বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর "সিন্ধু হিন্দোল"
থেকে কয়েকটি কবিতা
*
সিন্ধু-হিন্দোল , কাজী নজরুল ইসলাম

সিন্ধু                                                               
         

------ প্রথম তরঙ্গ-------
চট্টগ্রাম ২৯-০৭-১৯২৬
  

.        হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে চির-বিরহী !
.                হে অতৃপ্ত !  রহি’  রহি’
.                        কোন্ বেদনায়
.        উদ্বেলিয়া ওঠ তুমি কানায় কানায় ?
কি কথা শুনাতে চাও, কারে কি কহিবে বন্ধু তুমি ?
প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে ঊর্ধ্বে নীলা নিম্নে বেলা-ভূমি !
.                কথা কও, হে দুরন্ত, বল,
তবু বুকে কেন এত ঢেউ জাগে,   এত কলকল ?
.                কিসের এ অশান্ত গর্জন ?
.        দিবা নাই রাত্রি নাই, অনন্ত ক্রন্দন
.                থামিল না বন্ধু তব !
কোথা তব ব্যথা বাজে ! মোরে কও, কা’রে নাহি ক’ব !
.                কারে তুমি হারালে কখন্ ?
.        কোন্ মায়া-মণিকার হেরিছ স্বপন ?
.                কে সে বালা ?  কোথা তার ঘর ?
.        কবে দেখেছিলে তারে ?  কেন হ’ল পর
.                যারে এত বাসিয়াছ ভালো !
.        কেন সে আসিল, এসে কেন সে লুকালো ?
.                অভিমান ক’রেছে সে ?
.        মানিনী ঝেঁপেছে মুখ নিশীথিনী-কেশে ?
.        ঘুমায়েছে একাকিনী জোছনা-বিছানে ?
.        চাঁদের চাঁদিনী বুঝি তাই এত টানে
.        তোমার সাগর-প্রাণ, জাগায় জোয়ার ?
.        কী রহস্য আছে চাঁদে লুকানো তোমার ?
.                        বল  বন্ধু  বল,
ও কি গান ?  ও কি কাঁদা ?  ঐ মত্ত জল-ছলছল------
.                        ও কি হুহুঙ্কার ?
.                ঐ চাঁদ ঐ সে কি প্রেয়সী তোমার ?
.                        টানিয়া সে মেঘের আড়াল
.                সুদূরিকা সুদূরেই থাকে চিরকাল ?
চাঁদের কলঙ্ক ঐ,   ও কি তব ক্ষুধাতুর চুম্বনের দাগ ?
দূরে থাকে কলঙ্কিনী,  ও কি রাগ ?     ও কি অনুরাগ ?
.                জাননা কি,  তাই
তরঙ্গে আছাড়ি মর আক্রোশে বৃথাই ? --------


মনে লাগে তুমি যেন অনন্ত পুরুষ
আপনার স্বপ্নে ছিলে আপনি বেহুঁশ !
.                অশান্ত !  প্রশান্ত ছিলে !
.                        এ- নিখিলে
.                জানিতে না আপনারে ছাড়া !
তরঙ্গ ছিলনা বুকে, তখনো দোলানী এসে দেয়নিক’ নাড়া !
.        বিপুল আরসী-সম ছিলে স্বচ্ছ ছিলে স্থির,
.        তব মুখে মুখ রেখে ঘুমাইত তীর |------
.                তপস্বী !    ধেয়ানী !
.        তারপর চাঁদ এলো------কবে, নাহি জানি
.                তুমি যেন উঠিলে শিহরি’ !
.        হে মৌনী, কহিলে কথা------“মরি মরি,
.                        সুন্দর সুন্দর !”
.        ‘সুন্দর সুন্দর’ গাহি জাগিয়া উঠিল চরাচর !
.        সেই সে আদিম শব্দ সেই আদি কথা,
.        সেই বুঝি নির্জনের সৃজনের ব্যথা,
.                        সেই বুঝি বুঝিলে রাজন
.        একা সে সুন্দর হয় হইলে দুজন !----------
.        কোথা সে উঠিল চাঁদ হৃদয়ে না নভে
সে-কথা জানেনা কেউ, জানিবে না, চিরকাল নাহি-জানা-রবে |
.        এত দিনে ভার হ’ল আপনারে নিয়া একা থাকা,
.                কেন যেন মনে হয়, ফাঁকা, সব ফাকা !
.                কে যেন চাহিছে মোরে, কে জানে কী নাই,
.                যারে পাই তারে যেন আরো পেতে চাই ! -------



.                জাগিল আনন্দ-ব্যথা জাগিল জোয়ার,
.                লাগিল তরঙ্গে দোলা, ভাঙিল দুয়ার,
.                           মাতিয়া উঠিলে তুমি !
.                কাঁপিয়া উঠিল কেঁদে নিদ্রাতুরা ভূমি !
.                বাতাসে উঠিল ব্যেপে তব হতাশ্বাস,
.                জাগিল অনন্ত শূন্যে নীলিমা-উছাস !
.                বিস্ময়ে বাহিরি’ এল নব নব নক্ষত্রের দল,
.                          রোমাঞ্চিত হ’ল ধরা,
.                বুক চিরে এল তার তৃণ-ফুল-ফল |
.                এল আলো, এল বায়ু, এল তেজ প্রাণ,
.            জানা ও অজানা ব্যেপে ওঠে সেকি অভিনব গান !
.                একি মাতামাতি ওগো এ কি উতরোল !
.                এত বুক ছিল হেথা ছিল এত কোল !
.                শাখা ও শাখীতে যেন কত জানাশোনা,
.                হাওয়া এসে দোলা দেয় সেও যেন ছিল জানা
.                            কত সে আপনা !
.                    জলে জলে ঢলাঢলি চলমান বেগে,
.                ফুলে হুলে চুমোচুমি----চরাচরে খেলা ওঠে জেগে !
.                               আনন্দ-বিহ্বল
.                  সব আজ কথা কহে, গাহে গান, করে কোলাহল !
.                        বন্ধু ওগো সিন্ধুরাজ!  স্বপ্নে চাঁদ-মুখ
.                হেরিয়া উঠিল জাগি, ব্যথা ক’রে উঠিল ও বুক !
.                কী যেন সে ক্ষুধা জাগে, কী যেন সে পীড়া,
.                গ’লে যায় সারা হিয়া, ছিঁড়ে যায় যত স্নায়ু শিরা !
.                        নিয়া নেশা, নিয়া ব্যথা-সুখ
.                        দুলিয়া উঠিলে সিন্ধু উত্সুক উন্মুখ !
.                        কোন্ প্রিয়-বিরহের সুগভীর ছায়া
.                তোমাতে পড়িল যেন, নীল হ’ল তব স্বচ্ছ কায়া !
.                              সিন্ধু, ওগো বন্ধু মোর !
.                        গর্জিয়া উঠিলে ঘোর
.                              আর্ত হুহুঙ্কারে !
.                              বারে বারে
.                বাসনা--তরঙ্গে তব পড়ে ছায়া তব প্রেয়সীর,
.                 ছায়া সে তরঙ্গে ভাঙে, হানে মায়া, উর্ধ্বে, প্রিয়া স্থির !
.                        ঘুচিল না অনন্ত আড়াল,
.                তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে সাথে কাল !
.                        কাঁদে গ্রীষ্মকাঁদে বর্ষা বসন্ত ও শীত,
.                নিশিদিন শুনি বন্ধু ঐ এক ক্রন্দনের গীত !
.                        নিখিল বিরহী কাঁদে, সিন্ধু তব সাথে,
.                তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে প্রিয়া রাতে !
.                        সেই অশ্রু------সেই লোনাজল
.        তব চক্ষে----হে বিরহী বন্ধু মোর ------ করে টলমল !
.                        এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়া
.                তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে মোর প্রিয়া !


                                                  

-------দ্বিতীয় তরঙ্গ---------
চট্টগ্রাম, ৩১.০৭-১৯২৬


.                হে সিন্ধু হে বন্ধু মোর
.                         হে মোর বিদ্রোহী !
.                             রহি’ রহি’
.                               কোন্ বেদনায়
.        তরঙ্গ-বিভঙ্গে মাতো উদ্দাম লীলায় !
.                        হে উন্মত্ত, কেন এ নর্তন ?
.        নিষ্ফল আক্রোশে কেন কর আস্ফালন
.                        বেলাভূমে পড়ো আছাড়িয়া !
.        সর্বগ্রাসী !  গ্রাসিতেছে মৃত্যু-ক্ষুধা নিয়ে
.                        ধরীরে তিলে-তিলে !
.        হে আস্থির !   স্থির নাহি হ’তে দিলে
.                        পৃথিবীরে !  ওগো নৃত্য-ভোলা,
.        ধরারে দোলায় শূন্যে তোমার হিন্দোলা !
.                              হে চঞ্চল,
.        বারে বারে টানিতেছে দিগন্তিকা-বধূর অঞ্চল !
.        কৌতুকী গো !  তোমার এ-কৌতুকের অন্ত যেন নাই !------
.                                 কী যেন বৃথাই !
.                               খুঁজিতেছে কূলে কূলে
.        কার যেন পদরেখা !----   কে নিশীথে এসেছিল ভুলে”
.                তব তীরে গর্বিতা সে নারী,
.        যত বারি আছে চোখে তব
.                সব দিলে পদে তার ডালি’
.                সে শুধু হাসিল উপেক্ষায় !
.        তুমি গেলে করিতে চুম্বন, সে ফিরালো কঙ্কণের ঘায় !
.                ------ গেল চ’লে নারী !
.        সন্ধান করিয়া ফের,  হে সন্ধানী, তারি
.                দিকে দিকে তরণীর দুরাশা লইয়া,
.        গর্জনে গর্জনে কাঁদ---  “ পিয়া , মোরি পিয়া”!

.        বল বন্ধু  বুকে তব কেন এত বেগ,  এত জ্বালা ?
.        কে দিল না প্রতিদান ? কে ছিঁড়িল মালা ?
.        কে সে গরবিনী বালা ? কার এত রূপ এত প্রাণ,
.                হে সাগর, করিল তোমার অপমান !
.                হে “মজনু”  কোন সে  “লায়লী”র
.                প্রণয়ে উন্মাদ তুমি? ----বিরহ -অথির
.                করিয়াছ বিদ্রোহ ঘোষণা , সিন্ধুরাজ,
.                কোন রাজ-কুমারীর লাগি’ ? কারে আজ
.                পরাজিত করি রণে, তব প্রিয়া রাজ-দুহিতারে
.                আনিবে হরণ করি’ ? -----সারে সারে
.                দলে দলে চলে তব তরঙ্গের সেনা,
.                উষ্ণীষ তাদের শিরে শওভে শুভ্র ফেনা !
.                        ঝটিকা তোমার সেনাপতি
.                আদেশ হানিয়া চলে উর্ধ্বে অগ্রগতি !
.                        উড়ে চলে মেঘের বেলুন,
.                “মাইন্” তোমার চোরা পর্বত নিপুণ !
.                হাঙ্গর কুম্ভীর তিমি চলে, “সাব্ মেরিণ”,
.                নৌ-সেনা চলিছে নীচে মীন !
.                সিন্ধু-ঘোটকেতে চড়ি, চলিছে বীর
.                                উদ্দাম অস্থির !
.        কখন আনিবে জয় করি’----কবে সে আসিবে তব প্রিয়া,
.                                সেই আশা নিয়া
.                মুক্তা-বুকে মালা রচি’ নীচে !
.        তোমার হেরেম-বাঁদি শত শুক্তি-বধূ অপেক্ষিছে !
.                প্রবাল গাঁথিছে রক্ত-হার------
.        হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর------তোমার প্রিয়ার |
.        রচিতেছে নব নব দ্বীপ তারি প্রমোদ-কানন !



.                বক্ষে তব চলে সিন্ধু-পোত
.                ওরা যেন তব পোষা কপোতী-কপোত !
.                নাচায়ে আদর কর পাখীরে তোমার
.                ঢেউ-এর দোলায়, ওগো কোমল দুর্বার !
.                উচ্ছাসে তোমার জল উলসিয়া উঠে,
.                ও বুঝি চুম্বন তব তার চঞ্চু-পুটে ?
.                আশা তব ওড়ে লুব্ধ সাগর-শকুন,
.                তটভূমি টেনে চলে তব আশা-তারিকার গুণ !
.                উড়ে যায় নাম নাহি-জানা কত পাখী,
.                ও যেন স্বপন তব !----  কী তুমি একাকী
.                        ভাব কভু আনমনে যেন,
.                সহসা লুকাতে চাও আপনারে  কেন !
.                ফিরে চল ভাঁটি-টানে কোন অন্তরালে,
.                যেন তুমি বেঁচে যাও নিজেরে লুকালে !------
.                শ্রান্ত মাঝি গাহে গান ভাটিয়ালী সুরে,
.                ভেসে যেতে চায় প্রাণ দূরে----আরো দূরে
.                        সীমাহীন নিরুদ্দেশ পথে,
.        মাঝি ভাসে, তুমি ভাস, আমি ভাসি স্রোতে !



.        নিরুদ্দেশ ! শু’নে কোন, আড়ালীর ডাক
.        ভাটিয়ালী পথে চল একাকী নির্বাক্ !
.        অন্তরের তলা হ’তে শোন কি আহ্বান ?
.        কোন্ অন্তরিকা কাঁদে অন্তরালে থাকি’ যেন,
.                                     চাহে তব প্রাণ!
.        বাহিরে না পেয়ে তারে ফের তুমি অন্তরের পানে
.                      লজ্জায়---ব্যাথায়-----অপমানে !



.        তারপর বিরাট্ পুরুষ !    বোঝো নিজ ভুল,
.        জোয়ারে উচ্ছসি ওঠো,  ভেঙে চল কূল
.                    দিকে দিকে প্লাবনের বাজায়ে বিষাণ,
.        বল, ‘প্রেম করে না দুর্বল, ওরে করে মহীয়ান্ !”
বারুণী-সাকীরে কহ, “আনো সখি সুরার পেয়ালা !”
আনন্দে নাচিয়া ওঠো দুখের নেশায় বীর, ভোল সব জ্বালা !
.                    অন্তরের নিষ্পেষিত ব্যথার ক্রন্দন
.                    ফেনা হয়ে ওঠে মুখে বিষের মতন !
.                            হে শিবষ পাগল  !
.        তট কন্ঠে ধরি’ রাখ সেই জ্বালা----সেই হলাহল !
.                              হে বন্ধু, হে সখা,
.        এতদিনে দেখা হ’ল,  মোরা দুই পলাতকা !
.        কত কথা আছে------কত গান আছে শোনাবার,
.        কত ব্যথা জানাবার আছে----সিন্ধু, বন্ধু গো আমার !

.                     এসো বন্ধু, মুখোমুখি বসি !
.        অথবা টানিয়া লহ তরঙ্গের আলিঙ্গন দিয়া, দুঁহু পশি
.                     ঢেউ নাই যথা----শুধু নিতল সুনীল !------
.        তিমিরে কহিয়া দাও-----সে যেন খোলে না খিল,
.                           থাকে দ্বারে বসি’  !----
.                        সেইখানে ক’ব কথা |  যেন রবি শশী
.                            নাহি পশে সেথা !
.        তুমি রবে ----আমি রব-----আর  রবে ব্যথা !
.        সেথা শুধু ডুবে রব কথা নাহি কহি’-----
.                     যদি কই
.        নাই সেথা দুটি কথা বই,-------
‘আমিও বিরহী, বন্ধু, তুমিও বিরহী !’




------- তৃতীয় তরঙ্গ-----
চট্টগ্রাম, ০২-০৮-১৯২৬


.        হে ক্ষুধিত বন্ধু মোর, তষিত জলধি,
.        এত জল বুকে তব, তবু নাহি তৃষ্ণার অবধি !
.        এত নদী উপনদী তব পদে, করে আত্মদান,
.        বুভুক্ষ !  তবু কি তব ভরিল না প্রাণ ?
.                 দুরন্ত গো, মহাবাহু,
.                        ওগো রাহু,
.        তিন ভাগ গ্রসিয়াছে----এক ভাগ বাকী !
.        সুরা নাই---পাত্র হাতে কাঁপিতেছে সাকী !


.        হে দুর্গম !  খোল খোলো দ্বার !
সারি সারি গিরি-দরী দাঁড়ায়ে দুয়ারে করে প্রতীক্ষা তোমার !
.        শস্য-শ্যামা বসুমতী ফুলে ফলে ভরিয়া অঞ্জলি
.                করিছে বন্দনা তব, বলী !
.        তুমি আছ নিয়া নিজ দুরন্ত কল্লোল
.                আপনাতে আপনি বিভোল !
.        পশে না শ্রবণে তব ধরণীর শত দুঃখ গীত ;
.        দেখিতেছ বর্তমান, দেখেছ অতীত,
.        দেখিবে সুদূর ভবিষ্যৎ-----
.        মৃত্যুঞ্জয়ী দ্রষ্টা, ঋষি, উদাসীনবৎ !
.        ওঠে ভাঙে তব বুকে তরঙ্গের মত
.        জন্ম-মৃত্যু দুঃখ-সুখ, ভূমানন্দে হেরিছ সতত !
.        হে পবিত্র ! আজিও সুন্দর ধরা আজিও অম্লান
.        সদ্য-ফোটা পুষ্পসম, তোমাতে করিয়া নিতি স্নান !
.                জগতের যত পাপ গ্লানি
.        হে দরদী, নিঃশেষে মুছিয়া লয় তব স্নেহ-পাণি !
.                ধরা তব আদরিণী মেয়ে,
.        তাহারে দেখিতে তুমি আস’ মেঘ বেয়ে !
.        হেসে ওঠে তৃণে শস্যে দুলালী তোমার,
.        কালো চোখ বেয়ে ঝরে হিম-কণা আনন্দাশ্রু-ভার !
.        জলধারা হ’য়ে নামো, দাও কত রঙীন যৌতুক,
.                ভাঙ গড় দোলা দাও,-----
.        কন্যারে লইয়া তব অনন্ত কৌতুক !
.                  হে বিরাট, নাহি তব ক্ষয়,
.        নিত্য নব-নব-দানে ক্ষয়েরে ক’রেছ তুমি জয়!



.                হে সুন্দর ? জল-বাহু দিয়া
.                ধরণীর কটিতট আছ আঁকড়িয়া
.                ইন্দ্রনীলকান্তমণি মেখলার সম,
.        মেদিনীর নিতম্ব-দোলার সাথে দোল অনুপম!
.        বন্ধু তব অনন্ত যৌবন
.                  তরঙ্গে ফেনায়ে ওঠে সুধার মতন !
.        কত মত্স্য-কুমারীরা নিত্য তোমা যাচে,
.        কত জল-দেবীর শুষ্ক মালা প’ড়ে তব চরণের কাছে,
.                চেয়ে নাহি দেখ, উদাসীন !
.        কার যেন স্বপ্নে তুমি মত্ত নিশিদিন !



.        মন্থন-মন্দার দিয়া দস্যু সুরাসুর
.        মথিয়া লুন্ঠিয়া গেছে তব রত্ন-পুর,
.        হরিয়াছে উচ্চৈঃশ্রবা, তব লক্ষ্মী, তব শশী-প্রিয়া,
.        তারা সব আছে আজ সুখে স্বর্গে গিয়া !
.                ক’রেছে লুন্ঠন
.        তোমার অমৃত সুধা----তোমার জীবন !
.        সব গেছে, আছে শুধু ক্রন্দন-কল্লোল,
.        আছে জ্বালা, আছে স্মৃতি, ব্যথা-উতরোল !
.        ঊর্ধ্বে শূন্য,  ---নিম্নে শূন্য,  ----শূন্য চারিধার,
.        মধ্যে কাঁদে বারিধির, সীমাহীন রিক্ত-হাহাকার !



.                হে মহান !  হে চির-বিরহী !
.        হে সিন্ধু, হে বন্ধু, মোর, হে মোর বিদ্রোহী,
.                        সুন্দর আমার !
.                                   নমস্কার !
.                            নমস্কার লহ !
.        তুমি কাঁদো,------আমি কাঁদি,-----কাঁদে মোর প্রিয়া অহরহ !
.        হে দুরন্ত আছে তব পার, আছে কূল,
.        এ অনন্ত বিরহের নাহি পার,----নাহি কূল,----শুধু স্বপ্ন, ভুল !



.        মাগিব বিদায় যবে, নাহি রব আর,
.        তব কল্লোলের মাঝে বাজে যেন ক্রন্দন আবার !
.                        বৃথাই খুঁজিবে যবে প্রিয়া
.        উত্তরিও বন্ধু ওগো সিন্ধু মোর, তুমি গরজিয়া !



.        তুমি শূন্য, আমি শূন্য, শূন্য চারিধার,
.        মধ্যে কাঁদে বারিধার----সীমাহীন রিক্ত হাহাকার !


                                                 

.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সিন্ধু-হিন্দোল , কাজী নজরুল ইসলাম

গোপন প্রিয়া                        

পাইনি ব’লে আজো তোমায় বাস্ ছি ভালো, রাণি !
মধ্যে সাগর, এ-পার ও-পার, কর্ ছি কানাকানি |
.        আমি এ-পার, তুমি ও-পার,
.        মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার,
ও-পার হ’তে ছায়া-তরু দাও তুমি হাত্ ছানি,
আমি মরু, পাইনে তোমার ছাযার ছোঁওয়া-খানি !


নাম-সোনা দুই বন্ধু মোরা হয়নি পরিচয় !
আমার বুকে কাঁদছে আশা, তোমার বুকে ভয় !
.        এই-পারী ঢেউ বাদল-বায়ে
.        আছ্ ড়ে পড়ে তোমার পায়ে,
আমার ঢেউ-এর দোলায় তোমার ক’র্ ল না কূল ক্ষয়,
কূল ভেঙেছে আমার ধারে তোমার ধারে নয় !


চেনার বন্ধু পেলাম্ নাক’  জানার অবসর |
গানের পাখী ব’সেছিলাম দুদিন শাখার ‘পর !
.        গান ফুরালে যাব যবে,
.        গানের কথাই মনে রবে,
পাখী তখন থাক্ বেনাক’ ----থাকবে পাখীর স্বর !
উড়্ ব আমি, কাঁদ্ বে তুমি ব্যথার বালুচর !


তোমার পারে বাজ্ ল কখন্ আমার পারের ঢেউ,
অজানিতা ! কেউ জানেনা, জান্ বেনাক’ কেউ !
.        উড়্ তে গিয়ে পাখা হ’তে
.        একটি পালক প’ড়্ লে পথে
ভু’লে প্রিয় তু’লে যেন খোঁপায় গুঁজে নেও !
ভয় কি সখি ? আপ্ নি তুমি ফেল্ বে খু’লে এ--ও !


বর্ষা-ঝরা এম্ নি প্রাতে আমার মত কি
ঝুর্ বে তুমি এক্ লা মনে, বনের কেতকী ?
.        মনের মনে নিশীথ্-রাতে
.        চুম্ দেবে কি কল্পনাতে ?
স্বপ্ন দেখে উঠ্ বে জেগে, ভাব্ বে কত কি !
মেঘের সাথে কাঁদ্ বে তুমি, আমার চাতকী !


দূরের প্রিয়া ! পাইনি তোমার তাই এ কাঁদন্-রোল !
কূল মেলেনা,----তাই দরিয়ায় উঠ্ তেছে ঢেউ-দোল !
.        তোমায় পেলে থাম্ ত বাঁশী,
.        আস্ ত মরণ সর্বনাশী,
পাইনিক’ তাই ভ’রে আছ আমার বুকের কোল !
বেণুর হিয়া-শূন্য ব’লে উঠ্ ছে বাঁশীর বোল !

বন্ধু, তুমি হাতের-কাছে সাথের-সাথী নও,
দূরে যত রো এ-হিয়ার তত নিকট হও !
.        থাক্ বে তুমি ছায়ার সাথে
.        মায়ার মত চাঁদনী রাতে !
যত গোপন তত মধুর ----নাইবা কথা কও !
শয়ন-সাথে রও না তুমি, নয়ন-পাতে রও !



ওগো আমার আড়াল-থাকা ওগো স্বপন-চোর !
তুমি আছ আমি আছি এই  ত খুশী মোর |
.        কোথায় আছ কেম্ নে রাণী,
.        কাজ কি খোঁজে, নাই-বা জানি !
ভালোবাসি এই আনন্দে আপ্ নি আছি ভোর !
চাইনা জাগা, থাকুক্ চোখে এমনি ঘুমের ঘোর !


রাত্রে যখন এক্ লা শোব-----চাইবে তোমার বুক,
নিবিড়-ঘন হবে যখন এক্ লা থাকার দুখ,
.        দুখের সুরায় মস্ত্ হয়ে
.        থাক্ বে এ-প্রাণ তোমায় লয়ে,
কল্পনাতে আঁক্ ব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ !
ঘুমে জাগায় জড়িয়ে রবে ; সেই ত চরম সুখ !


গাইব আমি, দূরে থেকে শুনবে তুমি গান,
থাম্ লে আমি-----গান গাওয়াবে তোমার অভিমান |
.        শিল্পী আমি, আমি কবি,
.        তুমি আমার-আঁকা ছবি,
আমার-লেখা কাব্য তুমি, আমার-রচা গান |
চাইবনাক’, পরাণ ভ’রে ক’রে যাব দান !


তোমার বুকে স্থান কোথা গো এ দূর-বিরহীর,
কাজ কি জেনে ! তল কেবা পায় অতল জলধির!
.        গোপন তুমি আস্ লে নেমে
.        কাব্যে আমার, আমার প্রেমে,
এই-সে সুখে থাক্ ব বেঁচে, কাজ কি দেখে তীর ?
দূরের পাখী----গান গেয়ে যাই, না-ই বাঁধিলাম নীড় !
বিদায় যেদিন নেবো সেদিন নাইবা পেলাম দান,
মনে আমার কর্ বেনাক’----সেই ত মনে স্থান !
.        যে-দিন আমায় ভুল্ তে গিয়ে
.        ক’রবে মনে, সে-দিন প্রিয়ে
ভোলার মাঝে উঠ্ ব বেঁচে, সেই ত আমার প্রাণ !
নাই বা পেলাম্ চেয়ে গেলাম, গেয়ে গেলাম গান !
                                                             চট্টগ্রাম ২৮-০৭-১৯২৬

.                   **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সিন্ধু-হিন্দোল , কাজী নজরুল ইসলাম

অ-নামিকা

.        তোমারে বন্দনা করি
.                  স্বপ্ন-সহচরী
.        লো আমার অনাগত প্রিয়া,
আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া !
.                   তোমারে বন্দনা করি----
.             হে আমার মানস-রঙ্গিণী
অতন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী !
.                  তোমারে বন্দনা করি-------
নাম-নাহি-জানা ওগো আজো-নাহি-আসা !
আমার বন্দনা লহ, লহ ভালোবাসা-----
গোপন-চারিণী মোর, লো চির-প্রেয়সী !
সৃষ্টি-দিন হ’তে কাঁদ বাসনার অন্তরালে বসি’,-----
.                        ধরা নাহি দিলে দেহে |
তোমার কল্যাণ-দীপ জ্বলিল না
.            দীপ-নেভা বেড়া-দেওয়া গেহে |
অসীমা !  এলেনা তুমি সীমারেখা-পারে |
স্বপনে পাইয়া তোমা’ স্বপনে হারাই বারে বারে !
অপরূপা লো ! রতি হ’য়ে এলে মনে,
.             সতী হ’য়ে এলেনাক’ ঘরে !
প্রিয়া হ’য়ে এলে প্রেমে,
.             বধূ হ’য়ে এলেনা অধরে !
দ্রাক্ষা-বুকে রহিলে গোপন তুমি শিরীন্ শরাব,
.             পেয়ালায় নহি এলে !-----
.               “উতারো নেকাব-----“
.               হাঁকে মোর দুরন্ত কামনা !
সুদূরিকা ! দূরে থাক’-----ভালবাস------নিকটে আস না !


তুমি নহ নিভে-যাওয়া আলো, নহ শিখা !
.        তুমি মরীচিকা,
.                        তুমি জ্যোতি !  ------
জন্ম-জন্মান্তর ধরি’ লোকে লোকান্তরে তোমা’ করেছি আরতি,
.        বারেবারে একই জন্মে শতবার করি !
যেখানে দেখেছি রূপ,----ক’রেছি বন্দনা প্রিয়া তোমারেই স্মরি’ !
.        রূপে রূপে অপরূপা, খুজেছি তোমায় !
.        পবনের যবনিকা যত তুলি তত বেড়ে যায়’ !
.        বিরহের কান্না-ধোওয়া তৃপ্তি হিয়া ভরি
.        বারেবারে উদিয়াছে ইন্দ্রধনুসমা,
.                হাওয়া-পরী
.                প্রিয়া মনোরমা !
ধরিতে গিয়াছে-----তুমি মিলায়েছ দূর দিগ্বলয়ে
ব্যথা-দেওয়া রাণী মোর, এলেনাক’ কথা-কওয়া হ’য়ে !



চির-দূরে-থাকা ওগো চির-নাহি-আসা !
তোমার দেহের তীরে পাবার দুরাশা
.                গ্রহ হ’তে গ্রহান্তরে ল’য়ে যায় মোরে !
বাসনার বিপুল আগ্রহে-----
.                জন্ম লভি লোকে লোকান্তরে !
উদ্বেলিত বুকে মোর অতৃপ্ত যৌবন-ক্ষুধা উদগ্র কামনা,
.                জন্ম তাই লভি বারে বারে,
.                না-পাওয়ার করি আরাধনা |------
.                যা-কিছু সুন্দর হেরি’ ক’রেছি চুম্বন,
.                যা-কিছু চুম্বন দিয়া ক’রেছি সুন্দর-----
.                সে-সবার মাঝে যেন তব হরষণ
.        অনুভব করিয়াছি------ছুঁয়েছি অধর
.                তিলোত্তমা,   তিলে তিলে !
.                তোমারে যে করেছি চুম্বন
.                প্রতি তরুণীর ঠোঁটে !
.                প্রকাশ গোপন !
.        যে কেহ প্রিয়ারে তার চুম্বিয়াছে ঘুম-ভাঙা রাতে,
রাত্রি-জাগা তন্দ্রা-লাগা ঘুম-পাওয়া প্রাতে,
.        সকলের সাথে আমি চুমিয়াছি তোমা’
সকলের ঠোঁটে যেন , হে নিখিল-প্রিয়া প্রিয়তমা !
.        তরু, লতা, পশু পাখী সকলের কামনার সাথে
আমার কামনা জাগে, আমি রমি বিশ্ব-কামনাতে !
.        বঞ্চিত যাহারা প্রেমে, ভুঞ্জে যারা রতি,
সকলের মাঝে আমি---সকলের প্রেমে মোর গতি!
যেদিন স্রষ্টার বুকে জেগেছিল আদি সৃষ্টি-কাম,
সেই দিন স্রষ্টার সাথে তুমি এলে আমি আসিলাম !
.        আমি কাম তুমি হ’লে রতি,
তরুণ-তরুণী-বুকে নিত্য তাই আমাদের অপরূপ গতি !         



কী যে তুমি, কী যে নহ, কত ভাবি-----কত দিকে চাই !
নামে নামে, অ-নামিকা, তোমারে কি খুঁজিনু বৃথাই ?
বৃথাই বাসিনু ভালো ? বৃথা সবে ভালোবাসে মোরে ?
তুমি ভেবে যারে বুকে চেপে ধরি সে-ই যায় স’রে
.        কেন হেন হায় হায়, কেন লয় মনে---
যারে ভালো বাসিলাম, তারো চেয়ে ভালো কেহ
.                বাসিছে গোপনে |
সে বুঝি সুন্দরতর------আরো আরো মধু |
আমারি বধূর বুকে হাস তুমি হ’য়ে নববধূ !
.                বুকে যারে পাই, হায়,
.                তারি বুকে তাহারি শয্যায়
নাহি-পাওয়া হ’য়ে তুমি কাঁদ একাকিনী,
.                ওগো মোর প্রিয়ার সতিনী------
বারেবারে পাইলাম---------বারেবারে মন যেন কহে-----
.                নহে, এ সে নহে !
কুহেলিকা ! কোথা তুমি !  দেখা পাব কবে ?
জন্মেছিলে, জন্মিয়াছ, কিম্বা জন্ম লবে ?
.                কথা কথা, কও কথা প্রিয়া,
হে আমার যুগে যুগে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া !



কহিবেনা কথা তুমি ! আজ মনে হয়,
প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয় |
.               জন্ম যার কামনার বীজে
কামনারই মাঝে সে যে বেড়ে যায় কল্পতরু নিজে |
.        দিকে দিকে পাখা তার করে অভিযান,
ও যে শুষিয়া নেবে আকাশের যত বায়ু প্রাণ |
.             আকাশ ঢেকেছে তার পাখা
.                     কামনার সবুজ বলাকা !



.         প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু----অগণন,
তাই----চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন |
.                মদ সত্য পাত্র সত্য নয়,
.           যে-পাত্রে ঢালিয়া খাও সেই নেশা হয় !
.                        চির-সহচরি !
.             এতদিনে পরিচয় পেনু, মরি মরি !
.             আমারি প্রেমের মাঝে রয়েছ গোপন,
.            বৃথা আমি খুঁজে মরি’ জন্মে জন্মে করিনু রোদন |
.            প্রতি রূপে, অপরূপা, ডাক তুমি,
.                        চিনেছি তোমায়,
.            যাহারে বাসিব ভালো -----সে--ই তুমি,
.                        ধরা দেবে তায় !
.                       প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু,
.             বহু পাত্রে ঢেলে পি’ব সেই প্রেম----
.                        সে শরাব-লোহু !
.             তোমারে করিব পান, অ-নামিকা, শত কামনায়,
.             ভৃঙ্গারে, গেলাসে কভু, কভু পেয়ালায় !


                                                     চট্টগ্রাম ১৭--০৭--১৯২৬

.                          **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সিন্ধু-হিন্দোল , কাজী নজরুল ইসলাম

বিদায়-স্মরণে

পথের দেখা এ নহে গো বন্ধু
.               এ নহে পথের আলাপন |
এ নহে সহসা-পথ চলা শেষে
.               শুধু হাতে হাতে পরশন ||


নিমেষে নিমেষে নব পরিচয়ে
হ’লে পরিচিত মোদের হৃদয়ে,
আসনি বিজয়ী----এলে সখা হ’য়ে
.                হেসে হ’রে নিলে প্রাণ-মন ||



রাজাসনে বসি হওনিক’ রাজা,
.                রাজা হ’লে বসি হৃদয়ে,
তাই আমাদের চেয়ে তুমি বেশী
.                ব্যথা পেলে তব বিদায়ে ||



আমাদের শত ব্যথিত হৃদয়ে
জাগিয়া রহিবে তুমি ব্যথা হ’য়ে,
হ’লে পরিজন চির-পরিচয়ে----
.                পুনঃ পাব তব দরশন,
.                এ নহে পথের আলাপন ||


                                     হুগলী, কার্তিক---১৩৩২


.                          **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সিন্ধু-হিন্দোল , কাজী নজরুল ইসলাম

.                দারিদ্র্য

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে ক’রেছ মহান !
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সন্মান
কন্টক-মুকুট শোভা ! দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস ;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বাণী মোর শাপে তব হ’ল তরবার !

.                        দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস,
.                        অম্লান স্বর্ণের মোর করিলে বিরস,
.                        অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ !
.                        শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান
.                        যতবার নিতে যাই---হে বুভুক্ষু তুমি
.                        অগ্রে আসি’ কর পান ! শূন্য মরুভূমি
.                        হেরি’ মম কল্পলোক | আমার নয়ন
.                        আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ !

বেদনা-হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার
শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার
বিকশি উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম
দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া- সম !
আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল
ক’রে ওঠে সারা হিয়া’ শিশির-সজল !

.                         টলমল ধরণীর মত করুণায় !
.                        তুমি রবি তব তাপে শুকাইয়া যায়
.                        করুণা-নীহার-বিন্দু ! ম্লান হ’য়ে উঠি
.                        ধরণীর ছায়াঞ্চলে ! স্বপ্ন যায় টুটি’
.                        সুন্দরের, কল্যাণের ! তরল গরল
.                        কন্ঠে ঢালি তুমি বল, ‘অমৃতে কি ফল ?
.                        জ্বালা নাই নেশা নাই নাই উন্মাদনা,----
.                        রে দুর্বল, আমাদের অমৃত-সাধনা
.                        এ দুঃখের পৃথিবীতে তোর ব্রত নহে !
.                        তুই নাগ, জন্ম তোর বেদনার দহে !
.                        কাঁটা কুঞ্জে বসি তুই গাঁথিবি মালিকা,
.                        দিয়া গেনু ভালে তোর বেদনার টীকা !’------

গাহি গান, গাঁথি মালা, কন্ঠ করে জ্বালা
দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ নাগ-বালা !-------

.                        ভিক্ষা-ঝুলি নিয়া ফের, দ্বারে দ্বারে ঋষি
.                        ক্ষমাহীন হে দুর্বাসা !  যাপিতেছে নিশি
.                        সুখে বর-বধূ যথা----সেখানে কখন
.                        হে কঠোর-কন্ঠ গিয়া ডাক, ‘মূঢ়, শোন্,
.                        ধরণী বিলাস-কুঞ্জ নহে নহে কারো,
.                        অভাব বিরহ আছে, আছে দুঃখ আরো
.                        আছে কাঁটা শয্যাতলে বাহুতে প্রিয়ার,
.                        তাই এবে কর্ ভোগ !’ ----পড়ে হাহাকার
.                        নিমেষে সে সুখ-স্বর্গে, নিবে যায় বাতি,
.                        কাটিতে চাহে না যেন আর কাল-রাতি !

চল-পথে অনশন-ক্লিষ্ট ক্ষীণ তনু
কী দেখি বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রু-ধনু,
দু’---নয়ন ভরি রুদ্র হান অগ্নি বাণ,
আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান,
প্রমোদ-কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা----
তোমার আইনে শুধু মৃত্যু-দন্ড লিখা !

.                        বিনয়ের ব্যাভিচার নাহি তব পাশ,
.                        তুমি চাহ নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ
.                        সঙ্কোচ শরম বলি’ জান নাক’ কিছু,
.                        উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু |
.                        মৃত্যু-পথ-যাত্রীদল তোমার ইঙ্গিতে
.                        গলায় পরিছে ফাঁসি হাসিতে হাসিতে !        
.                        নিত্য অভাবের কুন্ড জ্বলাইয়া বুকে
.                        সাধিতেছ মৃত্যু-যজ্ঞ পৈশাচিক সুখে !

লক্ষ্ণীর কিরীটী ধরি ফেলিতেছ টানি
ধূলিতলে ! বীণা-তারে করাঘাত হানি
সারদার, কী সুর বাজাতে চাহ গুণী ?
যত সুর আর্তনাদ হ’য়ে ওঠে শুনি !

.                        প্রভাতে উঠিয়া কালি শুনিনু , সানাই
.                        বাজিছে করুণ সুরে ! যেন আসে নাই
.                        আজো কা’রা ঘরে ফিরে ! কাঁদিয়া কাঁদিয়া
.                        ডাকিছে তাদের যেন ঘরে ‘সানাইয়া’ !
.                        বধূদের প্রাণ আজ সানা’য়ের সুরে
.                        ভেসে যায় যতা আজ প্রিয়তম দূরে
.                        আসি আসি করিতেছে !        সখী বলে, ‘বল্
                     মুছিলি কেন লা আঁখি, মুছিলি কাজল ?’

শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই !        
ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি
বিধবার হাসি-সম-----স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি !
নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায়
দুরন্ত নেশায় আজি, পুষ্প-প্রগল্ ভায়
চুম্বনে বিবশ করি’ ! ভোমোরার পাখা
পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা !

.                        উছলি’ উঠিছে যেন দিকে দিকে প্রাণ !
.                        আপনার অগোচরে গেয়ে উঠি গান
.                        আগমনী আনন্দের !  অকারণে আঁখি
.                        পূরে আসে অশ্রু-জলে ! মিলনের রাখী
.                        কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণীর সাথে !
.                        পুষ্পাঞ্জলি ভরি’ দুটি মাটি-মাখা হাতে
.                        ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার !
.                        ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার !------
.                        সহসা চমকি উঠি !  হ’য়ে মোর শিশু
.                        জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাও নি ক’ কিছু
.                        কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর,
.                        কাঁদ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর !

পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,
দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে !-- মোর অধিকার,
আনন্দের নাহি নাহি ! দারিদ্র্য অসহ
পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি !  কে বাজাবে বাঁশী ?
কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি ?
কোথা পাব পুষ্পাসব ?---ধুতুরা --গেলাস
ভরিয়া ক’রেছি পান নয়ন-নির্যাস | ------

.                        আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
.                        ও যেন কাঁদিছে শুধু----নাই, কিছু নাই !


                                                             ২৪ শে আশ্বিন,১৩৩৩


.                          **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সিন্ধু-হিন্দোল , কাজী নজরুল ইসলাম

ফাল্গুনী       

                              
সখি        পাতিস্ নে শিলাতলে পদ্মপাতা,
সখি        দিস্ নে গোলাব ছিটে খাস্ লো মাথা !
.        যায়         অন্তরে ক্রন্দন
.                করে হৃদি মন্থন
.                তারি হরি-চন্দন
.                        কম্ লী মালা-----
সখি        দিস্ নে লো, দিস্ নে লো, বড় সে জ্বালা !
বল্         কেমনে নিবাই সখি বুকের আগুন !
এল        খুন-মাখা তূন নিয়ে খুনেরা ফাগুন !
.        সে যে হানে হুল খুনসুড়ি
.                ফেটে পড়ে ফুলকুঁড়ি
.                আইবুড়ো-আইবুড়ি
.                       বুকে ধরে ঘুণ !
যত        বিরাহিনী নিম-খুন---কাটা-ঘায়ে নুন !
     
আজ        লাল-পানি পিয়ে দেখি সব-কিছু চুর !
সবে        আতর বিলায় বায়ু বাতাবি নেবুর !
.        হ’ল         মাদার অশোক ঘা’ল
.                রঙন ত নাজেহাল !
.                লালে লাল ডালে-ডাল
.                        পলাশ শিমূল !
সখি        তাহাদের মধু ক্ষরে ----মোরে বেঁধে হুল্ !


নব        সহকার-মঞ্জরি সহ ভ্রমরী !
চুমে        ভোম্ রা নিপট, হিয়া মরে গুমরি’ !
.        কত        ঘাটে ঘাটে সই-সই
.                ঘট ভরে নিতি ওই,----
.                চোখে মুখে ফোটে খই,------
.                      আব-রাঙা গাল
যত        আধ-ভাঙা ইঙ্গিত তত হয় লাল !


আর        সইতে পারিনে সই ফুল-ঝামেলা,
প্রাতে         মল্লী চাঁপা, সাঁঝে বেলা চামেলা !
.        হের        ফুট্ লো মাধবী হুরী
.                ডগমগ তরুপুরী
.                পথে পথে ফুলঝুরি,
.                          সজিনা ফুলে |
এত        ফুল দেখে কুলবালা কূল না ভুলে !


সাজি,        বাটা-ভরা ছাচিপান ব্যজনী-হাতে
করে        স্বজনে বীজন কত সজনি ছাতে |
.        সেথা        চোখে চোখে সঙ্কেত,
.                কানে কথা---যাও ধেৎ,-----
.                ঢ’লে পড়া অঙ্কেতে
.                          মনমথ-ঘায় !
আজি        আমি ছাড়া আর সবে মন-মত পায় !


সখি        মিষ্টি ও ঝাল মেশা এল একি বায় !
এ   যে        বুক যত জ্বালা করে মুখ তত চায় !
.        এ যে          শরাবের মত নেশা
.                এ পোড়া মলয় মেশা,
.                ডাকে তাহে কুলনাশা
.                       কালামুখো পিক্ !
যেন        কাবাব করিতে বেঁধে কলিজাতে শিক্ !


এল         আলো-রাধা ফাগ ভরি’ চাঁদের থালায়,
ঝরে        জোছনা-আবীর সারা শ্যাম সুষমায় !
.        যত        ডাল-পালা নিমখুন’
.                ফুলে ফুলে কুম্কুম,
.                চুড়ি বালা রুম্ ঝম্
.                        হোরির খেলা,
শুধু        নিরালায় কেঁদে মরি আমি একেলা !



আজ        সঙ্কেত-শঙ্কিতা বন-বীথিকায়
কত        কুলবধূ ছিঁড়ে শাড়ি কুলের কাঁটায় !
.        সখি        ভরা মোর এ দু’কূল
.                কাঁটাহীন শুধু ফুল !
.                ফুলে এত বেঁধে হুল ?----
.                      ভাল ছিল হায়,
সখি        ছিঁড়িত দুকুল যদি কুলের কাঁটায় !


                                             হুগলী, ফাল্গুন----১৩৩২

.                          **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সিন্ধু-হিন্দোল , কাজী নজরুল ইসলাম

বধূ--বরণ

এতদিন ছিলে ভূবনের তুমি
.        আজ ধরা দিলে ভবনে,
নেমে এলে আজ ধরার ধূলাতে
.        ছিলে এতদিন স্বপনে!
শুধু শোভাময়ী ছিলে এত দিন
কবির মানসে কলিকা নলিন,
আজ পরশিলে চিত্ত-পুলিন
.        বিদায়-গোধূলি-লগনে |
ঊষার ললাট-সিন্দুঁর-টিপ
.        সিঁথিতে উড়াল পবনে !


প্রভাতের ঊষা কুমারী সেজেছে,
.        সন্ধ্যায় বধূ ঊষসী,
চন্দন টোপা-তারা-কলঙ্কে
.        ভ’রেছে  বে-দাগ মু’শশী |
মুখর মুখ আর বাচাল নয়ন
লাজ-সুখে আজ যাচে গুন্ঠন,
নোটন-কপোতী কন্ঠে এখন
.        কূজন উঠিছে উছসি’ !
এত দিন ছিলে শুধু রূপ-কথা,
.        আজ হ’লে বধূ রূপসী ||


দোলা চঞ্চল ছিল এই গেহ
.        তব লটপট বেণী ঘা’য়,
তারি সঞ্চিত আনন্দ ঝলে
.        ঐ ঊর হার মণিকায় !
এ ঘরের হাসি নিয়ে যাও চোখে
সে গৃহ-দীপ জ্বেলো এ আলোকে,
চোখের সলিল থাকুক এ-লোকে----
.        আজি এ মিলন-মোহনায়
ও-ঘরের হাসি বাঁশীর বেহাগ
.        কাঁদুক এ-ঘরে সাহানায় |


বিবাহের রঙে রাঙা আজ সব,
.        রাঙা মন রাঙা আভরণ,
বল নারী------“এই রক্ত-আলোকে
.        আজ মম নব জাগরণ !”
পাপে নয়, পতি পুণ্যে সুমতি
থাকে যেন, হ’য়ো পতির সারথি |
পতি যদি হয় অন্ধ, হে সতী,
.        বেঁধোনা নয়নে আবরণ
অন্ধ পতির আঁখি দেয়  যেন
.        তোমার সত্য আচরণ ||

.             **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সিন্ধু-হিন্দোল , কাজী নজরুল ইসলাম

রাখীবন্ধন

সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী ?
নীলিমা বহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী !
অলকার পানে বলাকা ছুটিছে, মেঘ-দূত মন মোহিয়া !
চঞ্চুতে রাঙা কল্ মীর কুঁড়ি----মরতের ভেট বহিয়া !
সখীর গাঁয়ের সেঁউতি-বোঁটার ফিরোজায় রেঙে পেশোয়াজ্
আস্ মানী আর মৃন্ময়ী সখী মিশিয়াছে মেঠো পথ-মাঝ !
আকাশ এনেছে কুয়াশা-উড়ুনী, আস্ মানী-নীল-কাঁচুলি,
তারকার টিপ, বিজুলীর হার, দ্বিতীয়া-চাঁদের হাঁসুলি !
ঝরা-বৃষ্টির ঝর্ ঝর্ আর পাপিয়া শ্যামের কূজনে
বাজে নহবত্ আকাশ ভূবনে---সই পাতিয়েছে দু’জনে !
আকাশের দাসী সমীরণ আনে শ্বেত পেঁজা-মেঘ ফেনা ফুল,
হেথা জলে থলে কুমুদে-কমলে আলুথালু ধরা বেয়াকুল !
আকাশ-গাঙে কি বান ডেকেছে গো, গান গেয়ে চলে বরষা,
বিজুরীর গুণ টেনে টেনে  চলে মেঘ-কুমারীরা হরষা |
হেথা মেঘ পানে কালো চোখ হানে মাটির কুমার মাঝিরা,
জল ছুঁড়ে মারে মেঘ-বালা দল, বলে, ‘-----চাহে দেখ পাজীরা |’
কহিছে আকাশ, ‘ও লো সই, তোর চকোরে পাঠাস নিশিতে,
চাঁদ ছেনে দেবো জোছনা-অমৃত তোর ছেলে যত তৃষিতে !
আমারে পাঠাস সোঁদা-সোঁদা-বাস তোর ও মাটির সুরভি,
প্রভাত-ফুলের  পরিমল মধু, সন্ধ্যা বেলায় পূরবী !’
হাসিয়া উঠিল আলোকে আকাশ, নত হ’য়ে এল পুলকে,
লতাপাতা ফুলে  বাঁধিয়াআকাশ ধরা কয়, ‘সই ভূলোকে
বাঁধা প’লে আজ,’ চেপে ধ’রে বুকে লজ্জায় ওঠে কাঁপিয়া,
চুমিল আকাশ নত হ’য়ে মুখে ধরণীর বুকে ঝাঁপিয়া |


.             **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর
*
সিন্ধু-হিন্দোল , কাজী নজরুল ইসলাম

চাঁদনী--রাতে

কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগণের নীল গাঙে,
হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্বুদ, জোছনা সোনায় রাঙে !
তৃতীয়া চাঁদের “শাম্পানে” চড়ি চলিছে আকাশ-প্রিয়া,
আকাশ-দরিয়া উতলা হ’ল গো পুতলায় বুকে নিয়া |
তৃতীয়া চাঁদের বাকী “তের কলা” আব্ ছা কালোতে আঁকা
নীলিম-প্রিয়ার নীলা “গুল্ রুখ” অবগুন্ঠনে ঢাকা |
সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রাণী,
সেহেলী “লায়লী” দিয়ে গেছে চুপে কূহেলী মশারি টানি’ !
দিক্-চক্রের ছায়া-ঘন ঐ সবুজ তরুর সারি,
নীহার-নেটের কুয়াশা-মশারি-----ওকি বর্ডার তারি ?
সাতাশ তারার ফুল-তোড়া হাতে আকাশ নিশুতি রাতে
গোপনে আসিয়া তারা-পালঙ্কে শুইল প্রিয়ার সাথে !
উহু উহু করি কাঁচা ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে নীলা হুরী,
লুকিয়ে দেখে তা “চোখ গেল” বলে চেঁচায় পাপিয়া ছুঁড়ি !
“মঙ্গল”  তারা মঙ্গল-দীপ জ্বলিয়া প্রহর জাগে,
ঝিকিমিকি করে মাঝে মাঝে ---বুঝি বধূর নিশ্বাস লাগে !
উল্কা-জ্বালার সন্ধানী-আলো লইয়া আকাশ-দ্বারী
“কাল-পুরুষ” সে জাগি বিনিদ্র করিতেছে পায়চারি !

সেহেলীরা রাতে পালায়ে এসেছে উপবনে কোন্ আশে,
হেথা হোথা ছোটে----পিকের কন্ঠে ফিক্ ফিক্ ক’রে হাসে |
আবেগে সোহাগে আকাশ-প্রিয়ার চিবুক বাহিয়া ওকি
শিশিরের রূপে ঘর্মবিন্দু ঝ’রে ঝ’রে পড়ে সখি,
নবমীর চাঁদের “সসারে” ও কেগো চাঁদনী-শিরাজী ঢালি
বধূর অধরে ধরিয়া কহিছে-----“তহুরা পিত্তলো আলি !”
কার কথা ভেবে তারা-মজ্ লিশে দূরে একাকিনী সাকী
চাঁদের ‘সসারে’ কলঙ্ক-ফুল আন্ মনে যায় আঁকি !-------
ফর্ হাদ শিরী-লায়লী মজ্ নু মগজে ক’রেছে চিড়,
মস্তানা শ্যামা দধিয়াল ঢানে বায়ু-বেয়ালার মীড় !
আন্ মনা সাকী ! অম্ নি আমারো হৃদয়-পেয়ালা-কোণে
কলঙ্ক-ফুল আনমনে সখি লিখো মুছো খনে খনে !


.             **************



.                                                                             
পরে  

মিলনসাগর