ধর্মমঙ্গল
প্রফেসার নন্দিতা বসু
দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়
১৯-০৪-২০১৪

বাংলা মঙ্গলকাব্যের ধারায় ধর্মমঙ্গল এমন একটি কাব্য যার কাহিনীর পেছনে বেশ কিছু যুদ্ধবিগ্রহ এবং
অভীষ্ট লাভের জন্য নারীর অনেক শারীরিক দুঃখবরণের নিদর্শন রয়েছে | ধর্মঠাকুরকে কেন্দ্র করে যে
বাত্সরিক গাজন উত্সব হয় তাতে বহুসংখ্যক ভক্ত এবং অনেক কঠোর নিয়মপালনের মধ্যে অনেক
শারীরিক কষ্ট সহ্য করে যেমন ধর্মমন্দিরের সামনে জড়ো করা ‘কন্টিকারী’ গাছের ডাল দু’হাতে নিয়ে নাচ
করে ও পরস্পরকে আঘাতের মাধ্যমে ধর্মঠাকুরের প্রতি ভক্তিপ্রদর্শন করে |

ধর্মপূজা প্রধানত রাঢ় অঞ্চলে প্রচলিত | কলকাতা শহরের কেন্দ্রবর্তী একটিস্থানের নাম ‘ধর্মতলা’ হওয়াতে
মনে হয় এখানেও এককালে নিশ্চয় অনেক সমারোহ করে ধর্মপূজার প্রচলন ছিল | হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মনে
করতেন যে ধর্ম হচ্ছেন বৌদ্ধ দেবতা কারণ অমরকোষে বুদ্ধদেবের এক নাম ধর্মরাজ বলে উল্লেখ করা
হয়েছে | সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন যে ‘ধর্ম’ শব্দটি কর্মবাচক কোন অস্ট্রিক শব্দের সংস্কৃতায়িত
রূপ | ধর্মঠাকুরকে নিয়ে নৃতত্ত্ববিদ, ভাষাতাত্ত্বিক পন্ডিতদের মধ্যে অনেক মতভেদ আছে | তবে তিনি যে
ডোমদের দেবতা সে বিষয়ে সকলেই একমত | কারণ ধর্মঠাকুরের অনেক প্রাচীন মন্দিরের পূজারী হচ্ছেন
ডোম, ধর্মঠাকুরের বরে সন্তানলাভ ঘটে এই বিশ্বাসে অনেক বন্ধ্যা নারী ধর্মের বার্ষিক গাজনে দেবতার
স্নানজলের ‘প্রথম বিন্দু’ ধারণের জন্য উন্মুখ থাকেন |

ধর্মঠাকুরের গাজন উত্সবের সময়েই তাঁর মাহাত্ম্যসূচক কাহিনী নিয়ে লেখা ধর্মমঙ্গল চব্বিশটি পালায়
বিভক্তকরে বারোদিন ধরে গাওয়া হয় | ধর্মের উত্সব ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য--- এই কয় মাসের যে
কোন শুক্ল তৃতীয়ার দিনে শুরু হয়ে পূর্ণিমায় সমাপ্ত হয় |

ধর্মমঙ্গলের কাহিনীটি এরকম : গৌড় ধর্মপাল নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি মারা গেলে তাঁর ছেলে গৌড়ের
রাজা হন | তাঁর মন্ত্রীর নাম মহামদ এবং সম্পর্কে তিনি গৌড়েশ্বরের শ্যালক | মহামদ ছিলেন যথেষ্ট
অত্যাচারী এবং দুরভিসন্ধি পরায়ণ | তিনি সোম ঘোষ নামে গৌড়েশ্বরের এর অনুগত প্রজাকে কয়েদ করেন
এবং সোম ঘোষকে মুক্ত করে নিজের সামন্ত রাজা কর্ণসেনের তত্ত্বাবধানে ত্রিষষ্ঠির গড়ে পাঠিয়ে দেন | সোম
ঘোষের ছেলে ইছাই ঘোষ বড় হয়ে খুব দুর্দান্ত প্রকৃতির হয় এবং কর্ণসেনের প্রাসাদ আক্রমণ করে তাঁকে
সেখান থেকে উত্খাত করে | কর্ণসেন  গৌড়ে পালিয়ে যান | ইছাই নূতন গড় নির্মাণ করে তার নাম দেয়
ঢেকুর | গৌড়েশ্বর নয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে ইছাইয়ের গড় আক্রমণ করতে এলে অজয়ের বন্যায় তাঁর বহু সৈন্য
মারা যায়, যার মধ্যে কর্ণসেনের ছয়পুত্র ছিল | পুত্রশোকে কর্ণসেনের রাণী আত্মঘাতিনী হন, ছয় পুত্রবধূ
সহমরণে যায় | এতগুলি আকস্মিক ঘটনায় কর্ণসেন পাগল হয়ে যান |

কর্ণসেনকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনবার জন্য গৌড়েশ্বর নিজের শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে বিয়ে
দেন | এই বিয়ের সময় মহামদ উপস্থিত ছিলনা | তার প্রিয় বোনের সঙ্গে বৃদ্ধ কর্ণসেনের বিয়ে হওয়াতে
মহামদ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয় ও নানাভাবে কর্ণসেনের ক্ষতি করবার ফন্দী খুঁজতে থাকে | একবার গৌড়ের
রাজসভায় কর্ণসেনকে ‘আঁটকুড়া’ বলে অপমান করে | রঞ্জাবতী স্বামীকে এই অপমানের হাত থেকে বাঁচাবার
জন্য ধর্মঠাকুর পূজারী রমাই পন্ডিতের শরণাপন্ন হন | রমাই পন্ডিত তাকে বলেন যে পুত্র লাভের জন্য
ধর্মঠাকুরের পূজো করে ‘শালে ভর’ দিতে হবে | অর্থাৎ লোহার ধারালো শলাকার উপর নিজেকে বিদ্ধ করতে
হবে | কর্ণসেনের সমস্ত আপত্তি অস্বীকার করে রঞ্জাবতী লৌহ শলাকাবিদ্ধ হয়ে প্রাণ ত্যাগের প্রস্তুতি নিলেন |
তাঁর নিষ্ঠা ও ভক্তি দেখে ধর্মঠাকুরের দয়া হ’ল | তিনি রঞ্জাবতীর প্রাণদান করলেন এবং পুত্রবর দিলেন |
লাউসেন নামে রঞ্জাবতীর পুত্র জন্মাল এবং ধর্মঠাকুরের কৃপায় মল্লবিদ্যায় অত্যন্ত পারদর্শী হয়ে উঠল | তার
আদর্শ আচরণের জন্য মা-বাবাসহ সে সকলের খুব প্রিয় হয়ে উঠল | কুচক্রী মহামদ নানাভাবে লাউসেনের
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল | কিন্তু ধর্মঠাকুরের বরে সেই সমস্ত ষড়যন্ত্র বানচাল হয়ে যাচ্ছিল | ধর্মের কৃপায়
নিজের শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়ে লাউসেন নানা সময়ে বাঘ, কুমীর এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণা নারীকে জামতী
নামক স্থানে পরাস্ত করেন | তাঁর শৌর্যবীর্যের  পরিচয়ে মুগ্ধ হয়ে তের জন বীর যোদ্ধা ডোম লাউসেনের
অনুগত হয় | এরমধ্য থেকে কালুডোমকে লাউসেন সেনাপতির পদে বরণ করেন যখন মহামদের ষড়যন্ত্রে
গৌড়েশ্বর থেকে কামরূপের রাজাকে পরাস্ত করতে পাঠিয়েছিলেন | এই যুদ্ধে জয়ী হয়ে লাউসেন কামরূপ
রাজকুমারী কলিঙ্গা ও মঙ্গলকোট রাজকুমারী অমলাকে পত্নীরূপে লাভ করেন | সিমুলার রাজকন্যা কানড়া-ও
লাউসেনের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে স্বামী হিসাবে বরণ করেন | এরপর মহামদ ফন্দী করে লাউসেনকে বাধ্য
করলেন ইছাই ঘোষকে শায়েস্তা করতে | লাউসেন নয়লক্ষ সৈন্য নিয়ে ইছাইয়ের ঢেকুর রাজ্য আক্রমণ করেন
ও ইছাইয়ের অত্যন্ত পরাক্রমী সেনাপতি লোহাটা বজ্জরের মৃত্যু ঘটে, ইতিমধ্যে লাউসেন তাঁর অভূতপূর্ব
বীরত্বের আরো পরিচয় দেন | এরপর তিনি গৌড়রাজ্যকে পাপমুক্ত করবার জন্য ধর্মপূজার শ্রেষ্ঠ সাধনা
পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় ঘটানোর জন্য হাকন্দ নামক জায়গায় দুস্কর তপস্যায় ব্রতী হন | এই ব্রতের অঙ্গ
হিসাবে নিজের দেহকে নয় খন্ড করে ধর্মঠাকুরের উদ্দেশ্যে আহুতি দেন | লাউসেন যখন এই কঠিন তপস্যায়
রত তখন মহামদ লাউসেনের রাজ্য ময়নানগর আক্রমণ করেন ও বিশ্বাসঘাতকতা করে এই রাজ্যের
সেনাপতি কালুডোমকে হত্যা করেন | কালুপত্নী লখাই ডোমনী মহামদের সঙ্গে যুদ্ধে অসীম বীরত্বের পরিচয়
দেয় ও আক্রমণকারী দলকে রাজ্যের সীমানার বাইরে বের করে দেয় | লাউসেনের দুস্কর তপস্যায় ধর্মের
বরে পশ্চিম আকাশে সূর্যের উদয় হয়, ও গৌড়ের সমস্ত পাপ দূর হয় | ধর্মঠাকুর মহামদের সমস্ত
অপরাধমূলক কাজের শাস্তি হিসাবে কুষ্ঠরোগে তাকে অভিশপ্ত করেন | লাউসেন দয়াপরবশ হয়ে মহামদকে
রোগমুক্ত করেন শুধু দুষ্কার্যের স্মারক হিসাবে মহামদের মুখে শ্বেতকুষ্ঠের দাগ রেখে দেন | এভাবে পৃথিবীতে
ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচার করে লাউসেন পুত্র চিত্রসেনের উপর রাজ্যভার দিয়ে স্বর্গে গমন করেন |

মযূরভট্ট, মাণিক গাঁঙ্গুলী, রূপরাম চক্রবর্তী ( এই নামে দুইজন কবি ছিলেন ), ঘনরাম চক্রবর্তী এঁরা সকলেই
ধর্মমঙ্গল রচনা করেন | যদিও ময়ূরভট্টের লেখা ধর্মমঙ্গলের কোন পুঁথি পাওয়া যায় না | শুধু পরবর্তী কবিরা
তাঁদের কাব্যে ময়ূরভট্টের উল্লেখ করেছেন | ধর্মমঙ্গলকে সমালোচকেরা বলেছেন ‘রাঢ়ের জাতীয় কাব্য’ |
কারণ  অনেক যুদ্ধবিগ্রহের কথা এই কাব্যখানিতে আছে | যে ডোমরা ধর্মঠাকুরের উপাসক সেই ডোমরা
এককালে ছিল বাংলার সেরা যোদ্ধা যার স্মৃতি “আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে” ছড়াটিতে রয়েছে |
ধর্মমঙ্গলে এমন এমন বিষয়ের উল্লেখ আছে যাতে কাব্যটিকে আজ অনেকটাই অন্যভাবে পড়া সম্ভব | যেমন
জামতী নগরে ভিনদেশী পুরুষদের ভোলাবার জন্য লাস্যময়ী নারীর পাতা ফাঁদ অথবা কালুডোমের স্ত্রী লখাই
ডোমনীর যুদ্ধপরিচালনা ও যুদ্ধজয় | কাব্যটির ঐতিহাসিকতা নির্ণয়ের জন্য ভাষাবিজ্ঞান , নৃতত্ত্ববিদ্যা ও
ইতিহাসবিদ্যার সাহায্য প্রয়োজন | সত্যি সত্যি শুধু সাহিত্যবিদ্যা পুঁজি করে মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের
সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার সম্ভব নয় | বর্তমান যুগে পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব এবং ইতিহাসচর্চার যেমন নানা দিগন্ত খুলে গেছে
তা মধ্যযুগের সাহিত্যবিদ্যার নতুন আকল্প
( paradigm ) গড়ে তুলতে প্রচন্ডভাবে ফলপ্রসূ হতে পারে | কবে
তা হবে আমরা জানিনা | আমরা শুধু আশাই করতে পারি |

ডঃ নন্দিতা বসু, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯-০৪-২০১৪

ডঃ নন্দিতাবসুর সাথে যোগাযোগ -
ইমেল -
dilipnandita@yahoo.co.in        
চলভাষ - +৯১৯৮১০২৭৩৩৩৯

আমরা কৃতজ্ঞ, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ডঃ নন্দিতা বসুর কাছে, যিনি আমাদর অনুরোধে ধর্মমঙ্গল
কাব্যের উপর এই লেখাটি পাঠিয়েছেন।

কবি রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল কাব্য আগামী প্রজন্মের কাছে, এই আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে (ইনটারনেট),
পৌঁছে দিতে পারলে আমরা
মিলনসাগরে  এই প্রচেষ্টাকে সার্থক মনে করবো।

কবি রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল কাব্যের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।             



আমাদের যোগাযোগের ঠিকানা -   
srimilansengupta@yahoo.co.in   


এই পাতার প্রথম প্রকাশ ১২.০৫.২০১৪  
.                                                  
                                                    এই পাতার উপরে . . .  
...  
ধর্মমঙ্গল - প্রফেসার নন্দিতা বসু    
ঘনরামের ধর্মমঙ্গল ও বৈষ্ণব পগাবলী  
রুপরাম চক্রবর্তী - সুকুমার সেন, পঞ্চানন মণ্ডল
রূপরামের কাব্যের পুঁথির বিবরণ    
রূপরামের কাব্যরচনা-কাল