ই-মেল : onemayukh@hotmail.com আমাকে বলা হয়েছে যে, আমার(আমাদের বাবার)সম্বন্ধে আমরা যা জানি তাই কাগজে কলমে ধরে রাখতে| অনেক বছর হয়ে গেছে বাবুর সাথে বিচ্ছিন্ন হয়েছি| (ক্ষমা করে দেবেন আমি ছোট থেকেই বাবাকে বাবু বলেই সম্বোধন করে আসছি)| বাবু বললে মনে হয় মানুষটি খুব কাছের | বাবুর সম্বন্ধে লিখতে বসে অনেক বছর পিছনে চলে যেতে হয়েছে | আমরা ৯ বোন ও ৩ ভাই এক সাথে ছিলাম | (এর মধ্যে দুই ভাই ও দুই বোন খুরতুতো | ) কিন্তু আমার বাবু আমাদের এমন ভাবে মানুষ করেছিলেন যে কেউ বুঝতেই পারত না যে, আমরা এক মা বাবার সন্তান না |
আমার সাথে বাবুর সম্পর্ক মাত্র ২৪ বছরের | এই কটা বছরের মধ্যে বাবুকে কতটুকুই বা জানতে পেরেছি? তবে এই টুকুই বলতে পারি যে, বাবু বাবু ছিলেন আমার কাছে গৃহি সন্নাসীর মত | সুপুরুষ চেহারা,তামাটে গায়ের রং, একটু একটু কোকরানো চুল পেছনের দিকে | বাবুর গোঁফ খুব বিখ্যাত ছিল | চোখদুটো ছিল বাঘের মতো | কিন্তু ভয় লাগতো না | লম্বাতে মনে হয় ৫`১১`` ছিল | তখন তো আমাদের মেপে ধেখার মত ধারনা ছিল না | বাবুকে সবসময় খদ্দরের ধুতি, খদ্দরের পাঞ্জাবী ও মুগার চাদর ব্যবহার করতে দেখেছি | পায়ে চপ্পল থাকত | আমার যতদুর মনে হয়, আমার জ্ঞানতো বাবুকে বিদ্যাসাগরি চপ্পল পরতে দেখি নাই | এই কথাটা লিখলাম এই জন্যই যে, তখনকার দিনে বিদ্যাসাগরি চপ্পলের চল ছিল | তবে বাবু হাফ হাতাওয়ালা গোল গলা গেঞ্জি | পরের দিকে ওটাকে উত্তমকুমার গেঞ্জি বলে বিখ্যাত ছিল | বাবু মুগুর ভাজতেন, ডন বৈঠক করতেন | পরবর্তী কালে বাবুর মুগুর দুটো নিয়ে আমরা খেলতাম | তবে পরের দিকে বাবুর শরীরেই ডন বৈঠকের ঐতিহ্য বজায় ছিল | বাবু উপর থেকে যতটা কঠিন ছিলেন ভেতর থেকে ততটা নবম ছিলেন | একদম নারকেলের মতো | কত লোক যে ওনার সাহায্যে বেঁচে ছিল সেটা আমরা জানতেও পারি নাই | আমার এই ২৪ বছর বাবুর সাথে কত উথ্বান পতনের মধ্যে দিয়ে গেছে, সেটা এখন মনে করলে খুব খারাপ লাগে| একটা মজার কথা মনে পরে গ্যালো | বাবুর এতোগুলো সন্তানের কারও নাম মনে থাকতো না |
কি যে, লিখব, অনেক কথাই এলোমেলো ভাবে মনে পরে যায় | মনে পরে, বাবু আমাদের খেলাধুলায়, ক্ষেতে কাজ করতে দেওয়াতে এবং গাছে চরতে খুব উত্সাহ দিতেন | আমাদের জন্য তীর ধনুক, বল্লম এনে দিয়েছিলেন | আমরা এগুলো নিয়ে অভ্যাস করতাম | মনে পরে যায় বাবু যখন খেতে বসতেন, বাবুর হাতের দলার জন্য আমরা বসে থাকতাম | কি যে তার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে | বাবু রোজ ভোর বেলায় ‘Morning Walk’ এ যেতেন | কোন কোন দিন আমি বাবুর সাথে যেতাম | আমরা হাট্ ছি হটাত্কোন লোক এসে বল্ল,”বড় বাবু আমার বাড়িতে দুদিন থেকে উনুন জ্বলে নাই”| বাবু সঙ্গে সঙ্গে বল্লেন চলো আমার সাথে বাড়ীতে | বাড়ীতে এসে মাকে বল্লেন, চাল, ডাল দিয়ে দিতে | উনি একবার চিন্তাও করলেন না যে, নিজেদের খাবার বন্দোবস্ত আছে কিনা | একেক বার তো এমন হয়েছে যে, মাসের salary পুরো বাড়ীতে আনতেই পারেন নাই |
আমাদের মাও কম ছিলেন না | উনি ছিলেন মন থেকে ভীষন উদার প্রকৃতির | বাবু বাড়ীর বাইরে থেকে দান করতেন, মা বাড়ীর ভেতর থেকে দান করতেন | কেউই বুঝতেও পারত না | ওনারা নিজেদের জন্য কিছুই করতেন না | মনে হয় যেন ওনারা পৃথিবীতে এসেছিলেন অন্যের জন্য| বাবু ভীষন ভাল সেবা করতে জানতেন | ওনার মধ্যে কোন ভয় বলে পদার্থ ছিল না|শুনেছি বাবুর নাকি করলা নদীর পাড়ে বিরাট বড় বাড়ী ছিল| আজ তার ধ্বংসাবশেষ পরে আছে, কিন্তু মধুবাবুর ঘাট বলে একডাকে সকলেই চেনে | সেটা জলপাইগুড়িতে শিল্পসমিতি পাড়াতে আছে| শুনেছি বাবুর নামে হাসপাতালে একটা Bed ছিল | কোন অসুস্থ লোকের যদি Bed এর দরকার পরত তাহলে বাবুর নাম করলে সে Bed টা পেয়ে যেত| এমন কি মাসকলাই বাড়ী শ্মশানেরও বাবুর নামে বছরে চারটা Pass ছিল | খুব গরীব যারা তাদের জন্য বছরে মরা পুরানের জন্য ১টা Free Pass ছিল| বাবুরা ৫ বন্ধু মিলে একটা দল গড়েছিলেন | যখন কোন বাড়ীতে কেউ মারা যেত তখনি বাবুদের ডাক পরতো | বাবুকে বলত “কলি যুগের হরিশচন্দ্র”| মনে ভয় ডর বলে কোন পদার্থ ছিল না |
আমাদের বাড়ীতে লক্ষ্ণীপূজো হতো | ছোটবেলা থেকে দেখে এশেছি বাড়ীতে দুটো পূজো হতো| একটা বাড়ীর হতো, আর একটা হতো আমাদের জোতের জন্য | জোত মানে অনেক জমি এক সাথে থাকলে তাকে বলে জোত | ছোটবেলায় শুনেছিলাম বাবুর প্রজা স্বপ্ন দেখেছিল মা লক্ষ্মী তাঁর দুই সখী নিয়ে বাবুর জমিতে নাচছিলেন | সেটা দেখার পরে বাবুকে এসে বলাতে বাবু আমাদের কুল পুরোহিতের সাথে কথা বলে জোতে পূজো শুরু করেছিলেন | পূজোর পর মা লক্ষ্মীকে নিয়ে যাওয়া হ’ত জোতে | তারপর দিন থেকে মেলা শুরু হ’ত| প্রথমে ৭দিন মেলা হোত | আস্তে আস্তে ৫ দিনে ঠেকেছিল | আমরা সকলে গরুর গাড়ী করে মজা করতে করতে মেলাতে যেতাম| খুব মজা হ’ তো | বাবু চলে যাবার পর সব আস্তে আস্তে সব কমে আসতে লাগল | তারপর দাদাও চলে গেলেন | আমাদের সব বোনেদের বিয়ে হয়ে গেল| ভেবেছিলাম যে মেলা বন্ধ হয়ে যাবে| কিন্তু প্রজারা এখনো বাবুর নামে জোতে পূজো করে মেলা চালিয়ে যাচ্ছে | শুনলে কি যে ভাল লাগে | একটা প্রবাদ আছে “দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে জান না”| সত্যই বাবু যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন বুঝি নাই ওনার এত খ্যাতি ছিল সমাজে | আস্তে আস্তে সব শেষ হয়ে গেল | ১৯৬৬, ৬ই মার্চ আমাদের সকলকে ফেলে রেখে বাবু তাঁর নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন | মনে হয় ১লা মার্চ আমার দিদি,জামাইবাবুরা তাদের মেয়েকে নিয়ে আন্দামান থেকে এসেছিলেন | তখন আমার S.S.C.শেষ হয়েছে | ছুটিতে ছিলাম | দিদিরা plan করেছিল Assam-এ যাবে Tea Garden দেখতে | সেখানে আমাদের দাদা assistant Manager ছিলেন |
আমাকেও নিয়ে যাবে | ভোর বেলায় আমরা রওনা হব সেটাই ঠিক ছিল| হঠাৎ বাবু ভোর বেলায় বাথরুম যাবেন বলে আমাকে ডাকলেন | আমি গিয়ে দাঁড়ালাম | বাবু ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে আমাকে বল্লেন, “তুই ও যাবি ওদের সাথে”? আমি বল্লাম ওরা বলেছে যেতে | ব্যাস, বাবুর সাথে এই শেষ কথা | হঠাৎ কিছুক্ষণ পরে একটা গোহ্গানির আওয়াজ শুনে উঠে ছুটে বাবুর বিছানার পাশে এসে দেখি বাবু, বাবুর ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতটা মালিশ করছেন এবং মুখ বেঁকে গ্যাছে | আমি চিত্কার করে সকলকে ডাকলাম | ডাক্তার ডাকা হ’ল | এই অবস্থায় ৬ দিন বেঁচে ছিলেন | বাডীতেই saline এর ব্যাবস্থা করা হ’ল | আমার রাতের duty শুরু হল |
৫ দিন আমি সমানে রাত জেগে বাবুর সেবা করে গ্যাছি | দাদা রাত্রে মাঝে মাঝে চা দিয়ে যেতেন| ৬দিনের দিন বাবু বিকেল ৬টায় সময় সকলের মায়া ত্যাগ করে নিজের জায়গায় চলে গ্যালেন | বাবু আমাদের শিখিয়ে ছিলেন কেউ মারা গ্যালে কাঁদলে তার আত্মার কষ্ট হয় | আমরা কেউ কাঁদি নাই | সে দিনটির কথা কোন দিন ভুলতে পারব না | সবচেয়ে আশ্চর্য যে, বাবুর শ্রাদ্ধের দিন হঠাৎ কোথা থেকে এক ভদ্রমহিলা এসে বাবুর সাথে দেখা করতে চাইলেন | ওনাকে বলা হ”ল আজ বাবুর কাজ | শুনে ভদ্রমহিলা আত্ কে উঠে ডুকরে কেঁদে উঠলেন| বাড়ীর ভেতরে এসে বল্লেন বাবু ছিলেন “কলি যুগের রাজা হরিশচন্দ্র”| এই বলে উনি কিছু টাকা বের করে দিলেন | (টাকার অঙ্কটা এখন আমার মনে নেই) বল্লেন বাবুর কাছ থেকে অনেকদিন আগে নিয়েছিলাম | ফেরত দিতে এসেছিলাম | ভদ্রমহিলার সেই টাকাটা বাবুর কাজে লাগান হয়েছিল |
বাবুর কথা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে যে, বাবুকে যে মন দিয়ে সেবা করেছিলাম, তাঁর আশীর্ব্বাদে আজ আমি আমেরিকাতে বসে বাবুর সম্বন্ধে লিখতে পারছি | বাবু ও মা আশীর্ব্বাদ আমাদের সকলের মাথার উপরেই আছে| চিরদিন থাকবে | আর লিখতে পারছি নাসব খেই হারিয়ে ফেলেছি | এবার আমাকে কলম থামাতে হবে | যদি কোন ভূল ত্রুটি হয়ে থাকে ক্ষমা করে দেবেন |
শ্রীমতী পান্না গুপ্তা, মধুসূদন দাশগুপ্তর ষষ্ঠ কন্যা আমেরিকা, মে ২০১০