনাক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা’
.                কেহ বলে ‘বৌ এ গিলিয়াছে গোটা !’
কেহ বলে, ‘মাটী হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে !
কেহ বলে, ‘তুই জেলে ছিলি ভালো, ফের যেন তুই যাস্ জেলে |


গুরু ক’ন, ‘তুই করেছিস শুরু তরোয়াল দিয়ে দাড়ি চাঁছা !
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা !’
.                আমি বলি, প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি !
.                অম্ নি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি !
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন ‘আড়ি চাচা !’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি নাড়ি কাছা !


মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্--লা’রা কন হাত নেড়ে,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জা’ত মেরে !
.                ফতোয়া দিলাম----কাফের কাজী ও,
.                যদিো শহীদ হইতে রাজী ও !
“আমপারা” পড়া হাম্ বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে !’
হিন্দুরা ভাবে, ‘ফার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত নেড়ে!’


আন্ কেরা যত নন্ ভায়োলেন্ট নন্-কো’র দলও নন খুশী !
‘ভায়োলেন্সের ভায়োলিন্’ নাকি আমি বিপ্লবী-মন তুষি !
.                ‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
.                ‘নয় চর্ কার গান কেন গা’বে ?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্ ফুসি !
স্বারাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের অঙ্কুশি’ !
নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা ! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী !
‘বিলেত ফেরনি ?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন্,  ‘এই তব বিদ্যে ছি !’
.                ভক্তরা বলে ‘নবযুগ রবি’ !
.                যুগের না হই, হুজুগের কবি
বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’শে কশি হৃদ-পেশী !
দু’কানে চশ্ মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্ বেশী !



কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুন্ডু, আমিই কি বুঝি তার কিছু ?
হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু !
.                বন্ধু ! তোমরা দিলে না ক দাম,
.                রাজ-সরকার রেখেছেন মান !
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন ! আর কিছু
শুনেছ কি, হু হু, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু ?


বন্ধু ! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন বন্দীরে !
.                যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
.                মেরে মেরে তাঁরে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল ! মানিল না রবি-গান্ধীরে !
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে !


আমি বলি, ওরে কথা শোন্ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস
.                                                খোশ্ হালে ?
প্রায় ‘হাফ’ নেতা হ’য়ে উঠেছিস, এবার এ দাঁও ফস্ কালে
.                ‘ফুল’ নেতা আর হবিনে যে হায় !-----
.                বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা ! সেই তালে
নিস্ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে !


বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
গান শুনে সবে ভাবে, ভাবনা কি ? দিন যাবে এবে পান খেয়ে !
.                রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
.                স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে !
মাতা কয়, ওরে চুপ্  হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্ চেয়ে !



ক্ষুধাতুর শিশু চায়না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন !
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন !
.                কেঁদে থুটে আসি পাগলের প্রায়,
.                স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায় !
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান, তুমি আজিও আছ কি ? কালি ও চুণ
কেন ওঠে না’ক তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন ?



আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস !
কত শত কোটী ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস !
.                এল কোটী টাকা, এল না স্বরাজ !
.                টাকা দিতে নারে ভুখারী সমাজ !
মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ,
.                                                    খাও হে ঘাস !
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ !


বন্ধু গো, আর বলিতে পারিনা, বড় বিষ জ্বালা এই বুকে !
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে !
.                রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা
.                তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু বড় দুখে !
অমর কাব্য তোমরা লিখিও , বন্ধু যাহারা আছ সুখে !


পরোয়া করিনা, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে !
প্রার্থনা ক’রো-----যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটী মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ !

.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সর্বহারা , কাজী নজরুল ইসলাম

গোকুল নাগ


না ফুরাতে শরতের বিদায়-শেফালি,
না নিবিতে আশ্বিনের কমল-দীপালি,
তুমি শুনেছিলে বন্ধু পাতা-ঝরা গান
ফুলে ফুলে হেমন্তের বিদায়-আহ্বান !
অতন্দ্র নয়নে তব লেগেছিল চুম
ঝর-ঝর কামিনীর, এল চোখে ঘুম
রাত্রিময়ী রহস্যের ; ছিন্ন শতদল
হ’ল তব পথ-সাথী ; হিমানী-সজল
ছায়াপথ-বীথি দিয়া শেফালি দলিয়া
এল তব মায়া-বধূ ব্যথা জাগানিয়া |
এল অশ্রু হেমন্তের, এল ফুল-খসা
শিশির-তিমির রাত্রি ; শ্রান্ত, দীর্ঘশ্বসা
ঝাউ-শাখে সিক্ত বায়ু রিক্ততার-বাণী
ক’য়ে গেল, দু’লে দু’লে কাঁদিল বনানী !
তুমি দেখেছিলে বন্ধু ছায়া-কুহেলির
অশ্রু-ঘন মায়া-আঁখি,----বিরহ-অথির
বুকে তব ব্যথা-কীট পশিল সেদিন !
যে কান্না এল না চোখে মর্মে হ’ল লীন
বক্ষে তাহা নিল বাসা, হ’লে রক্তে রাঙা
আশাহীন ভালবাসা, ভাষা, অশ্রু-ভাঙা !

বন্ধু তব জীবনের কুমারী আশ্বীন
পরিল বিধবা বেশ কবে কোন্ দিন,
কোন্ দিন সেঁউতির মালা হ’তে তার
ঝ’রে গেল বৃন্তগুলি রাঙা কামনার-----
জানি নাই ; জানি নাই, তোমার জীবনে
আসিছে বিচ্ছেদ-রাত্রি, অজানা গহনে
এবে যাত্রা শুরু তব, হে পথ-উদাসী !
কোন্ বনান্তর হ’তে ঘর-ছাড়া বাঁশী
ডাক দিল, তুমি জান ! মোরা শুধু জানি
তব পায়ে কেঁদেছিলে সারা পথখানি !
সেধেছিল, এঁকেছিল ধূলি-তুলি দিয়া
তোমার পদাঙ্ক-স্মৃতি !

.                রহিয়া রহিয়া
কত কথা মনে পড়ে ! আজ তুমি নাই,
মোরা তব পায়ে-চলা-পথে শুধু তাই
এসেছি খুঁজিতে সেই তপ্ত পদ-রেখা
এইখানে আছে তব ইতিহাস লেখা !

জানি না ক’ আজ তুমি কোন্ লোকে রহি
শুনিছ আমার গান হে কবি বিরহী !
কোথা কোন্ জিজ্ঞাসার অসীম সাহারা,
প্রতীক্ষার চির-রাত্রি, চন্দ্র, সূর্য়, তারা,
পারায়ে চলেছে একা অসীম বিরহে ?
তব পথ-সাথী যারা---পিছু ডাকি’ কহে----
‘ওগো বন্ধু শেফালির, শিশিরের প্রিয়,
তব যাত্রা-পথে আজ নিও বন্ধু নিও
আমাদের অশ্রু-আর্দ্র এ স্মরণখানি !’
শুনিতে পাও কি তুমি, এ-পারের বাণী ?
কানাকানি হয় কথা এ-পারে ও-পারে ?
এ কাহার শব্দ শুনি মনের বেতারে ?
কত দূরে আছ তুমি কোথা কোন্ বেশে ?
লোকান্তরে না সে এই হৃদয়েরি দেশে
পারায়ে নয়ন-সীমা বাঁধিয়াছ বাসা ?
হৃদয়ে বসিয়া শোন হৃদয়ের ভাষা ?----
হারায় নি এত সূর্য, এত চন্দ্র তারা,
যেথা হোক আছ বন্ধু হওনিক হারা |-----

সেই পথ, সেই পথ-চলা গাঢ় স্মৃতি,
সব আছে ! নাই শুধু সেই নিতি নিতি
নব নব ভালোবাসা প্রতি দরশনে,
আরো প্রিয় ক’রে পাওয়া চির-প্রিয়জনে-----
আদি নাই, অন্ত নাই, ক্লান্তি তৃপ্তি নাই,----
যত পাই তত চাই ----আরো আরো চাই,----
সেই নেশা সেই মধু নাড়ী-ছেঁড়া টান,
সেই কল্প লোকে নব নব অভিযান,----
সব নিয়ে গেছে বন্ধু !  সে কল-কল্লোল,
সে হাসি-হিল্লোল নাই চিত-উতরোল
আজ যেই প্রাণ-ঠাসা একমুঠো ঘরে
শূন্যের শূ্ন্যতা রাজে, বুক নাহি ভরে !
হে নবীন, অফুরন্ত তব প্রাণ ধারা
হয় ত এ মরু-পথে হয়নিক’ হারা,
হয় ত আবার তুমি নব পরিচয়ে
দেবে ধরা ; হবে ধন্য তার দান ল’য়ে
কথা-সরস্বতী ! ল’য়ে ব্যথা নয়,
কত বাণী এল, গেল কত হ’ল লয়,
আবার আসিবে কত ! শুধু মনে হয়
তোমারে আমরা চাই, রক্তমাংসময় !
আপনারে ক্ষয় করি’ যে অক্ষয় বাণী
আনিলে আনন্দ-বীর, নিজে বীণাপাণি
পাতি’ কর লবে তাহা ; তবু যেন হায়,
হৃদয়ের কোথা কোন্ ব্যথা থেকে যায় !
কোথা যেন শূন্যতার নিঃশব্দ ক্রন্ধন
গুমারি গুমারি ফেরে, হু-হু করে মন !------

বাণী তব---তব দান-----সে তো সকলের,
ব্যথা সেথা নয় বন্ধু ! যে-ক্ষতি একের
সেথায় সান্ত্বনা কোথা ?   সেথা শান্তি নাই,
মোরা হারায়েছি,----- বন্ধু, সখা, প্রিয়, ভাই !
কবির আনন্দ-লোকে নাই দুঃখ শোক,
সে-লোকে বিহারে যারা তারা সুখী হোক !
তুমি শিল্পী তুমি কবি দেখিয়াছে তারা,
তারা পান করে নাই তব প্রাণ-ধারা !

“পথিকে” দেখেছে তারা, দেখেনি “গোকুলে”,
ডুবেনিক’----সুখী তারা, আজো তারা কূলে !
আজো মোরা প্রাণাচ্ছন্ন, আমরা জানি না
গোকুল  সে শিল্পী  গল্পী কবি ছিল কি না !
আত্মীয়ে স্মরিয়া কাঁদি, কাঁদি প্রিয় তরে,
গোকুলে পড়েছে মনে -----তাই অশ্রু ঝরে !

না ফুরাতে আশা ভাষা, না মিটিতে ক্ষুধা,
না ফুরাতে ধরণীর মৃত-পাত্র-সুধা,
না পুরিতে জীবনের সকল আস্বাদ----
মধ্যাহ্নে আসিল দূত ! যত তৃষ্ণা সাধ
কাঁদিল আঁকড়ি’ ধরা, যেতে নাহি চায় !
ছেরে যেতে যেন সব  স্নায়ু ছিঁড়ে যায় !
ধরার নাড়ীতে পড়ে টান ! তরু-লতা
জল বায়ু মাটী সব কয় যেন কথা !
যেয়োনাক’ যেয়োনাক’ যেন সবে বলে-----
তাই এত আকর্ষণ এই জলে স্থলে
অনুভব ক’রেছিল প্রকৃতি-দুলাল !
ছেড়ে যেতে ছিঁড়ে গেল, বক্ষ লালে লাল
হ’ল ছিন্ন প্রাণ ! বন্ধু, সেই রক্ত-ব্যথা
র’য়ে গেল আমাদের বুকে চেপে-হেথা !

হে তরুণ, হে অরুণ, হে শিল্পী সুন্দর,
মধ্যাহ্নে আসিয়াছিলে সুমেরু-শিখর
কৈলাসের কাছাকাছি দারুণ তৃষ্ণায়,
পেলে দেখা সুন্দরের, স্বরগ-গঙ্গায়,
হয় ত মিটেছে তৃষা, হয় ত আবার----
ক্ষুধাতুর !---স্রোতে ভেসে এসেছে এ-পার !
অথবা হয়ত আজ, হে ব্যথা-সাধক,
অশ্রু-সরস্বতী কর্ণে তুমি কুরুবক !

হে পথিক-বন্ধু মোর, হে প্রিয়া আমার,
যেখানে যে-লোকে থাক করিও স্বীকার,
অশ্রু-রেবা- কূলে মোর এ স্মৃতি-তর্পণ,
আমারে অঞ্জলি করি করিনু অর্পণ !

সুন্দরের তপস্যায় ধ্যানে আত্মহারা
দারিদ্র্যের দর্প তেজ নিয়া এল যারা,
যারা চির-সর্বহারা করি’ আত্মদান,
যাহারা সৃজন করে, করে না নির্মাণ,
সেই বাণীপুত্রদের আড়ম্বরহীন
এ সহজ আয়োজন, এ-স্মরণ দিন
স্বীকার করিও কবি, যেমন স্বীকার
ক’রেছিলে তাহাদের জীবনে তোমার !

নহে এরা অভিনেতা, দেশ-নেতা নহে,
এদের সৃজন-কুঞ্জ অভাবে, বিরহে ;
ইহাদের বিত্ত নাই, পুঁজি চিত্তদল,
নাই বড় আয়োজন, নাই কোলাহল ;
আছে অশ্রু, আছে প্রীতি, আছে বক্ষ-ক্ষত,
তাই নিয়ে সুখী হও বন্দু স্বর্গগত !
গড়ে যারা, যারা করে প্রাসাদ নির্মাণ
শিরোপা তাদের তরে, তাদের সন্মান |

দু’দিনে ওদের গড়া প’ড়ে ভেঙে যায়,
কিন্তু স্রষ্টা সম যারা গোপনে কোথায়
সৃজন করিছে জাতি, সৃজিছে  মানুষ----
অচেনা রহিল তারা ! কথার ফানুষ
ফাঁপাইয়া যারা যত করে বাহাদুরী,
তারা তত পাবে মালা যশের কস্তুরী !
আজটাই সত্য নয়, ক’টা দিন তাহা ?
ইতিহাস আছে, আছে ভবিষ্যৎ, যাহা
অনন্ত কালের তরে রচে সিংহাসন,
সেখানে বসাবে তোমা বিশ্বজনগণ |
আজ তাহা নয় বন্ধু, হবে সে তখন,-----
পূজা নয়------আজ শুধু করিনু স্মরণ !


.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর